Image description

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি কৌশল ঠিক করেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে অংশ নেয়। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তাবগুলোতে একমত হওয়া-না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

কৌশলের অংশ হিসেবে শেষ সময়ের সংলাপে ঐকমত্যের জন্য মৌলিক সংস্কারের বিষয়েও ছাড় দেয় তারা। তবে সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে দলীয় অবস্থানে অনড় থেকে সরকার ও দলগুলোর ওপর চাপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়; করেনি স্বাক্ষরও। এতে সরকার নমনীয় হলেও তাদের পদক্ষেপের আশায় আছে এনসিপি।

সংস্কার টেকসই করতে আইনগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো এবং সুনির্দিষ্ট রূপরেখায় রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নিশ্চিত করার কথা বলছে এনসিপি। এ জন্য বহুল কাঙ্ক্ষিত জুলাই সনদে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ২৪ রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করলেও অনুষ্ঠানেই যাননি তরুণদের কোনো প্রতিনিধি। আমন্ত্রিত ৩০ দল ও জোটের মধ্যে বাংলাদেশ জাসদ, সিপিবি, বাসদ ও বাসদ মার্কসবাদী দল সনদে স্বাক্ষর করেনি। এছাড়া শুক্রবার জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজার অনুষ্ঠানে অংশ নিলেও স্বাক্ষর করেনি গণফোরাম। গতকাল শনিবার কমিশন জানায়, সনদে রোববার (আজ) স্বাক্ষর করবে দলটি। এখন বাকি আছে এনসিপির স্বাক্ষর করা; সেটিও দ্রুত হওয়ার উপায় খুঁজছে কমিশন।

তরুণদের দলটির এমন অবস্থানে শেষ মুহূর্তে এসে টনক নড়ে সরকারের। নড়েচড়ে বসে রাজনৈতিক দলগুলোও। এ কারণে পরে জানানো হয়, সনদে স্বাক্ষর পরেও করা যাবে। এমনকি সনদ বাস্তবায়নের সুরাহা করতে বাড়ানো হয় কমিশনের মেয়াদও। এটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে এনসিপি। সে কারণে কঠোর কোনো কর্মসূচি না দিয়ে নমনীয় হয়েছে দলটি।

অন্যদিকে সরকারও এনসিপির প্রতি নমনীয়তা দেখাচ্ছে। যদিও দলটির অনেক নেতার বক্তব্য-বিবৃতিতে বিরক্তি রয়েছে সরকারের। তবে জুলাই সনদে সম্পৃক্ত করতে একাধিক বিকল্প চিন্তা করা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে ঐকমত্য কমিশনকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ফলে অনানুষ্ঠানিক আলাপের পাশাপাশি শিগগির এনসিপির সঙ্গে কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে বসবে বলে জানা গেছে। এতে ইতিবাচক ঘোষণা আসতে পারে। এর মধ্য দিয়ে জুলাই সনদ পূর্ণতা পাবে এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

এনসিপির শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা আমার দেশকে বলেন, গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রনেতাদের দল এনসিপি। ফলে জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল তারাই। সেটি যেনতেনভাবে নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ নিয়ে গুরুতর আপত্তি ও ক্ষোভ থাকলেও ওই অনুষ্ঠানে শামিল হয়েছিল এনসিপি। আবার জুলাই সনদ প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংলাপে গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রস্তাবে ছাড় দিয়ে একমত হয়েছে তারা। এখন বাস্তবায়নই হলো সনদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা রেখে এতে সই করতে পারে না এনসিপি। ঘোষণাপত্রের মতো সনদের ক্ষেত্রেও যেন জাতিকে প্রতারিত করা না হয়, সেজন্য কৌশলী অবস্থান নিয়েছে দলটি।

এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন আমার দেশকে বলেন, সংস্কার প্রশ্নে আমরা কৌশলে এগিয়েছি, ঐকমত্যে আসার চেষ্টা করেছি। নতুন সংবিধান, গণপরিষদসহ মৌলিক সংস্কারের ক্ষেত্রেও আমরা ছাড় দিয়েছি। কিন্তু আমরা জনআকাঙ্ক্ষার জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে আর ছাড় দেব না। কারণ, সনদ একটি জাতীয় দলিল। এটা শুধু এনসিপির বিষয় নয়, জনগণের ভবিষ্যতের প্রশ্নও। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহী হয়েছে, তাদের হতাশ করেছে জুলাই ঘোষণাপত্র। জুলাই সনদেও যাতে একই অবস্থা না হয়, সে জন্য বাস্তবায়নের ব্যাপারে চাপ তৈরি করেছে এনসিপি। শুরু থেকে আমরা এটাই বলে এসেছি।

সূত্রমতে, এই কৌশলের অংশ হিসেবে সনদের আইনি ভিত্তির আদেশের টেক্সট এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখার বিষয়টি সামনে আনা হয়। এটি নিশ্চিত না হয়ে সনদে সই না করার সিদ্ধান্ত জানানো হয় অনুষ্ঠানের আগের দিন সংবাদ সম্মেলন করে। এরপর সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে নানা তৎপরতার মাধ্যমে এনসিপিকে আশ্বস্ত করে অনুষ্ঠানে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ ক্ষেত্রে আগে থেকেই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি ও রূপরেখা দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসা, বাস্তবায়নে গণভোটের বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ার পরও আদেশ না দিয়ে সনদ স্বাক্ষরের দিকে সরকারের এগোনো নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয় এনসিপিতে। সে কারণে আশ্বাসের পরও আগের সিদ্ধান্তে অটল থাকে দলটি। এর মাধ্যমে সরকার ও দলগুলোকে একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে।

