Image description

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানকের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) ছিলেন মো. মাসুদুর রহমান বিপ্লব। পিএস-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও তিনি ছিলেন মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস। এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা নানকের সঙ্গে বিভিন্ন উপায়ে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সেই সূত্র ধরে একসময় তিনি নানকের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০০৭ সালে নানক প্রতিমন্ত্রী হলে বিপ্লবও তার পিএস হিসেবে নিয়োগ পান। পেয়ে যান ‘আলাদিনের চেরাগ’।

ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে তিনি চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য এবং নানাবিধ তদবিরের মাধ্যমে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকায় ১১টি বাড়ি ও ফ্ল্যাট, কুমিল্লায় বাড়ি, কক্সবাজারে হোটেল ও ব্যক্তিগত গাড়িসহ হাজার কোটি টাকার মালিক বিপ্লব। যদিও দালিলিক নথিপত্রে এখন পর্যন্ত সাভারের আমিনবাজারে বিলাসবহুল চার ও ছয়তলা দুইটি ভবনের মালিকানার প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানেও জমি ও বাড়ির প্রকৃত মালিক হিসেবে বিপ্লবের নাম পাওয়া গেছে। এছাড়া, তিন ব্যাংক হিসাবে প্রায় সাড়ে নয় কোটি টাকা লেনদেনের তথ্যও মিলেছে। নিজ ও স্ত্রীর নামে জমা রয়েছে প্রায় ৫০ লাখ টাকা।

উপ-সহকারী পরিচালক হলেন দুদকের ১২ সহকারী পরিদর্শক

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বিপ্লব পলাতক রয়েছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর হত্যা মামলা হওয়ায় তিনি বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন।

 

বিপ্লবের যত সম্পদ

দুদক ও এনবিআর সূত্রে পাওয়া নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, মাসুদুর রহমান বিপ্লব ২০১৩-২০১৪ সাল থেকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করছেন। তিনি কর অঞ্চল-২০ এর করদাতা। কাগজে-কলমে পেশা দেখিয়েছেন ব্যবসা। প্রথম আয়কর রিটার্নে তিনি মাত্র ১৮ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা আয় দেখিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার আয় ছিল ২৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

সম্পদের বিবরণে দেখা গেছে, স্থাবর সম্পদের মধ্যে বিপ্লব ২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি সাভারের আমিন বাজারে তিন শতাংশ জমি ক্রয় করেন। মৌজার মূল্য হিসাবে ওই জমির মূল্য ছিল ১১ লাখ ১৫ হাজার টাকা, যা তার আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে, সেখানে তিনি দুই ইউনিটের চারতলা ভবন নির্মাণ করেছেন, যা আয়কর নথিতে উল্লেখ নেই।

আমিনবাজারে ২০১২ সালে আরও পাঁচ শতাংশ জমি ক্রয় করেন বিপ্লব। যেখানে দুই ইউনিটের সাড়ে ছয়তলা ভবনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। মৌজার মূল্য হিসাবে আয়কর নথি অনুযায়ী স্থাবর সম্পদের পরিমাণ এক কোটি ছয় লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকা। যা তিনি আয়কর নথিতে গোপন করেছেন। এছাড়া, তার নামে ব্যাংক হিসাবে ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাওয়া গেছে। এর বাইরে সাড়ে ২৮ লাখ টাকা মূল্যের (ঢাকা মেট্রো-গ-৪৩-৭৩১৬) গাড়ির সন্ধানও পাওয়া গেছে।

 

বিপ্লবের স্ত্রী ইসমত আরা প্রিয়া পেশায় শিক্ষক। তার আয়কর ফাইলে সাড়ে ২৪ লাখ টাকার খোঁজ পাওয়া গেছে। যদিও তা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত কি না, সেটির প্রমাণ এখনও পায়নি দুদক।

রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিপ্লবের নামে এক কোটি ছয় লাখ ৭২ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর সম্পদ এবং ৪৬ লাখ ৭২ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তার মোট সম্পদের মূল্য এক কোটি ৫৩ লাখ ৪৫ হাজার ১৯৩ টাকা। আয়কর নথিসহ অন্যান্য উৎস থেকে পাওয়া তথ্য যাচাই করে তার পারিবারিক ব্যয় পাওয়া যায় ৭১ লাখ ৩৮ হাজার ৪৭৯ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় ও অর্জিত সম্পদ মিলিয়ে মোট অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ২৪ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭২ টাকা। সমুদয় সম্পদের বৈধ উৎস থেকে এসেছে কোটি ৫৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৩ টাকার সম্পদ। এ হিসাবে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পরিমাণ ৬৮ লাখ ২৫ হাজার ৭৫৯ টাকা।

বছরে পাচার হচ্ছে ৭০০ কোটি টাকা

অন্যদিকে, বিপ্লবের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এম আর এন্টারপ্রাইজের নামে এনআরবিসি ও ব্র্যাক ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখা ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের মোহাম্মদপুর শাখায় তিনটি ব্যাংক হিসাবের সন্ধান মিলেছে। যেখানে এনআরবিসি ব্যাংকে ৪১ লাখ ১৭ হাজার ৫৯১ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকে দুই কোটি ৩৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪০২ টাকা এবং প্রিমিয়ার ব্যাংকে এক কোটি ৯৯ লাখ ১৭ হাজার ৪৪৯ টাকা জমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই অর্থের পুরোটাই ২০২৪ ও ২০২৫ সালের বিভিন্ন সময়ে উত্তোলনের প্রমাণ মিলেছে।

লেনদেন হিসাব করলে তিনটি ব্যাংক হিসাবে সাবেক মন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী বিপ্লব প্রায় নয় কোটি ৫০ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। দুদক মনে করছে, দায়িত্বপালনকালে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে অর্জিত এই অর্থের লেনদেন অস্বাভাবিক, যা মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ৪ (২) ও ৪ (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অন্যদিকে, অনুসন্ধান বা নথিপত্রে অঢেল সম্পদের বিবরণ পাওয়া না গেলেও তার বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ ছিল।

অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া মো. মাসুদুর রহমান বিপ্লবকে ২০০৭ সালে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক। ২০০৯ সালে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। সেই সময়ও তিনি বিপ্লবকেই ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপরই বিপ্লবের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাকরি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য ও বিভিন্ন তদবির শুরু করেন। টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটিতে লোক ঢুকিয়ে তিনি বিপুল অর্থের মালিক হন। ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সান্নিধ্যে থাকায় একসময় তিনি নিজেই অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হন।

সারা দেশে এক অকল্পনীয় দুঃশাসন চলছে : নানক

তার নামে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলায় একটি বাড়ি, ঢাকার শনিরআখড়ায় একটি বাড়ি, মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধে দুটি বাড়ি, হেমায়েতপুরে দুটি বাড়ি, সাভার ও নবীনগরে দুটি বাড়ি, কক্সবাজারে নিজস্ব হোটেল, ঢাকার লালমাটিয়ায় দুটি ফ্ল্যাট, আদাবরে দুটি ফ্ল্যাট, শান্তিনগরে একটি ফ্ল্যাট ও আগারগাঁওয়ে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। রয়েছে দামি প্রাইভেটকার।

এসব অভিযোগের বিষয়ে বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তার স্ত্রীর মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়।

বিপ্লবের দুর্নীতির অনুসন্ধান প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘চলমান অনুসন্ধান নিয়ে আগেভাগে বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়। অনুসন্ধান কর্মকর্তার জমা দেওয়া প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে কমিশন মামলা বা আইনানুগ যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটি অফিসিয়ালভাবে জানিয়ে দেব।’

প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লব ও কাউন্সিলর আসিফের গুলিতে মোহাম্মদপুরে দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালের ৩ ও ৪ আগস্ট মোহাম্মদপুরের আসাদগেট সংলগ্ন সড়কে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণের বিক্ষোভ মিছিলে বিপ্লব ও আসিফ অতর্কিত গুলিবর্ষণ করে। বিপ্লবের বিরুদ্ধে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের ওপর হামলারও অভিযোগ রয়েছে।