
ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ার লমি হাজারী বাড়ির সামনে ছোট্ট একটি পুকুর। শানবাঁধানো ঘাট। আছে ছাউনি। স্থানীয় কয়েকজন সেখানে গোসল করছিলেন। পাশের মাঠে একজন ঝালমুড়ি বিক্রি করছিলেন। আরেকজন বিক্রি করছেন পেয়ারা ও জাম্বুরামাখা। এখানে এমন দৃশ্য ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে ছিল কল্পনাতীত।
যে পুকুরঘাটের কথা বলা হচ্ছে, সেটি ছিল ফেনী–২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজামউদ্দিন হাজারীর ‘ঘাটলা’। এখানে বসে ঠিকাদারি কাজ বণ্টন, বিভিন্ন খাতের চাঁদাবাজির হিসাব, দলীয় ও স্থানীয় বিবাদ মীমাংসাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করতেন তিনি। জেলার বিভিন্ন এলাকার নানা শ্রেণি–পেশার মানুষকে এই ঘাটলায় হাজিরা দিতে হতো। স্থানীয়ভাবে বলা হতো ‘ঘাটলার শাসন’।
পুকুরঘাটের পাশে সাততলা বাড়িটি নিজাম হাজারীর। এর একাংশ কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জেলা আওয়ামী লীগের এই নেতা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে অন্য অনেকের মতো নিজাম হাজারীও পালিয়ে যান। ওই দিন বিক্ষুব্ধ জনতা এই বাড়িসহ কাছাকাছি নিজামের আরও দুটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। বাড়ির গ্যারেজে পোড়া গাড়ি পড়ে আছে। এসব বাড়ি পেরিয়ে কিছু দূর এগোলে দেখা মেলে নিজাম হাজারীর আরেকটি বাড়ি। প্রাচীরঘেরা প্রায় সাড়ে চার একর জমির ওপর তৈরি তিনতলা বাড়িটি স্থাপত্যশৈলী, বিলাসবহুল সামগ্রী, লেক, বাগান ইত্যাদি কারণে ফেনীর মানুষের কাছে বেশ আলোচিত।
আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ফেনীতে এককভাবে ‘রাজত্ব’ করেছেন নিজাম হাজারী। মাস্টারপাড়ার পুকুরের ‘ঘাটলা’ থেকে নিজাম হাজারী অবৈধ উপার্জনের যে খাতগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর মধ্যে বাস, ট্রাক, টেম্পোস্ট্যান্ড, সরকারি নানা দপ্তরের দরপত্র, বালুমহাল, সীমান্তকেন্দ্রিক কালোবাজারি, মামলা–বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য।

গত বছরের ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ মানুষের হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িটি এখন জনমানবশূন্য। অথচ এই বাড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ প্রভাবশালী অনেকের যাতায়াত ছিল।
আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে ফেনীতে এককভাবে ‘রাজত্ব’ করেছেন নিজাম হাজারী। মাস্টারপাড়ার পুকুরের ‘ঘাটলা’ থেকে নিজাম হাজারী অবৈধ উপার্জনের যে খাতগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন, এর মধ্যে বাস, ট্রাক, টেম্পোস্ট্যান্ড, সরকারি নানা দপ্তরের দরপত্র, বালুমহাল, সীমান্তকেন্দ্রিক কালোবাজারি, মামলা–বাণিজ্য উল্লেখযোগ্য।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নিজাম হাজারী দলবল নিয়ে পালিয়েছেন। তাঁর সেই ঘাটলা এখন অনেকটা বিএনপির নেতাদের ঘরে ঘরে। এখানে বিএনপির কারও একক নিয়ন্ত্রণ নেই, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত দলটির নেতা–কর্মীরা। এর মধ্যে জেলাভিত্তিক মোটাদাগে চারটি গ্রুপ আলোচিত। তাঁদের ছায়ায় গড়ে উঠেছে কিছু উপদল। এর বাইরে উপজেলায় ছোট ছোট আরও গ্রুপ গড়ে উঠছে। জেলা বা কেন্দ্রীয় কমিটির কেউ না কেউ এসব গ্রুপকে ‘মুরব্বি’ হিসেবে প্রশ্রয় দেন।
ফেনী জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি মাঈন উদ্দিন আহমেদ কামরান প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি, দখল–বাণিজ্য, হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না জনগণ। আগে আওয়ামী লীগের নেতারা করতেন, এখন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা করছেন।
স্থানীয় রাজনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, নিজাম হাজারী দলবল নিয়ে পালিয়েছেন। তাঁর সেই ঘাটলা এখন অনেকটা বিএনপির নেতাদের ঘরে ঘরে। এখানে বিএনপির কারও একক নিয়ন্ত্রণ নেই, বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত দলটির নেতা–কর্মীরা।
কয়টি গ্রুপ, নেতা কারা
