Image description

আওয়ামী দুঃশাসনে কুষ্টিয়ায় জুলুম-নির্যাতনের নেতৃত্বে ছিলেন দলটির নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের বড় পদে না থাকলেও দলীয় প্রভাবে শোষণ করেন পুরো দেড় দশক। এই জেলায় তার ছিল একক নিয়ন্ত্রণ। তার ইশারায় চলে খুনখারাবি, গুম ও মামলা-হামলা।

২০০৮ সালের নির্বাচনের পরই আওয়ামী অপশাসনের সূচনা। পরের বছর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হানিফ। শুরু করেন বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের ওপর দমনপীড়ন। পুরো জেলায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য নামেন খুনখারাবিতে। প্রথমেই তিনি টার্গেট করেন নিজ দলের প্রতিপক্ষকে। এরই অংশ হিসেবে ২০১০ সালে নিজ বাড়িতে বোমা হামলার শিকার হন আওয়ামী সংসদ সদস্য আফাজ উদ্দিন। ওই ঘটনায় নিহত হন তিনজন। এভাবেই হানিফের মতের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করলেই তাদের দমন করতেন নানাভাবে। তার ক্যাডার বাহিনীর নেতৃত্ব ছিলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মো. সবুজ। পরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় তাকেও গুম করা হয়।

২০১৪ সালের আগে কুষ্টিয়ায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর তেমন কোনো মামলা-হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে বেছে নেন জুলুম-নির্যাতনের অপকৌশল। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী থেকে শুরু করে বিরোধী সব নেতাকর্মীকে দমনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।

হানিফের রোষানলে পড়ে বিএনপির অনেক নেতা মামলা-হামলার শিকার হন, জেলও খাটেন। অন্যদিকে কয়েকজন নেতা ভালো পদে থেকেও কোনো মামলার আসামি হননি। তাদের বিরুদ্ধে আঁতাত করে চলার অভিযোগ আছে। আবার কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসাও পরিচালনা করেছেন।

বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীদের

নামে যত মামলা

বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার শতাধিক মামলা হয়। এতে আসামি করা হয় সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে।

বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা দেখভাল করেন কুষ্টিয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ। তিনি বলেন, আওয়ামী আমলে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার শতাধিক মামলা হয়। আমরা ২৩৫টি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছিলাম। এর মধ্যে ১৭০টি ইতোমধ্যে প্রত্যাহার হয়েছে, অন্যগুলো প্রক্রিয়াধীন।

জামায়াত নেতাকর্মীদের নামে হাসিনার আমলে দুই শতাধিক মামলা হয়। আসামি করা হয় সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে। এ বিষয়ে জামায়াতের মামলা পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত ও দলটির যুব বিভাগের কুষ্টিয়া শহর শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন মিঠু জানান, আমরা ১২০টি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছিলাম। এর মধ্যে ৯০টি প্রত্যাহার হয়েছে, অন্যগুলো প্রক্রিয়াধীন।

মামলা-হামলা থেকে রেহাই পাননি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতাকর্মীরাও। দলটির কুষ্টিয়া শাখার সাধারণ সম্পাদক জিএম তৌহিদ আনোয়ার বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের নামে ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে দেড় শতাধিক মামলা হয়। এখনো ২২টি মামলা চলমান। এছাড়া আমাদের সহযোগী সংগঠনের এক নেতা এক বছরের অধিক সময় গুম ছিলেন।

জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট শামিম উল হাসান অপু বলেন, হাসিনার আমলে ১৪টি মামলা হয় আমার নামে। দুই মাস জেল খেটেছি। ২০১৪ সালের পর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি।

দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম সরকার (মঙ্গল সরকার) আমার দেশকে বলেন, ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দুবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আমি প্রার্থী ছিলাম। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা জোর করে ভোট কাটার পরও দুবারই ৮০ হাজারের বেশি ভোট পেয়েছি। ফ্যাসিবাদী আমলে ১৪টি মামলা হয় আমার নামে। দুই মাস জেল খেটেছি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাড়িতে ঘুমাতে পারিনি, রাতে অন্যত্র থেকেছি।

বিএনপির অফিস ভাঙচুর

২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি ভেড়ামারায় সাবেক সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলামের বাসভবন ও দলটির সভায় হামলা চালিয়ে মারধর ও ভাঙচুর করে জাসদ নেতাকর্মীরা। ২০১৭ সালের ১৯ জুলাই মিরপুর উপজেলা বিএনপি কার্যালয়ে দলটির কেন্দ্র ঘোষিত অনুষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালায় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। হামলার ভিডিওচিত্র ধারণের সময় এনটিভির ক্যামেরাপারসনকে মারধর করা হয়।

