Image description

বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত বৃহত্তর নোয়াখালী। এর মধ্যে অন্যতম ভূখণ্ড লক্ষ্মীপুর। এ জেলার অনেক নেতাই বিভিন্ন দলের জাতীয় পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেই জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিদের গুম, খুন ও জুলুমের রাজনীতিতে নামে। প্রতিষ্ঠা করতে থাকে একচ্ছত্র আধিপত্য। এতে গা ভাসায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও। দেড় দশক ধরে চলে নিপীড়ন-নির্যাতন।

রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মীকে রাজপথ, এমনকি ঘর-বাড়ি থেকে উৎখাতের কর্মসূচি নিয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। দলটির নেতাকর্মীর সঙ্গে ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের ক্যাডাররা কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব। তাদের অপকর্মে সহায়তা করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।

আওয়ামী আমলে বিএনপি-জামায়াতের অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়। হামলা-মামলা, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার ব্যক্তি। ১ হাজার ৩৩ মামলায় আসামি করা হয়েছে ২৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। এছাড়া গুম করা হয়েছে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ওমর ফারুকসহ সাতজনকে। ভৌগলিকভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছে লক্ষ্মীপুর। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত হওয়ায় উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে এ জেলা। উল্টো উন্নয়নের নামে করা হয়েছে লুটপাট।

র‌্যাবের কিলিং মিশন

লক্ষ্মীপুর জেলাজুড়ে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল আওয়ামী সরকার। তীব্র আন্দোলনে সারা দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আন্দোলন দমাতে কিলিং মিশন শুরু করেন র‌্যাবের দলবাজ কর্মকর্তারা। এতে নেতৃত্ব দেন র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ। তার নেতৃত্বে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর ভোরে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাহাবুদ্দিন সাবুর বাসভবনে ঢুকে তাকে হত্যার উদ্দেশে গুলি করে। তার ডান পায়ের ঊরুতে গুলি লাগে।

খবরটি মুহূর্তেই শহরে ছড়িয়ে পড়লে নেতাকর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় সন্ত্রাসী স্টাইলে নির্বিচারে গুলি চালান র‌্যাব সদস্যরা। তাদের গুলিতে নিহত হন বিএনপি নেতা মাহবুব হোসেন, যুবদলকর্মী শিহাব ও সুমন। হত্যার পর গুম করা হয় জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল মাহমুদ জুয়েলের লাশ। আজও সেই মরদেহের অপেক্ষায় আছে জুয়েলের পরিবার। কোনোভাবে বেঁচে ফেরেন সাহাবুদ্দিন সাবু। ওইদিন র‌্যাবের গুলিতে আহত হন অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। কেউ পা হারিয়েছেন, কেউ হারিয়েছেন চোখ। তাদের মধ্যে এক ছাত্রনেতা নেছার উদ্দিন। এখনো বয়ে বেড়ান সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দুঃসহ স্মৃতি। হারিয়েছেন একটি পা।

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাহাবুদ্দিন সাবু বলেন, ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর আমার বাড়িতে যে ঘটনা ঘটে, তার আগ থেকেই আমরা আন্দোলন-সংগ্রাম করছিলাম। বিভিন্ন কর্মসূচি যথাসময় পালন করতাম। আন্দোলন দমাতে তৎকালীন জেলা প্রশাসক তাহের বাহিনীর সঙ্গে গোপন বৈঠক করে। আমাকে হত্যা ও গুম করার জন্য র‌্যাবকে নির্দেশ দেয়। র‌্যাব ভোরবেলায় এসে আমার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে আমাকে গুলি করে। পরে আমাকে থানায় রেখে আসে। সেখান থেকে আমি পালিয়ে জীবন বাঁচাই। এরপর ৪-৫ বছর লুকিয়ে থাকতে হয়েছে।

একই বছরের ১৩ ডিসেম্বর রাতে তারেক সাঈদের নেতৃত্বে র‌্যাব সদস্যরা হানা দেন জনপ্রিয় চিকিৎসক ও জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ফয়েজ আহমেদের উত্তর তেমুহনী এলাকার বাসায়। ডা. ফয়েজকে তার বাসার ছাদে নিয়ে পিটিয়ে, গুলি করে নিচে ফেলে হত্যা করা হয়। সেদিন তার ছোট ছেলে বেলাল আহমেদ বাসার ছাদের কার্নিশে লুকিয়ে বেঁচে যান। সেখান থেকে দেখেন তার বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যার বীভৎস চিত্র।

সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিচারণ করে বেলাল আহমেদ বলেন, র‌্যাব সদস্যরা আমাদের বাসার লোহার গেট ভেঙে ফেলে। বাবাকে বাসার দোতলার কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে ভবনের ছাদে নিয়ে যায় তারা। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সদস্যরা ভবনে ঢুকে সব কক্ষের দরজার তালা ভেঙে তল্লাশি ও ভাঙচুর চালায়। পরে বাবাকে ছাদে নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্রের বাঁট দিয়ে মাথা ও নাক, মুখসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। একপর্যায়ে গুলি করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাকে তিন তলার ছাদ থেকে উপুড় করে ফেলে দেয়। পরে তার লাশ সদর হাসপাতালে রেখে যায় তারা।

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সেদিন আমি বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে। এরপর থেকে দীর্ঘদিন পলাতক ছিলাম। কোথাও অভিযোগও করতে পারিনি। পটপরিবর্তনের পর আমার বড় ভাই হাসানুল বান্না ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪১ জনের নামে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন। আমরা হাসিনাসহ তার সহযোগীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

বিএনপির ওপর হামলা-মামলা ও হত্যা

বিএনপির কর্মসূচি প্রতিহত করতে বিভিন্ন সময় হামলা করে আওয়ামী পুলিশ। ২০১১ সালের ২৯ জানুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দক্ষিণ তেমুহনী এলাকায় বিএনপির মিছিলে হামলা চালায় পুলিশ। এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন যুবদল নেতা রুবেল ও বিএনপি নেতা কাশেম। ২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শহরের গোডাউন রোডে পদযাত্রায় পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে তিন শতাধিক নেতাকর্মী গুলিবিদ্ধ হন। ওই কর্মসূচি থেকে কৃষকদল কর্মী সজিবকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা।

২০২২ সালের ২২ আগস্ট শহরের গোডাউন রোডে বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানির বাসভবন ভাঙচুর করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। এর আগে ১২ আগস্ট হামলা ও ভাঙচুর করা হয় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাহাবুদ্দিন সাবুর বাসভবন। এছাড়া কমলনগরে সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিনের বাড়িতে ভাঙচুর করা হয়।

গায়েবি মামলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের হয়রানি ছিল আওয়ামী লীগের বড় অস্ত্র। প্রায় ৪৫০টি মামলায় ১৫ হাজার নেতাকর্মীকে হয়রানি ও কারাগারে পাঠানো হয়। তাদের মধ্যে একজন সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা লোকমান হোসেন। তাকে ৩২টি মিথ্যা মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে তিনি চার দফায় দুই বছরের মতো কারাবরণ করেন। তার বিরুদ্ধে এখনো তিনটি মামলা আছে।

অন্যদিকে নেতাকর্মীদের নামে এখনো প্রায় ১৫০টির মতো মামলা চলমান রয়েছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে হয়রানি করার জন্য বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, আশরাফ উদ্দিনদের বিরুদ্ধেও মামলা দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার করা হয় বিভিন্ন সময়ে। বাদ যাননি জেলা বিএনপির সদস্য সচিব সাহাবুদ্দিন সাবু, অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমানসহ শীর্ষ নেতারা।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড

রাজনৈতিকভাবে বিএনপি-জামায়াতকে মোকাবিলা করতে না পেরে আওয়ামী লীগ আশ্রয় নেয় গুম-খুনের। ব্যবহার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। শুরু হয় গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হাজিরপাড়া ইউনিয়নের জনপ্রিয় চেয়ারম্যান ওমর ফারুককে। এছাড়া ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর হাজিরপাড়া ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক বেলাল হোসেনকে তুলে নেওয়া হয়। এরপর আর তার সন্ধান পায়নি পরিবার। এছাড়া গুমের শিকার হয়েছেন বিএনপি কর্মী আলমগীর, কাদের, রাজুসহ পাঁচ নেতাকর্মী।