এনসিপি নেতারা বলছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের দাবি জানিয়ে আসছিলেন গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতারা। সেটি যেভাবে চেয়েছিলেন তারা, সেভাবে হয়নি। ঘোষণাপত্র নিয়ে এনসিপি অনেক বেশি সোচ্চার থাকলেও যেভাবে হয়েছেÑতার সুফল পেয়েছে অন্যান্য রাজনৈতিক দল। সংস্কারের জুলাই সনদও যেন সেভাবে না হয়, সে ব্যাপারে সংলাপ থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে সতর্ক ছিল এনসিপি।

এর পেছনে আরো কিছু বিষয় আছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑমৌলিক সংস্কার টেকসই করতে আইনগত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো এবং স্থায়িত্ব দেওয়া, বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ব্যবস্থা গড়তে সব রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার করা, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রশ্নে ছাড় না দেওয়া এবং পাহারাদার হওয়া, জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আপসহীন থাকার বিষয়টি স্পষ্ট করা। এ ছাড়াও গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা, জুলাই শক্তির রাজনৈতিক নেতৃত্ব হিসেবে জনগণের আস্থা অর্জন, নতুন দলের নতুন রাজনীতির ভবিষ্যৎ মসৃণ হওয়া, জুলাইর জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রকৃত অর্থেই প্রতিষ্ঠা, নব্বইয়ের ছাত্রনেতাদের মতো হারিয়ে না গিয়ে প্রভাব বিস্তারকারী অবস্থানে থাকা, জেনারেশনের রাজনৈতিক লড়াইয়ে বিজয়ী হওয়া, আগের ব্যবস্থার বিপরীতে নতুন ব্যবস্থার স্থায়ী রূপান্তর।

এনসিপি নেতাদের মতে, তাদের দলীয় নীতি হচ্ছে জুলাই স্পিরিট ধারণ করা এবং জুলাই স্পিরিটের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যেন জুলাই থেকে সরে না যেতে পারে, সেজন্য রাজনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখা। রাজনীতি থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের চেতনা যেভাবে হারিয়ে গেছে, তার বিপরীতে শেখ হাসিনার মতো ফ্যাসিস্টের জন্ম হয়েছেÑসেখান থেকে এমন শিক্ষা নিয়েছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকারীরা।

এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার আমার দেশকে বলেন, যেসব বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে ঐকমত্য হয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করেই জুলাই সনদ করা হয়েছে। নিজেদের অবস্থান থেকে অনেক ছাড় দিয়ে এতে সম্মত হয়েছে এনসিপি। কিন্তু সনদের আইনি ভিত্তির আদেশ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা না দিয়ে এতে স্বাক্ষর করতে বলা হলো। গণঅভ্যুত্থানের দল হিসেবে এনসিপি এতে সই করতে পারে না। সেজন্যই আগে আদেশ ও রূপরেখার সমাধান হোক, তারপর স্বাক্ষর করা হবে। সেটি আমরা স্পষ্ট করেই বলেছি। এখন সরকার ও ঐকমত্য কমিশন কি করে, তা দেখব আমরা।

রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ এক বছর ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কাজ করে জুলাই সনদ এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রশ্নে একমত হয়েছে। জুলাই সনদ আদেশ, এরপর গণভোট ও সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনে সক্ষম গঠনিক ক্ষমতাসম্পন্ন আগামী সংসদ (দ্বৈত ভূমিকা)—এ প্রক্রিয়ায় সনদ বাস্তবায়ন হবে। এ ব্যাপারে সব দল একমত হয়েছে। অথচ সনদের অঙ্গীকারনামায় বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ নেই। এনসিপি মনে করে, বাস্তবায়ন পদ্ধতির উল্লেখ ছাড়া সনদে স্বাক্ষর করা জনগণের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। কারণ, অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের করা প্রতিশ্রুতি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে।

গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই সনদের স্বাক্ষর কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা বা চাওয়ার কোনো প্রতিফলন স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ঘটেনি। এরপরও আইনি ভিত্তি না থাকলে এটা জনগণের সঙ্গে একটা প্রতারণা হবে। জুলাই সনদের কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। এ সনদে স্বাক্ষর করা কেবল লোক দেখানো এবং জুলাইয়ের সঙ্গে প্রতারণার শামিল।

নাহিদ আরো বলেন, ঐকমত্য কমিশন আলোচনার জন্য ডাকলে এনসিপি সাড়া দেবে। তবে নোট অব ডিসেন্টের বা ভিন্নমতের সঙ্গে জুলাই সনদের কোনো সম্পর্ক নেই।

ঐকমত্য কমিশনের একটি সূত্র জানায়, জুলাই সনদে স্বাক্ষরের বিষয়ে এনসিপির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। শিগগির তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা হবে এবং ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসবে বলে কমিশন আশাবাদী। একইসঙ্গে সনদ বাস্তবায়নের একাধিক বিকল্প উপায় নিয়েও ভাবছে সরকার।