২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া শহরের এনএস রোডে (পাবলিক লাইব্রেরির সামনে) জেলা বিএনপি কার্যালয়ে ভাঙচুর করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে শহরের মজমপুর গেটে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহবার উদ্দিনের ব্যক্তিগত অফিস ও তার ভাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুর চালায় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সমবায়বিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, ওই দিন আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বিএনপি অফিস ভাঙচুরের পর রাতে আমার ব্যক্তিগত অফিস ভাঙচুর করে। এ সময় আমার ভাইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও ভাঙচুর করে।

ক্রসফায়ারের নামে হত্যাযজ্ঞ

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ২০১৮ সালের ৮ মে যুবদলকর্মী আলতাব হোসেন, ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবর বিএনপিকর্মী মদন আলী এবং ২০২০ সালের ২৫ জুলাই বিএনপিকর্মী কুদরত আলীকে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সব ঘটনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের পর ২০২৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানায় পৃথক তিনটি এজাহার জমা দেন নিহতদের পরিবারের সদস্যরা।

২০১৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে একই রাতে গুলি করে হত্যা করা হয় বিএনপিকর্মী সুজন মালিথাকে। পরে তার লাশ পাওয়া যায়। কথিত ক্রসফায়ারে নিহত বিএনপিকর্মী সদর উপজেলার টাকিমারা গ্রামের ইসমাইল মালিথার ছেলে।

এছাড়া ২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে দৌলতপুর উপজেলার মহিষকুণ্ডি মাঠপাড়া এলাকায় আটকের পর পুলিশ হেফাজতে মারা যান মেহেদি হাসান সাগর শাকবর। দীর্ঘদিন এলাকাছাড়া কুষ্টিয়া জেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক কমিটির এই সদস্য মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাড়ি এসেছিলেন।

শাকবরের স্ত্রী ও দৌলতপুর উপজেলা কৃষক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সুরাইয়া আক্তার কাজল আমার দেশকে বলেন, ওই রাতে পুরো বাড়ি ঘেরাও করে ঘুম থেকে শাকবরকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। কিছুক্ষণ পর পাশের বাড়ি গিয়ে তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার দিই। কান্নাকাটি করার সময় এসআই মাসুম বিল্লাহ ও শামসুল আলম আমার কাছ থেকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে শাকবরকে রেখে চলে যায়। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।

২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল কারাগারে মারা যান জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমএ শামীম আরজু। তিনি হৃদরোগের রোগী জানার পরও বিনা চিকিৎসায় তাকে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ করেন নিহতের পরিবারের সদস্যরা।

২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আওয়ামী সরকারের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে হরতাল ডেকেছিল জামায়াত। সেদিন ভোরে মিরপুর উপজেলার হালসায় পিকেটিং করার সময় ডাকাত বলে দুই শিবিরকর্মীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। নিহতরা হলেন উপজেলার বামনগাড়ী গ্রামের জানবার আলীর ছেলে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আল মুকিত তরুণ এবং অপরজন হালসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ও একই গ্রামের খবির উদ্দিনের ছেলে সবুজ আহমেদ।

গুমের শিকার তিন নেতা

২০১২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নিখোঁজ হন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আল ফিকহ্ অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়ালিউল্লাহ এবং আল হাদিস অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী আল মুকাদ্দাস।

তারা রাজধানীর কল্যাণপুর থেকে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন ইবিতে ফেরার জন্য। বাসটি রাতে সাভারের নবীনগর এলাকায় পৌঁছলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ৮-১০ ব্যক্তি বাস থেকে মুকাদ্দাস ও ওয়ালিউল্লাহকে নামিয়ে নেয়। এরপর তাদের আর কোনো খোঁজ মেলেনি।

২০১৬ সালের ১ মে রাতে কুষ্টিয়া শহরের কুমারগাড়া স্কুলপাড়া জামে মসজিদ থেকে গুম হন ওই মসজিদের ইমাম একেএম রকিবুল ইসলাম। প্রায় এক বছর গুম রাখার পর চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার দেখানো হয় তাকে।

এছাড়া ২০১৭ সালে কুষ্টিয়া শহর ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান পলাশকে কোর্ট চত্বর থেকে ধরে নিয়ে দুদিন গুম করে রাখে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছিল।

