Image description

এনসিপি আগামী নির্বাচনে একা নাকি জোটগতভাবে অংশ নেবে; বিএনপি বা জামায়াতের আসন সমঝোতায় যাবে নাকি আলাদা জোট করবে—এ নিয়ে রাজনীতিতে নানা আলোচনা রয়েছে।

দলটির ভেতরের সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী—দুই দলের সঙ্গেই জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যোগাযোগ রয়েছে। কিন্তু পথচলার শুরুতেই দলটি কোনো বড় দল বা মতের ‘ট্যাগ’ গায়ে লাগাতে চায় না। তারা ‘মধ্যপন্থী’ দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি দাঁড় করিয়ে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে চায়। এমন চিন্তা থেকে সমমনা বা কাছাকাছি মনোভাবের বিভিন্ন দলকে নিয়ে পৃথক নির্বাচনী মোর্চা করার কথা ভাবছে তারা।

এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ তিনজন নেতা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা তৃতীয় একটি জোট বা সমঝোতায় থাকতে চান। তবে নির্বাচনে কোথাও কোথাও বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে আসনভিত্তিক সমঝোতা হতে পারে।

পথচলার শুরুতেই এনসিপি কোনো বড় দল বা মতের ‘ট্যাগ’ গায়ে লাগাতে চায় না। তারা ‘মধ্যপন্থী’ দল হিসেবে নিজেদের পরিচিতি দাঁড় করিয়ে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করতে চায়।

জামায়াতের সঙ্গে সুসম্পর্ক, তবু আলাদা পথে

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংস্কারের বিভিন্ন আলোচনায় অনেকটা কাছাকাছি অবস্থানে ছিল জামায়াত ও এনসিপি। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়েও এই দুই দলের অবস্থান বিএনপির চেয়ে ভিন্ন। এ ছাড়া এনসিপির সঙ্গে জামায়াতের একধরনের ‘সুসম্পর্ক’ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে।

কিন্তু চলতি মাসে কিছু অভিন্ন দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে এনসিপির যুক্ত না হওয়ায়, এ নিয়ে ভিন্ন আলোচনা তৈরি করেছে। সংসদের উভয় কক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ বিভিন্ন দাবিতে এই আন্দোলনে এনসিপিকেও রাখার চেষ্টা ছিল। এনসিপির এক শীর্ষ নেতার বাসায় জামায়াতসহ সংশ্লিষ্ট অন্য দলগুলোর নেতারা বৈঠকও করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এনসিপি এই আন্দোলনে যায়নি।

চলতি মাসে কিছু অভিন্ন দাবিতে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ সাতটি রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে এনসিপির যুক্ত না হওয়ায়, এ নিয়ে ভিন্ন আলোচনা তৈরি করেছে।

বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে জামায়াতসহ সাত দল এই আন্দোলন শুরু করেছে বলে রাজনীতিতে আলোচনা আছে।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামছবি: নাহিদের ফেসবুক থেকে নেওয়া

এই আন্দোলনে এনসিপি কেন যায়নি, সে বিষয়ে ১৯ সেপ্টেম্বর দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা সংসদের নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতি চান না, শুধু উচ্চকক্ষে পিআর চান। এ ছাড়া তাঁরা মনে করেন, এখনো সম্পূর্ণভাবে ঐকমত্য কমিশনকে প্রত্যাখ্যান করে রাজপথে যাওয়ার সময় আসেনি।

‘এনসিপি বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে আলাদা ও স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে চায়।’
আরিফুল ইসলাম আদীব জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক, এনসিপি

ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় সাত দলের আন্দোলনে যাওয়ার বিষয়ে নাহিদের বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের একটি বক্তব্যের সাদৃশ্য আছে। ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা অব্যাহত আছে। এ অবস্থায় রাস্তায় কর্মসূচি দেওয়া অনেকটা স্ববিরোধিতা।

সালাহউদ্দিন আহমদ
সালাহউদ্দিন আহমদফাইল ছবি

সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেন।

হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এই সাক্ষাৎ হয়
হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর সঙ্গে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এই সাক্ষাৎ হয়ছবি: এনসিপির সৌজন্যে

বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদও হেফাজত আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন ওই দিন। হেফাজতের আমিরের সঙ্গে এই দুই দলের নেতাদের সাক্ষাৎ নিয়েও রাজনীতিতে কৌতূহল তৈরি হয়। কারণ, হেফাজতের আমির সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিচ্ছেন।

