Image description

এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক খাতে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে জাপানের শ্রমবাজার। শুধু ভাষা শিখে সহজ পদ্ধতিতে জাপানে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ায় এ বাজার ধরতে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। ‘বুড়োদের দেশ’খ্যাত জাপানে ক্রমেই কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমছে। ফলে শ্রমিকের ঘাটতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি। এজন্য বিদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানির ওপর নজর দিয়েছে জাপান। ফলে জাপানের শ্রমবাজার বাংলাদেশিদের জন্যও সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

গত বছরের মার্চে জাপান টাইমসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০৪০ সালের মধ্যে জাপানে কর্মক্ষম জনসংখ্যার ঘাটতি দাঁড়াবে প্রায় এক কোটি ১০ লাখে। ফলে আগামী ১৫ বছরের এই ঘাটতি পূরণে জাপান ইতোমধ্যে বিভিন্ন ভিসা ক্যাটাগরির মাধ্যমে বিদেশি কর্মী নিয়োগের সম্ভাবনা রেখেছে। কিন্তু সেই বিশাল শ্রমবাজার ধরতে বাংলাদেশ আসলে কতটা প্রস্তুত, সেটিই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এ বাজার ধরতে ইতোমধ্যে তারা কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, যা অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করতে কাজ চলছে। সূত্র জানায়, আগামী পাঁচ বছরে জাপানের চাহিদামতো এক লাখ কর্মী পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। এ লক্ষ্যে জাপানের সঙ্গে সরকারের দুটি সমোঝতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচটি খাতে ২০২৬ সালে জাপানে পাঠানো হবে দুই হাজার শ্রমিক। এছাড়া ২০২৭ সালে ছয় হাজার, ২০২৮ সালে ১২ হাজার, ২০২৯ সালে ৩০ হাজার এবং ২০৩০ সালে ৫০ হাজার শ্রমিক পাঠাবে বাংলাদেশ।

এর মধ্যে নির্মাণ খাতে ৪০ হাজার এবং কলকারখানার ২০ হাজার শ্রমিক আর বয়োবৃদ্ধ জাপানি নাগরিকদের সেবা দিতে কেয়ারগিভার ভিসায় ২০ হাজার এবং গাড়ি সার্ভিসিং ও কৃষি খাতে শ্রমিক যাবে ২০ হাজার। এসব খাতে যেতে হলে ভাষা শেখার পর টেকনিক্যাল ইন্টার্ন ট্রেনিং প্রোগ্রাম (টিআইটিপি), স্পেসিফাইড স্কিলড ওয়ার্কার (এসএসডব্লিউ)—এ দুই পদ্ধতিতে যেতে হবে। তবে এসএসডব্লিউ ভিসার মাধ্যমে জাপানে যাওয়া খুব সহজ।

তথ্যমতে, ১৯৯৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে জাপানে মোট দুই হাজার ৭৪০ জন কর্মী পাঠানো হয়, যা মোট শ্রমশক্তি রপ্তানির মাত্র দশমিক ০২ শতাংশ। সেক্ষেত্রে এবার সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগাতে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ করতে জাপান সেল গঠন করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।

জানা যায়, বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর এসএসডব্লিউ ভিসাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বয়সসীমা ১৮ থেকে ৩২ বছর। সেই সঙ্গে জাপানিজ ভাষার জাপান ফাউন্ডেশন টেস্ট (জেএফটি) লেভেল এ-টু পরীক্ষায় পাস করতে হবে। পাশাপাশি যে খাতে কাজের জন্য নির্বাচিত হবে, সে বিষয়ে লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে হবে। তবে জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ স্টুডেন্টদের জন্য জাপানিজ ঋণের ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নেপাল থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬০ হাজারের বেশি কর্মী স্পেসিফাইড স্কিলড ওয়ার্কার (এসএসডব্লিউ) ক্যাটাগরির আওতায় জাপানে গেছে। তাদের সবাই জাপানি টিচারের কাছে ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে এবং স্কিল লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় জাপানি সংস্কৃতির। অথচ সেখানে আামাদের প্রাপ্তি নাজুক।