ফেনী জেলা বিএনপির শীর্ষ দুই পদে আছেন আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার ও সদস্যসচিব আলাল উদ্দিন। দলীয় নেতা–কর্মী বা ক্যাডারদের ওপর তাঁদের কার্যকর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সব দিক রক্ষা করে চলেন।
তবে জেলা বিএনপির তিন যুগ্ম আহ্বায়কের নেতৃত্বে তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। এর মধ্যে সাংগঠনিকভাবে প্রভাবশালী একটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিবুল্লাহ মানিক। এমন আরেকটি প্রভাবশালী গ্রুপের নেতা হচ্ছেন আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী। আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক এয়াকুব নবীও ছোট একটা গ্রুপ চালান।
আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য মশিউর রহমান (বিপ্লব)। ফেনী পৌর বিএনপির সদস্যসচিব মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া ও সদর উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আমান উদ্দিন কায়সার (সাব্বির) তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী।
জেলা যুবদলের আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন খন্দকার ও জেলা ছাত্রদলের সভাপতি সালাহউদ্দিন মামুনের নেতৃত্বে দুটি উপ–গ্রুপ রয়েছে।
এর বাইরে প্রতিটি উপজেলাভিত্তিক গ্রুপ রয়েছে। যেমন পরশুরামে সীমান্তকেন্দ্রিক অবৈধ কারবার আগে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ওরফে সাজেল নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেসব কর্মকাণ্ড এখন বিএনপির নেতা আবদুল আলিম মাকসুদের নিয়ন্ত্রণে। মাকসুদ বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু তালেবের অনুসারী। দাগনভূঞায় বহিষ্কৃত ছাত্রদল নেতা কাজী জামশেদুর রহমান ফটিক ও সোনাগাজীতে উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক খোরশেদ আলম ভূঁইয়া এ রকম বিভিন্ন খাত নিয়ন্ত্রণ করেন বলে জানা গেছে।
৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও চাঁদাবাজি, দখল–বাণিজ্য, হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না জনগণ। আগে আওয়ামী লীগের নেতারা করতেন, এখন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতারা করছেন।মাঈন উদ্দিন আহমেদ কামরান, ফেনী জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাবেক সভাপতি
কোন টার্মিনাল কার নিয়ন্ত্রণে
ফেনীর সবচেয়ে বড় বাস টার্মিনাল মহিপালে। এটি গড়ে উঠেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপর। এটা ইজারা দিয়ে আসছে ফেনী পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। সর্বশেষ ইজারাদার ছিলেন পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহাবুদ্দিন। তবে বাস থেকে তোলা চাঁদার মূল নিয়ন্ত্রণ করতেন সাবেক পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম ওরফে স্বপন মিয়াজী (বর্তমানে পলাতক)। এখন এই বাস টার্মিনালের ইজারা নিয়েছেন জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এয়াকুব নবী। এর মাধ্যমে টার্মিনালসহ মহিপালকেন্দ্রিক পরিবহন চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাঁর হাতে।
মহিপালে মহাসড়কের দুই পাশেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলকারী বাস কোম্পানির কাউন্টার রয়েছে। এর বাইরে সড়কের পাশে বসানো হয়েছে ভাসমান কাউন্টার। এগুলো থেকে ফেনী-কুমিল্লা, ফেনীর বিভিন্ন উপজেলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানের বাস চলাচল করে। দিনে দেড় থেকে দুই হাজার বাস থামে সেখানে। শুধু স্লিপার ও এসি শ্রেণির কিছু বাস উড়ালসড়ক দিয়ে চলে যায়, মহিপাল থামে না। বাকি যেসব বাস মহিপালে থামে, প্রতিটি বাস থেকে ইজারা বাবদ নেওয়া হয় ৫০ টাকা। এর বাইরে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এ ক্ষেত্রে এয়াকুব নবীর মূল সহযোগী হলেন ফেনী পৌর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক খুরশিদ আলম।
পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের সূত্র বলছে, এই টার্মিনাল থেকে যে চাঁদা তোলা হয়, সেটার ভাগ ফেনী বিএনপির পদধারী ১৫-২০ জন নেতা পান। এর বাইরে জেলা বিএনপির অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক গাজী হাবিবুল্লাহ মানিকের বাড়ি মহিপাল বাস টার্মিনালের পাশে। সেখানে তাঁরও একটা প্রভাব রয়েছে।
এই প্রতিবেদক সম্প্রতি সরেজমিনে মহিপাল টার্মিনালে একাধিক পরিবহনশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফেনী-বারইয়ারহাট রুটে চলাচলকারী বাসের এক শ্রমিক বলেন, দিনে প্রতিটি বাসের টোল (চাঁদা) দিতে হয় ৪০০ টাকা। ঢাকা বা চট্টগ্রাম রুটের বাসগুলোয় আরও বেশি চাঁদা দিতে হয়।
এয়াকুব নবী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি শুধু ইজারা বাবদ ৫০ টাকা চাঁদা তোলেন। অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা করে নেওয়া হয়। এর বাইরে চাঁদাবাজির সঙ্গে পরিবহন মালিক সমিতি থাকতে পারে, তাতে তিনি জড়িত নন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, মদিনা বাসস্ট্যান্ড বা কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড ইজারা নিয়েছেন জাকির হোসেন। তিনি জামায়াতে ইসলামীর শ্রমিক ফেডারেশনের সাবেক নেতা। ফেনী আলিয়া মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষকে পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়ার অভিযোগে বহিষ্কার হন তিনি।
এই বাসস্ট্যান্ডের আশপাশের অটোরিকশাস্ট্যান্ড এবং পোস্ট অফিস রোড ও শিশুনিকেতনের সামনের টেম্পোস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সাইদুর রহমান।
দাউদপুর বাসস্ট্যান্ডের ইজারা নিয়েছেন সদর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুর রহমানের ভাই সাইদুর রহমান (রুবেল)। ফেনী সদর হাসপাতাল মোড় বাসস্ট্যান্ডের ইজারা নিয়েছেন সদর উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক তপন কর। ফেনী শহরের বড় বাজার ট্রাক–পিকআপস্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্রদলের মামুন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় ফেনী জেলায় বিভিন্ন দপ্তরের অধীন প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। চলমান কাজগুলো সম্পন্ন করতে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের। তবে বিএনপির একাধিক পক্ষ থাকায় শুরুর দিকে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।
সরকারি উন্নয়নকাজের নিয়ন্ত্রণ
ফেনী পৌরসভা, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, গণপূর্ত ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে (এলজিইডি) কাজ করেন, এমন বেশ কয়েকজন ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ফেনী জেলার সরকারি দপ্তরের উন্নয়নকাজের কোনটা কে পাবে, সেটা ঠিক করতেন নিজাম হাজারী। কাজ পাওয়ার আগেই তাঁকে দিতে হতো মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ টাকা। গত বছরের ৫ আগস্টের আগে যেসব দরপত্রের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, সেগুলোর ঠিকাদারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে নিয়েছেন নিজাম হাজারী। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নিজাম হাজারী পালিয়ে গেলে বিপদে পড়েন ওই সব ঠিকাদার।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সময় ফেনী জেলায় বিভিন্ন দপ্তরের অধীন প্রায় এক হাজার কোটি টাকার কাজ চলমান ছিল। চলমান কাজগুলো সম্পন্ন করতে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের। তবে বিএনপির একাধিক পক্ষ থাকায় শুরুর দিকে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।
গত ৫ ডিসেম্বর রাতে ফেনীর ফাজিলপুরে এক ঠিকাদারের ৬০ লাখ টাকা দামের এক্সকাভেটরে (মাটি কাটার যন্ত্র) আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ঠিকাদার আমজাদ হোসেনের প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইমরুল হাবিব চৌধুরী ৭ ডিসেম্বর ফেনী মডেল থানায় মামলা করেন। বটতলী-আরবি হাট সড়কে ২৩ কোটি টাকার ওই সংস্কারকাজ চলার সময় ঠিকাদারের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়েছিল বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