 

পৃথক জোটের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বক্তব্য দিচ্ছেন।  জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বক্তব্য দিচ্ছেন। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানেছবি: প্রথম আলো

জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতের টানাপোড়েনের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য ও মাঝামাঝি সমাধান খুঁজতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চসহ ৯টি দল। এর মধ্যে এনসিপিও আছে।

১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর হাতিরপুলের একটি রেস্তোরাঁয় দলগুলোর একটি বৈঠকও হয়।

গণতন্ত্র মঞ্চভুক্ত ছয় দল

  • গণসংহতি আন্দোলন

  • নাগরিক ঐক্য

  • বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

  • রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন

  • জেএসডি

  • ভাসানী জনশক্তি পার্টি

  • এনসিপি

  • এবি পার্টি

  • গণ অধিকার পরিষদ

বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে এই ৯ দলের সমন্বয়ে একটি পৃথক নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার সম্ভাব্যতা নিয়ে দলগুলোর নেতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এটি নির্বাচনী জোট বা সমঝোতায় গড়াবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এনসিপিসহ এই ৯ দল আলাদা জোট করলে বিএনপি সেটাকে খুব বেশি নেতিবাচকভাবে দেখবে না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, বিএনপি চায় না জামায়াতের সঙ্গে খুব বেশি দল যাক। এ ছাড়া ওই ৯ দলের মধ্যে গণতন্ত্র মঞ্চের ছয়টি দল ও গণ অধিকার পরিষদ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে ছিল। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের কাছে বিএনপি ইতিমধ্যে তাদের দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকাও চেয়েছে। অর্থাৎ তাদের সঙ্গে বিএনপির এখনো সম্পর্ক আছে।

অন্যদিকে জামায়াত জোট বা নির্বাচনী সমঝোতায় এনসিপিকেও রাখতে চায় বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, নির্বাচনী সমঝোতায় গেলে জামায়াতের দিক থেকে এনসিপিকে সব ধরনের সহযোগিতার আভাস দেওয়া হয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, এনসিপিসহ এই ৯ দল আলাদা জোট করলে বিএনপি সেটাকে খুব বেশি নেতিবাচকভাবে দেখবে না বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, বিএনপি চায় না জামায়াতের সঙ্গে খুব বেশি দল যাক।

স্বতন্ত্র সমীকরণের খোঁজে

এনসিপি সূত্র বলছে, দলটির নেতাদের মধ্যে একটা অংশ জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতায় যেতে আগ্রহী। তবে দলের মূল নেতৃত্ব এবং দলের ওপর প্রভাব আছে, এমন তরুণ নেতারা জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে আগ্রহী নন। তাঁরা মনে করেন, জামায়াতের সঙ্গে সরাসরি নির্বাচনী জোট বা সমঝোতায় গেলে এনসিপির গায়ে একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের ‘ট্যাগ’ লাগতে পারে। এনসিপি স্বকীয় অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এনসিপিকে মধ্যপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এমন কোনো ‘ট্যাগ’ গায়ে লাগানো যাবে না।

বিএনপির সঙ্গেও এনসিপির নির্বাচনী জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। এর কারণ হিসেবে দলটির নেতারা বলছেন, বড় দলের সঙ্গে জোটে গেলে তাতে এনসিপি ম্রিয়মাণ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে ও বৃহত্তর পরিসরে দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

জামায়াত জোট বা নির্বাচনী সমঝোতায় এনসিপিকেও রাখতে চায় বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, নির্বাচনী সমঝোতায় গেলে জামায়াতের দিক থেকে এনসিপিকে সব ধরনের সহযোগিতার আভাস দেওয়া হয়েছে।

নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার বিষয়ে এনসিপি এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি বলে গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি বলেন, এনসিপি বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে আলাদা ও স্বতন্ত্র একটি রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে চায়।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সম্মুখসারির নেতাদের বেশির ভাগ এনসিপিতে থাকায় যেকোনো নির্বাচনী জোট বা সমঝোতার ক্ষেত্রে দলটিকে সঙ্গে রাখার চেষ্টা থাকবে, এমনটাই মনে করছেন এনসিপির নেতারা। তবে এনসিপিও বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছে, করছে। তবে শেষ পর্যন্ত এনসিপি কোন দিকে যাবে, তৃতীয় কোনো মোর্চা তৈরি করতে সক্ষম হবে কি না, সেটা স্পষ্ট হতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।