তবে জাপানে কর্মী পাঠানোর অনুমোদনপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সির একটি সূত্র জানায়, নেপাল যদি এক বছরে এত কর্মী পাঠাতে পারে, তাহলে আমরা কেন পিছিয়ে? জাপানে বিপুল কর্মীর চাহিদা রয়েছে। প্রতি বছর যদি এক লাখ দক্ষ কর্মী তৈরি করা যায়, তাহলে পাঁচ বছর নয়; এক বছরেই এই এক লাখ কর্মী পাঠানো যাবে। কিন্তু দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না। তারা আরো জানায়, অনুমোধন পাওয়া কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির কাছে বর্তমানে প্রায় ৫০ হাজার কর্মীর চাহিদা পাঠিয়ে রেখেছে সে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এজেন্সিগুলো সময় নিচ্ছে। কারণ আমাদের কী পরিমাণ দক্ষ কর্মী আছে, সেটির ব্যাপারে নিশ্চিত হতে চায় তারা।

রুহুল আমিন নামে এক জাপান প্রবাসী বলেন, শিল্পোন্নত দেশ জাপানে অভিবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের আগ্রহ দিনদিন বাড়ছে। তবে এই স্বপ্নযাত্রার পথটি মসৃণ নয়। এক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা ভাষা। এছাড়া দক্ষতার ঘাটতিও এক্ষেত্রে বড় অন্তরায়।

তিনি আরো বলেন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার সুযোগ থাকলেও তা সীমিত। উচ্চশিক্ষায় আসা অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশ থেকে জাপানিজ ভাষা শিখে না আসায় দৈনন্দিন যোগাযোগ ও কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে পড়ছেন বিড়ম্বনায়। এছাড়া তথ্যের ঘাটতির সুযোগে বিভিন্ন এজেন্সির মিথ্যা আশ্বাসে ধারদেনা করে এসে অথই সাগরে পড়তে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

জানা যায়, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমানে জাপানিজ ভাষা (এন৫) প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ৩৩টি। তাছাড়া (লেভেল এন৫ ও এন৪) প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে রয়েছে বি-কে টিটিসি ঢাকা, বি-কে টিটিসি চট্টগ্রাম, মহিলা টিটিসি ঢাকা, নরসিংদী কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, টাঙ্গাইল কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খুলনা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তবে এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নেই পর্যাপ্ত দক্ষ প্রশিক্ষক। ফলে শিখন ঘাটতিতে পড়তে হচ্ছে প্রশিক্ষণার্থীদের।

বিশেজ্ঞরা বলছেন, জাপানে যাওয়ার প্রথম পদক্ষেপ হলো সে দেশের ভাষা শেখা। দ্বিতীয়ত, নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। সেজন্য প্রয়োজন জাপানি শিক্ষক দ্বারা ভাষা শিক্ষাদান ও তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোয় দক্ষ শিক্ষকের অভাব কাটছে না। তাদের মতে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে জাপানের শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে নিতে হবে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত উদ্যোগ। হুটহাট কিছু করতে গেলেই সম্ভাবনাময় এ বাজার থেকে ছিটকে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, কাওয়াই গ্রুপ জাপান লিমিটেড ২২ বিঘা জমির ওপর বিরুলিয়ায় আবাসিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে। জাপানি শিক্ষকদের দ্বারা ১ অক্টোবর থেকে নিজেদের ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণ শুরু করবে। ইতোমধ্যে কাওয়াই গ্রুপ ৮০ জনকে জাপানে নিয়েছে বাংলাদেশ থেকে। বিএমইটির একটি সূত্র থেকে জানা যায়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরো ৬০০ কর্মী জাপানে নেওয়া হবে।

এদিকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাপান সেল থেকে বলা হয়েছে, দেশটির শ্রমবাজারে অবস্থান শক্ত করতে বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—জাপানে বিদ্যমান শ্রমবাজারের চাহিদার অনুসন্ধান, দেশটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ চিহ্নিত করা ও প্রচার, জাপান ও বিদেশের বিভিন্ন দপ্তর বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় সাধন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সেন্টারের (কিউসিএস-১৭) কার্যক্রম চালু এবং কর্মীদের ভাষা প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল টেস্ট ও তথ্য সংগ্রহসহ বিভিন্ন কার্যক্রম।

জাপান সেলের প্রধান এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব শহিদুল ইসলাম চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, জাপান যেতে হলে ভাষা শেখা ও স্কিল টেস্ট পাস করা বাধ্যতামূলক। কোয়ালিফাইড লোক থাকলে এক বছরেই কর্মী পাঠানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের তো সেরকম কর্মী নেই। জাপানিজ ভাষা প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতিও রয়েছে। আমার কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। খুব দ্রুত এ জায়গায় দৃশ্যমান উন্নতি করা সম্ভব হবে। জাপানের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আমাদের নিয়মিত মিটিং চলছে, যাতে তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ হয়।