মামলায় জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজীবুল ইসলাম পাটোয়ারী, সদর উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মীর মোহাম্মদ আলী সবুজ, উপজেলা যুবদলের সদস্য কামরুল ইসলাম ভূঁইয়া ও ফেনী সদর উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইমাম সিদ্দিকীকে আসামি করা হয়। পরে কামরুল ইসলামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।
স্থানীয় ঠিকাদার ও বিএনপি–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আগের অসমাপ্ত উন্নয়নকাজগুলো বাস্তবায়নে এখন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কমিশন দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির আনোয়ার পাটোয়ারী, এয়াকুব নবী, আমান উদ্দিন কায়সার ও ছাত্রদলের সালাউদ্দিন মামুন।
গত বছরের শেষ দিকে ফাজিলপুর ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্থানে সড়ক সংস্কারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে শুধু সদর উপজেলার ধলিয়া ইউনিয়নেই তিনটি উন্নয়নকাজ ছিল। ধলিয়া স্কুলের পাশে আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কের রক্ষাদেয়াল নির্মাণ, মাটি ভরাট ও সম্প্রসারণের কাজ চলছিল। এই প্রকল্পের কাজ পেয়েছিল যুবলীগের নেতা নুরুল হুদা মিস্টারের মালিকানাধীন মেসার্স স্বাধীন করপোরেশন। ওই প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজটি করছিলেন শওকত হোসেন। গত বছর নভেম্বরে কাজ শুরু হলে ৬০ মিটার রক্ষাদেয়াল রাতের অন্ধকারে ভেঙে দেওয়া হয়। পরে যুবদলের সদ্য সাবেক সভাপতি জাকির হোসেনের (জসিম) সঙ্গে সমঝোতা করে কাজগুলো শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে সড়ক ও জনপথ (সওজ), গণপূর্ত, এলজিইডি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, ফেনী পৌরসভাসহ সরকারি দপ্তরগুলোর উন্নয়নকাজের দরপত্র নিজাম হাজারীর পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করতেন চার-পাঁচজন। এর মধ্যে শীর্ষে ছিলেন ফেনী পৌরসভার সাবেক মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজী, সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল, জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক লুৎফর রহমান (খোকন হাজারী), ফেনী সদরের ফাজিলপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুল হক, ফেনী জেলা যুবলীগের সভাপতি ও দাগনভূঞা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান দিদারুল কবির, ছাগলনাইয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউল হায়দার চৌধুরী ওরফে সোহেল।
স্থানীয় ঠিকাদার ও বিএনপি–সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, আগের অসমাপ্ত উন্নয়নকাজগুলো বাস্তবায়নে এখন বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাদের কমিশন দিতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাঁদের নাম আলোচিত হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির আনোয়ার পাটোয়ারী, এয়াকুব নবী, আমান উদ্দিন কায়সার ও ছাত্রদলের সালাউদ্দিন মামুন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযানও চালায়। কিন্তু বালু তোলা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা।
বালুমহালের ভাগজোখ
ফেনী জেলায় আটটি বালুমহাল রয়েছে। পাঁচটির ইজারাদার ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতারা। বাকি তিনটি ইজারা ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতারা ভোগ করতেন।
আওয়ামী লীগের পতনের পর জেলা প্রশাসন ইজারা বাতিল করে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে অভিযানও চালায়। কিন্তু বালু তোলা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। আর এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা।