গুম হওয়া ওমর ফারুকের ছেলে ও ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের জেলা সভাপতি ইমন ওমর বলেন, সরকারের কাছে বারবার দাবি জানিয়েও কোনো বিচার পাইনি। গুমের শিকার মানুষগুলোর কোনো হদিস পাইনি। স্বৈরাচার বিদায়ের পর আশা করেও গুমের শিকার লোকজনের সন্ধান পাইনি। গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচার চেয়েছি, সেটাও পাইনি। যারা গুম-খুনের সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে ২০১২-১৬ সালে পুলিশ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়। ছাত্রদল নেতা সোলেমান উদ্দিন জিসান, দিঘলী ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবুল, সামছুল ইসলাম সোলেমান, যুবদল নেতা আবদুল মন্নান, সুমন, বিএনপি নেতা বেলাল, দিদার, মনির ও সাবেক শিবিরকর্মী মাসুম বিল্লাহসহ অনেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

হামলা-মামলা-নির্যাতনের শিকার জামায়াত

আওয়ামী লীগের জুলুম-নির্যাতনে জর্জরিত জামায়াত নেতাকর্মীরা। আওয়ামী সন্ত্রাসী ও দলবাজ পুলিশ সদস্যদের দায়ের করা ৫৮৩টি মামলায় ১২ হাজার জামায়াত নেতাকর্মীকে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। ৩৬ বছর ধরে শিক্ষকতা করা জেলা জামায়াতের আমির বীর মুক্তিযোদ্ধা এসইউএম রুহুল আমিন ভূঁইয়াকে ২০১৭ সালের ২৫ জুলাই গায়েবি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে আদালতে তোলা হয়। এ ঘটনায় নেতাকর্মীরা চরম বিক্ষুব্ধ হন।

আওয়ামী দুঃশাসনের নির্যাতনের শিকার হন সহস্রাধিক নেতাকর্মী। এখনো ৮৭টি মামলা বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তাদের মধ্যে অন্যতম কমলনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক নির্বাচিত ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা হুমায়ুন কবির। তৎকালীন আওয়ামী লীগের এমপি আবদুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশে ৬৭টি মামলায় তাকে আসামি করা হয়। বার বার কারাবরণ শেষে এখনো তার বিরুদ্ধে ১২ মামলা রয়েছে। এছাড়া কমলনগরে জামায়াত নেতা ইউসুফ, আবদুল আহাদ, কামালকে আসামি করা হয়েছিল ৫০টিরও অধিক মামলায়।

রামগঞ্জ জামায়াত নেতা শামছুল আলম নিপ্পন, সাইফুল, চন্দ্রগঞ্জের ব্যবসায়ী জাকির হোসেনসহ অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে আছে অর্ধশতাধিক মামলা। অসংখ্য নেতাকর্মীর বাড়ি-ঘর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। রামগঞ্জের জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুল আজিজের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সন্ত্রাসীরা। কমলনগর জামায়াত নেতা কামালের ঘরে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয়। রামগঞ্জের শেখ ফরিদের বাড়িরও একই হাল করে তারা।

ভাঙচুর করা হয়েছে রায়পুর, রামগঞ্জ, রামগতি, কমলনগর উপজেলা ও চন্দ্রগঞ্জ থানা জামায়াতের অফিস। এছাড়া বহু নেতাকর্মীর পরিবার জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে গত ১৭ বছরে আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে আহত হয়েছে প্রায় দুই হাজার নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে এখনো পঙ্গুত্ববরণ করে আছেন রায়পুর উপজেলার কেরোয়া ইউনিয়নের নাসির। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে আন্দোলনের সময় রায়পুর বর্ডার বাজারে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। ব্রেনে গুলি লাগায় এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। নাসিরের মতো ওইদিন আহত হন শিবিরকর্মী হাফেজ মাহবুব, আরিফসহ ১৫-২০ জন নেতাকর্মী।

