দশম সংসদ নির্বাচনেও জামায়াতের হিসাবনিকাশ সঠিক ছিল না। প্রথমত নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে অত বেশি জোর দেয়া ঠিক হয়নি। জামায়াতের সঠিক সিদ্ধান্ত খালেদা জিয়ার কাছে না পৌঁছানো বা জামায়াতের সিদ্ধান্ত বুঝতে তার ভুল হওয়ার দায় জামায়াত এড়াতে পারে না। জামায়াতের সিদ্ধান্তের মূল কথা ছিল বিএনপিকে ছাড়া জামায়াত নির্বাচনে যাবে না। সহজ ভাষায় এ কথাটা খালেদা জিয়ার কাছে পৌঁছায়নি। যে কারণে তিনি ধারণা করেছেন, জামায়াত বিএনপিকে ছাড়াই নির্বাচনে চলে যাবে। দ্বিতীয়ত, ফরিদপুরে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলের আসন নিয়ে দরকষাকষি করা জামায়াতের একটি ভুল কাজ ছিল। কামাল ইবনে ইউসুফকেই সেই আসনটিতে মনোনয়ন দেয়া উচিত ছিল অর্থাৎ জামায়াতের উচিত ছিল সেই আসনটি ছেড়ে দিয়ে সম্ভাবনাময় কয়েকটি আসন নিয়ে দরকষাকষি করা। এতে মনে হয় বিএনপিও নমনীয় হতো। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ‘ফাঁসির সেল থেকে দেখা বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইতে এসব কথা লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনের মতো জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচন না করে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে নির্বাচনী অভিযানে সম্পৃক্ত থাকতেন, তাহলে ভালো হতো। ডিজিএফআইয়ের চক্রান্তও জামায়াত আঁচ করতে পারেনি। জামায়াতকে যে শূন্য আসনে নামানোর পরিকল্পনা করা হয়, তা জামায়াত বুঝতে পারেনি। ডিজিএফআই কার্যত জামায়াতকে ধোঁকা দিয়েছে খুব চাতুরীর সাথে। এখানে উল্লেখ্য যে, ডিজিএফআই কর্মকর্তারা কয়েক দফা জামায়াত নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে আস্থা লাভের চেষ্টা করেন এবং নির্বাচনের পক্ষে যাতে জামায়াত শক্তভাবে থাকে, এ ব্যাপারে জামায়াতকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেন। সরকার নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে, এমন ধারণা দিতে তারা সচেষ্ট ছিলেন। জামায়াত নিজে যেহেতু প্রতারণার রাজনীতি করে না, তাই অন্য কাউকেও সেভাবে সন্দেহ করে না। জামায়াতও ভাবতে থাকে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্যেই দেশের কল্যাণ রয়েছে।
জামায়াত আদৌ বুঝতেই পারেনি যে, একটি নীলনকশার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ফলে নির্বাচনে বড় ধরনের বিপর্যয় হলো। সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে শামসুল ইসলাম ও মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনে হামিদুর রহমান আযাদ- এই দুজন মাত্র বিজয়ী হন জামায়াত প্রার্থীদের মধ্য থেকে। আমি আগের নির্বাচন থেকে ৪৫ হাজার ভোট বেশি পাই। অথচ আমাকেও পরাজিত দেখানো হয়। সবই ছিল ডিজিএফআই ও ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারসাজি।
ওদিকে সারা দেশে বিএনপিকে মাত্র ৩০টি আসনে বিজয়ী দেখানো হয়। এ নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। খালেদা জিয়ার প্রতিটি জনসভায় ছিল লাখো জনতার ঢল। আমার নির্বাচনী এলাকাতেও নির্ধারিত সময়ের কয়েকঘণ্টা পর হাজির হওয়া সত্ত্বেও লক্ষাধিক মানুষ ধৈর্য ধরে বেগম জিয়ার বক্তব্য শোনেন। খালেদা জিয়ার আগমন পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেছেন এবং তার কথা না শুনে কেউ চলে যাননি। নির্বাচনে চার দলের পক্ষে ভালো জনমত থাকা সত্ত্বেও হাসিনা-মইন-এরশাদের আঁতাতের কারণে এবং আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থনের ফলে নির্বাচনের ফলাফলে সূক্ষ্মভাবে হস্তক্ষেপ করে শেখ হাসিনার বিপুল বিজয় নিশ্চিত করা হয়। বিএনপি মাত্র ৩০টি ও জামায়াত মাত্র দু’টি আসনে জয়ী হয়। এ বিস্ময়কর ফলাফলের ব্যাপারে খোদ আওয়ামী লীগ নেতারাই হতবাক হয়ে যান।’
কামারুজ্জামান আরও লিখেছেন, ‘এ নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা এতই অপ্রস্তুত ও হতবাক হয়ে যান যে, নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের ব্যাপারগুলো তারা মিডিয়া ও পর্যবেক্ষকদের সামনে তুলে ধরার কোনো উদ্যোগ নিতেও ব্যর্থ হন। প্রিজাইডিং অফিসারগণ প্রকৃত ফলাফল কীভাবে উল্টিয়ে দিয়েছিলেন, তার দৃষ্টান্ত ২০০৮-এর এই নবম সংসদ নির্বাচন।
দুই-তৃতীয়াংশ আসনে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের সরকার বহুমুখী কৌশল অবলম্বন করে। প্রশাসনকে অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ওসিকে ব্যবহার এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে রিটার্নিং অফিসার ও প্রিজাইডিং অফিসারদের ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত করা হয়। ওদিকে ডিজিএফআই নির্দিষ্টসংখ্যক নির্বাচনী আসনের অতিরিক্ত ব্যালট পেপার ছেপে তা নির্বাচনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাটা নিশ্চিত করে। ফলে কোনো কোনো নির্বাচনী আসনের ভোটকেন্দ্রে মাত্রাতিরিক্ত ভোট পড়ে। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের অনেক নিশ্চিত বিজয় লাভের মতো আসনে ৯০ থেকে শতভাগ এবং কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগেরও বেশি ভোট কাস্ট দেখানো হয়। অতিরিক্ত সতর্ক ব্যবস্থা নেয়া হয়, যাতে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়।’
কামারুজ্জামান লিখেছেন, ‘অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন হতে পারতো। আওয়ামী জোট টেনেটুনে ১৫০ আসনের বেশি পেলেও পেতে পারতো; কিন্তু বিএনপি মাত্র ৩০ এবং জামায়াত ২টি আসনে জয়লাভ করার মতো ফলাফল হতো না। হঠাৎ করে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগের দিকে এত বিপুলভাবে ঝুঁকে পড়েছে, এমন কোনো বড় কারণ ঘটেনি।’