সম্প্রতি ছোট ফেনী নদীসংলগ্ন সোনাগাজীর সাহেবের ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, একটি বালু তোলার ড্রেজার দাঁড়িয়ে আছে। পাশে নদীর পাড়ের জমিতে বালুর উঁচু স্তূপ। সেখানকার শ্রমিকেরা জানান, প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি করা হয় আড়াই হাজার টাকায়। এটির নিয়ন্ত্রণ করছেন সোনাগাজী উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক খুরশিদ আলম ভূঁইয়া।
সোনাগাজী উপজেলায় থাকা দুটি বালুমহাল ইজারা নিয়েছিলেন ফাজিলপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুল হক ওরফে রিপন (রিপন চেয়ারম্যান), যিনি নিজাম হাজারীর বন্ধু হিসেবে পরিচিত। এখন সেগুলো যুবদল নেতা খুরশিদের নিয়ন্ত্রণে।
ফেনী সদর উপজেলার বালুমহালগুলোর ইজারা না থাকলেও সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন রিপন চেয়ারম্যান। সেগুলো এখন বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের স্থানীয় নেতারা মিলেমিশে নিয়ন্ত্রণ করছেন।
ছাগলনাইয়া উপজেলা ও ফুলগাজী উপজেলার বালুমহালের দুটি ইজারা নিয়েছিলেন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মেজবাইল হায়দার চৌধুরীর ভাই রফিকুল হায়দার চৌধুরী এবং পরশুরাম উপজেলার একটি বালুমহালের ইজারা নিয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক মীর আহমেদ চৌধুরী। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর এসব বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (নাসিম) ভাই জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর (পাপ্পু) নিয়ন্ত্রণে, যা এখন চলে গেছে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের হাতে।
ফেনী জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগে বালু নিয়ে একধরনের নৈরাজ্য ছিল। এখন সেটা তাঁরা বন্ধ করতে পেরেছেন। কোথাও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের তথ্য পেলেই অভিযান চালানো হয়।
তবে জেলা বিএনপির একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসন অবৈধ বালু উত্তোলন ঠেকাতে তৎপর, সেটা দিনের বেলায়। কিন্তু রাতে দেদার বালু উত্তোলন করা হচ্ছে।
আগে বালু নিয়ে একধরনের নৈরাজ্য ছিল। এখন সেটা তাঁরা বন্ধ করতে পেরেছেন। কোথাও অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের তথ্য পেলেই অভিযান চালানো হয়।সাইফুল ইসলাম, ফেনীর জেলা প্রশাসক
বড় ‘মুরব্বি’

নিজাম হাজারীর উত্থানের সময় তাঁর রাজনৈতিক মুরব্বি ছিলেন আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিম। পুরো জেলার রাজনীতি ও অপরাধজগতের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর নিজাম মুরব্বি হিসেবে পান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে।
এখন নানা গ্রুপে বিভক্ত ফেনীর বিএনপির নেতাদেরও কোনো না কোনো মুরব্বি রয়েছে। এর মধ্যে প্রভাবশালী ধারাটির মুরব্বি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলমের (মজনু)। এ ধারার নেতা–কর্মীদের হাতে বিভিন্ন টার্মিনাল, সরকারি দপ্তরের দরপত্র ও বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ বেশি।
রফিকুল আলমের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেন বা তাঁকে ‘মুরব্বি’ মানেন আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী, এয়াকুব নবী, যুবদলের নাসির উদ্দিন ও ছাত্রদলের সালাউদ্দিন মামুন। এর বাইরেও স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে জেলা ও বিভিন্ন উপজেলার অনেকে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে সখ্য রেখে চলেন।
ফেনী বিএনপির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অসমাপ্ত উন্নয়নকাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য ঠিকাদারেরা বিএনপির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যে রফা করেন, সেটার বড় অংশ বড় ‘মুরব্বি’কে দিতে হয়েছে।
ফেনী-১ (পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া) আসনে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করতেন। ২০১৮ সালে খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পান রফিকুল আলম। আগামী নির্বাচনেও খালেদা জিয়া অংশ না নিলে তিনি মনোনয়ন পেতে পারেন বলে তাঁর সমর্থকেরা মনে করছেন।