ভুক্তভোগী ইমাম রকিবুল আমার দেশকে বলেন, ২০১৬ সালে আমি কুষ্টিয়া শহরের মঙ্গলবাড়িয়া বাজার এলাকার আশরাফুল উলুম মাদরাসার ছাত্র ছিলাম। ইসলামী সংগীতের শিল্পীগোষ্ঠী জাগরণের পরিচালক ছিলাম। পাশাপাশি শহরের কুমারগাড়া স্কুলপাড়া জামে মসজিদে ইমামতি করছিলাম। ২০১৬ সালের ১ মে রাতে আমাকে মসজিদ থেকে তুলে নিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকার একটি ভবনে ৫২ দিন রাখা হয়। এরপর আরেক জায়গায় ৪২ দিন রাখে। তৃতীয় ধাপে র‌্যাব-৪-এর আয়নাঘরে ছয় মাস রাখার পর আমাকে ঝিনাইদহে আনা হয়।

তিনি আরো বলেন, পরদিন যশোর হয়ে খুলনায় নিয়ে র‌্যাব অফিসের টয়লেটে ৫২ ঘণ্টা রেখেছিল। পরে ঝিনাইদহে এনে আমার সঙ্গে আরেকজনকে নিয়ে গভীর রাতে চুয়াডাঙ্গা জেলার কার্পাসডাঙ্গা বাজার থেকে গ্রেপ্তার দেখায়। পরদিন বিভিন্ন বইপুস্তক ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার দেখিয়ে দামুড়হুদা থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব-৬। গুম রাখার সময় দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো।

সাংবাদিক নির্যাতন

২০১৮ সালের ২২ জুলাই একটি মামলায় জামিন নিতে কুষ্টিয়ার আদালতে আসেন আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। আদালত চত্বরে হত্যার উদ্দেশ্যে তার ওপর ভয়াবহ হামলা চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

এছাড়া হানিফের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় ২০১৬ সালের ৮ জুন কালের কণ্ঠের কুষ্টিয়া অফিসে ভাঙচুর করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। কুষ্টিয়া ছাড়েন পত্রিকাটির সাংবাদিক তারিকুল হক তারিক। এছাড়া জেল খেটেছেন বাংলাভিশনের জেলা প্রতিনিধি হাসান আলী, যুগান্তরের প্রতিনিধি এএম জুবায়েদ রিপন, স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক আসলাম আলী, শাহিন আহম্মেদ জুয়েল, সনি আযিমসহ অনেকে।

২০২২ সালের ৩ জুলাই রাতে কুষ্টিয়া শহরের সিঙ্গার মোড় এলাকা থেকে নিখোঁজ হন সাংবাদিক হাসিবুর রহমান রুবেল। পরে ৭ জুলাই দুপুরে কুমারখালী পৌরসভার তেবাড়িয়া এলাকায় নির্মাণাধীন সেতুর নিচে গড়াই নদী থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার হয়।

অপরদিকে ২০১৩ সালে স্থানীয় দৈনিক হাওয়া পত্রিকা অফিসে যুবলীগ ক্যাডার জিয়াউল ইসলাম স্বপনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। ২০১৬ সালের ৩১ মার্চ স্থানীয় দৈনিক আন্দোলনের বাজার পত্রিকা অফিসে ছাত্রলীগ ক্যাডার ইয়াসির আরাফাত তুষারের নেতৃত্বে হামলা করে সন্ত্রাসীরা।

জঙ্গি নাটক

২০১৭ সালের ১ জুলাই গভীর রাতে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা শহরের বামনপাড়া এলাকার একটি টিনশেড বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা বলে অভিযান চালায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও জেলা পুলিশ। ২১ ঘণ্টার এই নাটক শেষে ওই বাড়ি থেকে তিন নারীসহ দুই শিশুকে থানায় নেওয়া হয়। একটি পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিন, দুটি সুইসাইডাল ভেস্টসহ বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধারের দাবি করা হয়। পরে বাড়ির মালিককেও থানায় নেওয়া হয়।

পরদিন আটক তিন নারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এবং বাড়ির মালিককে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সে সময় জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তাররা হলেনÑ ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া ভেড়ামারা উপজেলার ঠাকুর দৌলতপুর গ্রামের আরমান আলীর স্ত্রী টলি খাতুন, রাঙামাটির বাসিন্দা কথিত নব্য জেএমবি আমির আইয়ুব বাচ্চু ওরফে সাজিদ হাসানের স্ত্রী আশরাদী জাহান তিথী, কথিত সংগঠনটির আর্চার রাজিকুল ওরফে তালহার স্ত্রী মাহমুদা খাতুন সুমাইয়া।