জুলাই আন্দোলনে ৪ শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যা

গত বছরের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন প্রতিহত করতে লক্ষ্মীপুরে সর্বপ্রথম ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর যুবলীগ ক্যাডার সালাহউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে হামলা করা হয়। পরে ৪ আগস্টও সন্ত্রাসী টিপুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র বাহিনী নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করে। তাদের হামলায় মাদাম ব্রিজে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় মেধাবী ছাত্র সাদ আল আফনান। পরে তমিজ মার্কেট এলাকায় টিপুর বাসার ছাদ থেকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয় কাউছার হোসেন বিজয়, ওসমান পাটোয়ারী এবং সাব্বির হোসেনকে। এ সময় গুলিবিদ্ধ ও আহত হয় দুই শতাধিক ছাত্র-জনতা। চার শিক্ষার্থী হত্যার বছর পূর্ণ হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে মূল আসামিরা। শুরু হয়নি বিচার। তাইতো উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন শহীদ পরিবারগুলো।

শহীদ সাদ আল আফনানের মা নাছিমা আক্তার বলেন, ‘আমার ছেলে শহীদ হয়েছে একটি নতুন বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমার ছেলের হত্যাকারীদের এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। সন্ত্রাসী টিপু এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের দাবি দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা শাখার সাবেক আহ্বায়ক আরমান হোসেন বলেন, লক্ষ্মীপুরে শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি হত্যা মামলা ও আহতদের পক্ষ থেকে তিনটি মামলা করা হয়েছে। এ পাঁচটি মামলায় এক হাজারের মতো এজাহারভুক্ত আসামি রয়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত রয়েছে দেড় থেকে দুই হাজার। আসামিদের গ্রেপ্তারের কোনো উদ্যোগ নেই। হামলায় জড়িত ১৫ শতাধিক আওয়ামী নেতাকর্মী গত বছরের ৪ আগস্ট আমাদের ওপর হামলা করে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাত্র দুই শতাধিককে। অথচ হামলাকারীদের অনেকেই দেশে রয়েছে, কেউ কেউ আবার বাড়িতে অবস্থান করছে। অতিদ্রুত তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি হোসাইন আহমেদ হেলাল বলেন, গত ১৭ বছর আইনের শাসন ছিল না। অকারণে ভুয়া মামলায় জেল খাটতে হয়েছে অনেককেই। সঠিক বিচার ছিল না। গুম-খুনের শিকার হয়েও থানায় সহযোগিতা মেলেনি। প্রকৃত অপরাধী নয়, এমন অনেকেই জেল খেটেছেন। পুলিশ বাদী হয়ে অনেক ভুয়া মামলা করেছে। ভিন্নমতের মানুষের অধিকার ছিল না। একতরফা দেশ পরিচালিত হয়েছে। চাকরির নামে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। জেলাজুড়ে প্রায় ২০-৩০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করা হয়েছে। বিরোধী মতের মানুষের মূল্য ছিল না। দীর্ঘ ১৭ বছর পর একটি জিম্মিদশা থেকে মানুষ মুক্তি পেয়েছে। এখন নতুন জীবন পেয়েছে, তাদের মনের কথা বলতে পারছে। ভবিষ্যতেও যেন এ ধারা অব্যাহত থাকে। নতুন করে যেন কেউ দুঃশাসন বাস্তবায়ন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মহসিন কবির মুরাদ বলেন, জামায়াত একটি মজলুম দল। বিগত স্বৈরাচার হাসিনার আমলে জামায়াত সবচেয়ে বেশি জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। জনপ্রিয় ডাক্তার ও জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. ফয়েজ আহমেদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা সব হত্যার বিচার এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাই।

জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট হাছিবুর রহমান হাছিব বলেন, বিগত ১৬-১৭ বছর আওয়ামী দুঃশাসনটা লক্ষ্মীপুরের বিএনপি নেতাকর্মীদের জন্য ছিল অত্যন্ত দুঃসহ। বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নিয়েছে। শত শত নেতাকর্মী কারাবরণ করেছে। আওয়ামী দুঃশাসনের সময় বিভিন্ন থানায় বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে সাড়ে চারশ’ মামলা হয়েছে। গুম-খুন করা হয়েছে অনেক নেতাকর্মীকে। পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অনেকেই।