রফিকুল আলম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি সদরের (ফেনী–২) রাজনীতিতে নাক গলান না। তবে সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে।
অনুসারীদের দিয়ে সরকারি দপ্তরে উন্নয়নকাজ নিয়ন্ত্রণ করেন, এমন অভিযোগের জবাবে রফিকুল আলম বলেন, তিনি ঢাকায় টুকটাক কাজ করেন। ফেনীতে কিছু করছেন না।
রফিকুল আলম গত ২ জুলাই ফেনী কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন। ভাইস চেয়ারম্যান হন আনোয়ার হোসেন পাটোয়ারী। অতীতে সদর আসনের (ফেনী–২) সংসদ সদস্যরাই এই সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদটি আয়ত্তে রাখতেন। এর অধীনে ফেনী শহরে অনেকগুলো বাড়ি, মার্কেট ও দোকান রয়েছে।
এখন নানা গ্রুপে বিভক্ত ফেনীর বিএনপির নেতাদেরও কোনো না কোনো মুরব্বি রয়েছে। এর মধ্যে প্রভাবশালী ধারাটির মুরব্বি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলমের (মজনু)। এ ধারার নেতা–কর্মীদের হাতে বিভিন্ন টার্মিনাল, সরকারি দপ্তরের দরপত্র ও বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ বেশি।
ছোট ‘মুরব্বি’
ফেনী বিএনপির রাজনীতিতে আরেকটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মশিউর রহমানের (বিপ্লব)। তাঁর অনুসারী বেশি ফেনী পৌর ও সদর উপজেলা বিএনপিতে। তিনি ফেনী–২ আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি অনেকটা ছোট ‘মুরব্বি’ হিসেবে দলের একটা ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন। পৌর বিএনপির আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন ও সদস্যসচিব মেজবাহ উদ্দিন ভূঁইয়া এবং সদর বিএনপির আহ্বায়ক ফজলুর রহমান ও সদস্যসচিব আমান উদ্দিন কায়সার সাব্বির তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী। এর মধ্যে মেজবাহ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে হওয়া মামলা নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।
যদিও মশিউর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘মামলা–বাণিজ্য’ আছে কি না, সেটা তিনি জানেন না। তিনি বলেন, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব খারাপ কিছু পেলেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। ফেনীতে এমন কিছু হলে ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
ফেনী বিএনপির রাজনীতিতে আরেকটি ধারার নেতৃত্বে রয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মশিউর রহমানের (বিপ্লব)। তাঁর অনুসারী বেশি ফেনী পৌর ও সদর উপজেলা বিএনপিতে। তিনি ফেনী–২ আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তিনি অনেকটা ছোট ‘মুরব্বি’ হিসেবে দলের একটা ধারার নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
চুপচাপ ভিপি জয়নাল

ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জয়নাল আবেদিন, যিনি ভিপি জয়নাল নামেই বেশি পরিচিত। বর্ষীয়ান এই নেতা বর্তমানে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। তিনি অনেকটাই চুপচাপ আছেন। দলীয় কর্মসূচিতে আমন্ত্রণ পেলে যান। না হয় বাড়িতেই থাকেন বেশির ভাগ সময়। দলে এখন তাঁর অনুসারীদের প্রভাব কম। তবে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। তাঁর সঙ্গে একটা যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন মশিউর রহমান (বিপ্লব)।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ উদ্দিন ও সদস্যসচিব আলাল উদ্দিনও ভিপি জয়নালকে সম্মানের চোখে দেখেন। তবে তাঁরা সব দিক রক্ষা করে চলার চেষ্টা করেন।
সম্প্রতি ফেনীতে নিজ বাড়িতে কথা হয় ভিপি জয়নালের সঙ্গে। দলের নেতাদের দখল ও মামলা–বাণিজ্য সম্পর্কে বিএনপির সাবেক এই সংসদ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, অতীতে যারা অন্যায়-অবিচার করেছে, তাদের পরিণতি তো চোখের সামনেই আছে। এরপরও বিএনপির কেউ অপরাধে যুক্ত থাকলে রেহাই পাবে না। কারণ, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছেন এবং অচিরেই এর ফল ভোগ করতে হবে।