জুলাইয়ে শহীদ ১৫ ছাত্র-জনতা

চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় শহীদ হন আটজন। তারা হলেনÑকিশোর আবদুল্লাহ আল মুস্তাকিন, ইউছুফ শেখ, সুরুজ আলী, আশরাফুল ইসলাম, কিশোর মো. উসামা, বাবলু ফারাজী, কিশোর মাহিম হোসেন ও মো. সবুজ। এছাড়া জেলার বাইরে কুষ্টিয়ার সাতজন শহীদ হন। তাদের মধ্যে ঢাকার রামপুরায় আলমগীর সেখ ও মারুফ হোসেন, সাভারে জামাল উদ্দিন শেখ ও শাইখ আস হাবুল ইয়ামিন (হত্যার পর লাশ সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেয় পুলিশ), নারায়ণগঞ্জে আবদুস সালাম ও সেলিম মণ্ডল এবং ঢাকার মুগদায় মোহম্মদ জুবায়ের আহমাদ। পাশাপাশি গণঅভ্যুত্থানে কুষ্টিয়ায় আহত হন ৫৯১ জন।

হানিফের অরাজকতা

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন হানিফ। তার মেজো ভাই রাশিদুল আলম শেখ পরিবারের জামাতা। সব মিলিয়ে তাদের দাপট ছিল জেলার সর্বত্র। নিয়োগবাণিজ্য, দখল-চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে রকেট গতিতে বেড়েছে তাদের সম্পদ। হানিফ উপজেলার সামান্য নেতা থেকে এক লাফে হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। কানাডার নাগরিকত্বের তথ্য গোপন করে ভোট চুরির মাধ্যমে ২০১৪ সাল থেকে কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে পরপর তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন হানিফ। এ পদ তার জন্য হয়ে ওঠে আলাদিনের চেরাগ। দেড় দশকের আওয়ামী দুঃশাসনে তিনি হয়ে ওঠেন মহাক্ষমতাধর, পাশাপাশি গড়ে তোলেন সম্পদের পাহাড়। কুষ্টিয়া ছাড়াও রাজধানী ও ঢাকার বাইরে অন্তত চার জেলায় তার সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য আছে বলে জানা গেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আত্মীয় আর পদকে পুঁজি করে সারা দেশে তৈরি করেন নিজস্ব নেটওয়ার্ক। বাগিয়ে নেন বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য। ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে চাটুকার আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে গড়ে তোলেন দলীয় সিন্ডিকেট। কুষ্টিয়াকে পরিণত করেন হানিফ সাম্রাজ্য। গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন জুলাই গণহত্যার এই দোসর।

নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড়

শেখ পরিবারের আত্মীয় ও দলের শীর্ষপদ পাওয়ার পরই হানিফের কাছে লোকজনের আনাগোনা বাড়তে থাকে। এতে খুলে যায় কপাল। দলের পদ-পদবি পাওয়ার জন্য অনেকেই ছুটে আসতেন তার কাছে। এছাড়া ঢাকাকেন্দ্রিক বিভিন্ন কাজের তদবিরও করতেন হানিফ। দলের পদ-পদবি দেওয়ার নামে যেমন অর্থবাণিজ্য করেছেন, তেমনি বিভিন্ন তদবির, টেন্ডারবাণিজ্য এবং বড় বড় কাজ বাগিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।

হানিফের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম কোয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল। প্রথমে কারওয়ান বাজারের টিসিবি ভবনে, এরপর পুলিশ প্লাজায় এবং বর্তমানে কারওয়ান বাজারের বিটিএমসি ভবনে তার ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক অফিস। ওই অফিস ও কুষ্টিয়ার বাসায় বসেই সবকিছু একহাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন হানিফ। সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে হানিফ তার হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেন। স্ত্রীর নামে কুষ্টিয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইসেন্স নেন।

সর্বশেষ কুষ্টিয়ার মিরপুর ও ভেড়ামারায় পদ্মা নদী শাসনের জন্য এক হাজার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস হয়। কাজ ভাগাভাগি হয় হানিফের ঢাকা অফিসে। সেখানে হানিফ একাই ৫০০ কোটি টাকার কাজ নিজের কবজায় নেন। এ প্রকল্প থেকে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি।

আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন হানিফ। এসব টাকার বড় অংশ পাচার করেছেন কানাডাসহ কয়েকটি দেশে। দেশে কয়েকটি বড় কোম্পানির সঙ্গে বেনামে হানিফের ব্যবসা আছে। এর মধ্যে স্পেক্ট্রা লিমিটেড অন্যতম। কাগজে-কলমে না থাকলেও এ কোম্পানির সঙ্গে হানিফের পার্টনারশিপ আছে। এছাড়া গাজীপুরে পার্টনারে রিসোর্ট, কক্সবাজারে জমিসহ সম্পদের খবর পাওয়া গেছে।

কুষ্টিয়ায় হানিফের ভাই আতার যে মার্কেট, দোকান ও শপিংমলে দোকান আছে, সেগুলো দুজনের অর্থে কেনা বলে জানা গেছে। জেলা পরিষদ অফিস সূত্র জানায়, তাদের নতুন দুটি দোকান নেওয়া আছে কোটি টাকায়। তমিজ উদ্দিন মার্কেট কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক জানান, খেলার মাঠের পশ্চিম পাশে নতুন যে মার্কেট হয়েছে, সেখানে আটটি দোকান আছে তাদের নামে। জেলা পরিষদের বটতৈল এলাকায় যে দোকান আছে, সেখানে ১২টি দোকানের খোঁজ পাওয়া গেছে। সব দোকান ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিন বলেন, মার্কেট নির্মাণ করার পর এখানে হানিফ তার ভাইয়ের নামে ১২টি দোকান নেন। এসব দোকান থেকে মাসে লাখ টাকার বেশি ভাড়া ওঠে। শহরের বহুতল বিপণিবিতান পরিমল টাওয়ারেও একাধিক দোকান আছে।

রাজধানীর গুলশানে তার বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, সম্পত্তি আছে বনানীতেও। এছাড়া খুলনায় তার মাছের ঘেরের সঙ্গে আছে রিসোর্ট। জমি আছে পাবনার ঈশ্বরদী ও কক্সবাজারের টেকনাফে। পার্টনারে গাজীপুরে নির্মাণ করেছেন একাধিক রিসোর্ট। দুবাই, কানাডা, আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশে তার ব্যবসায় বিনিয়োগ আছে বলেও একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। কুষ্টিয়ার এক ব্যবসায়ী ও এক ব্যারিস্টার তার টাকা পাচারে সহযোগিতা করেছেন বলে কানাঘুষা আছে। কক্সবাজারের টেকনাফের আলোচিত সাবেক এমপি বদির সঙ্গেও হানিফের ব্যবসা আছে বলে জানা গেছে।

হাসানুল হক ইনুর অপকর্ম

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হলেও আওয়ামী লীগের আশীর্বাদে এমপি ও তথ্যমন্ত্রী হন হাসানুল হক ইনু। এতেই তিনি নতুন দানবে পরিণত হন। তার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও কথাবার্তায় বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল স্থানীয় রাজনীতি। বিরোধী মত দমনে হানিফের পরই ছিল তার নাম। তার বিরুদ্ধেও দখল, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির বহু অভিযোগ আছে।

রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় দখল ফ্যাসিস্ট হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইনুর অন্যতম অপকর্ম। ইসলামবিদ্বেষী এই বাম নেতা কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হন। সেটাও আবার আজীবন। প্রতিষ্ঠানটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য বানান নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ন্ত্রণে রাখেন ইনু।

কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের আমির মাওলানা আবুল হাসেম আমার দেশকে বলেন, গত ১৬ বছর আওয়ামী লীগ পুরোপুরি স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ চালিয়েছে। জামায়াতসহ সব বিরোধী দল, এমনকি আওয়ামী লীগের কিছু লোকও শেখ হাসিনা ও তার কিছু নেতার বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি। এর একমাত্র কারণ হাসিনা একক নেতৃত্বে দেশ চালান। তাদের দুঃশাসনে আমাদের অনেক নেতাকর্মী গুম-খুনের শিকার হয়েছেন।

কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কুতুব উদ্দিন আহমেদ আমার দেশকে বলেন, স্বৈরাচারী হাসিনা গত ১৬ বছরে বাংলাদেশকে ফ্যসিবাদী রাষ্ট্র বানিয়ে একক হাতে শোষণ করেন। মামলা-হামলা ও জেল-জুলুমের মাধ্যমে বিরোধী মতকে দমন করেছেন। তার সরকারের সময় দেশের মানুষের সঙ্গে আমরা কুষ্টিয়াবাসীও মজলুম ছিলাম।