Image description

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনকে ঘিরে অনিয়ম ও অসঙ্গতির ১২টি অভিযোগ তুলে ধরেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। নির্বাচনী অব্যবস্থাপনা, কারচুপির সিস্টেম, সমন্বয়হীনতা, মিসইনফরমেশন ও ডিজইনফরমেশনের ছড়াছড়ি, সর্বোপরি একটি প্যানেল ও কিছু ব্যক্তিবিশেষকে জেতানোর লক্ষ্যে সামগ্রিক নির্বাচন ‘নির্বাচনী প্রহসনে’ পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন ছাত্রদলের প্রার্থীরা।

মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার শিক্ষক লাউঞ্জে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এসব অভিযোগ তোলেন।

এ সময় ভিপি পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী শেখ সাদী হাসান, জিএস পদে তানজিলা হোসেন বৈশাখী, এজিএস (নারী) পদে আঞ্জুমান আরা ইকরা এবং এজিএস (পুরুষ) পদের মো. সাজ্জাদুল ইসলামসহ জাবি ছাত্রদলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সংবাদ সম্মেলনে প্রার্থীরা অভিযোগের বিষয়ে বলেন,

১. ছবিবিহীন ভোটার তালিকা, অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোটগ্রহণ, ভোট প্রদানের পর অমোচনীয় কালির ব্যবস্থা না করার মাধ্যমে নির্বাচনকে অবিশ্বাসযোগ্য ও প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে।
২. পর্যাপ্ত সিকিউরিটি ছাড়া আগের রাতে ব্যালট বাক্স কেন্দ্রে পাঠানো এবং ব্যালট বাক্স লুটের উদ্দেশ্যমূলক গুজব ছড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের সংখ্যার চাইতে অতিরিক্ত ব্যালট পেপার প্রেরণ করা হয়।

৩. একটি নির্দিষ্ট দলের সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তির অখ্যাত কোম্পানি এইচআর সফট বিডির কাছ থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনা হয়।

৪. ফজিলাতুন্নেছা হল, জাহানারা ইমাম হল, তাজউদ্দীন হলসহ কয়েকটি হলে জালভোট প্রদানের অভিযোগ ওঠে। জাহানারা ইমাম হলে বুথের মাঝে দুটি প্যানেলের লিফলেট সাজিয়ে রাখতে দেখা যায়। এছাড়া ফজিলাতুন্নেছা হলে ব্যালট পেপার ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখা যায়।

একই হলের প্রভোস্ট খুবই আগ্রাসীভাবে একটি প্যানেলের পক্ষে ভোট কারচুপিতে ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ইতোপূর্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শিক্ষক পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজেই একটি প্যানেলের পক্ষে ভোটারদের কাছে ভোট চেয়েছেন। কারচুপির অভিযোগে এই হলে অনেকটা সময় ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। ছাত্রদলের প্রার্থীদের এমনকি নারী সাংবাদিকদের পর্যন্ত তিনি ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দিয়েছেন।

৫. অধিকাংশ পোলিং অফিসাররা নির্বাচনী আচরণবিধি সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তাদের প্রয়োজনীয় ব্রিফ করা হয়নি।

৬. প্রার্থীদের এজেন্টের বিষয়ে নানান টালবাহানা করা হয়। প্রথমে বলা হয় কোনো এজেন্ট রাখা হবে না। পরে নির্বাচনের আগের গভীর রাতে এজেন্ট রাখার সিদ্ধান্ত দেওয়া হলেও সকালে তাদের কেন্দ্রে ঢোকা নিয়ে হয়রানি করা হয়। প্রথম প্রায় দুই ঘণ্টায় হলগুলোতে এজেন্ট ছিল না। একটি নির্দিষ্ট প্যানেলের এজেন্টরা এক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পায়।

৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের রফিক জব্বার হলে মোট ভোট প্রদান করা হয়েছে ৪৭০টি। কিন্তু ডাইনিং ও ক্যান্টিন বিষয়ক সম্পাদক পদে প্রতিজন প্রার্থীর ভোটের যে সংখ্যা ঘোষণা করা হয়, তার যোগফল ছিল ৫১৩টি। এই অতিরিক্ত ভোটার কোথা থেকে এলো কেউ জানে না। সম্প্রীতির ঐক্য প্যানেল থেকে নীলা অং মারমা নির্বাচন করেছিলেন। মওলানা ভাসানী হলে তার প্রাপ্ত ভোট দেখানো হয় শূন্য।

এই বিষয়ে একজন ভোটার তার ফেসবুক পোস্টে বলেন যে, মওলানা ভাসানী হলে অনেক আদিবাসী ভোটার থাকে। নীলার অনেক কাছের বন্ধুবান্ধব, সিনিয়র-জুনিয়রেরা আছে। তারা একজনও কি নীলাকে ভোট দেয়নি? কেউ যদি নাও দিয়ে থাকে, তিনি নিজে নীলাকে ভোট দিয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন, তার সেই ভোটের হিসাব কোথায়।

৮. কোথাও কোথাও ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নামই ছিল না। সেখানে পছন্দের প্রার্থীর নাম হাতে লিখে জমা দিতে বলা হয়। যেখানে ভোট দিতে হবে ৩ জনকে, সেখানে ১ জন প্রার্থীর নামের পাশে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়। কিছু কেন্দ্রে কয়েকজন ভোটার অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে আসেন যে ভুলক্রমে ভোটার লিস্টে তাদের নাম আসে নাই, তাদের যেন ভোট দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। বিস্ময়করভাবে এখানে প্রভোস্টরা তাৎক্ষণিকভাবে সিল দিয়ে তাদের ভোটার বানিয়ে ভোট প্রদানের অনুমতিও দিয়েছেন।

৯. ভোটের আগেরদিন রাত থেকেই সারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বহিরাগত নেতাকর্মীদের নিয়ে এসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে চারদিক থেকে অনেকটা অবরুদ্ধ করে ফেলা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বিশমাইল, গেরুয়া, প্রান্তিক, ইসলামনগর, ডেইরি গেটসহ প্রতিটি জায়গায় ছিল বহিরাগত ক্যাডারদের ব্যাপক উপস্থিতি। তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল খুবই আক্রমণাত্মক। প্রতিটি প্রবেশপথে তারা সংঘবদ্ধভাবে পাহারা বসায়। গভীর রাতে ডেইরি গেটে এসেছিলেন ঢাকা-১৯ আসনে জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী মাওলানা আফজাল হোসাইন।

১০. কাজী নজরুল ইসলাম হলে সকাল থেকে ভোট প্রদানের হার ছিল খুবই কম। বিকেল ৪টা পর্যন্ত এই হলে ভোট পড়ে চারশর মতো। কিন্তু শেষদিকে ভিড় অনেক বেড়ে যায়। অভূতপূর্বভাবে এই হলে ভোট গ্রহণ করা হয় সন্ধ্যা সাতটারও বেশি সময়। এ হলে জিএস পদে মোট ৬ জন প্রার্থীর ঘোষিত ভোট সংখ্যা হিসাব করলে দাঁড়ায় ৭৫৬ ভোট। কিন্তু এই হলে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যা ৮০৬। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ হলে নির্ধারিত সময়ের অনেক সময় পেরিয়ে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। আমরা প্রশাসনের কাছে সব কেন্দ্রের ভোট প্রদানকারী ভোটারদের তালিকা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চাইলেও আজ পর্যন্ত পাইনি।

১১. শহীদ রফিক-জব্বার হলের ভোটকেন্দ্রে একজনের ভোট আরেকজন দিয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন একজন। ওই শিক্ষার্থীর নাম মো. রবিউল ইসলাম। তিনি জানান, ২০ মিনিট লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিতে এসে দেখি, আমার ভোট আগেই অন্য কেউ দিয়ে গেছে। জীবনের প্রথম ভোট এভাবে নষ্ট হবে, আমি কোনো দিন ভাবিনি। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হলের পোলিং অফিসার মো. জাকির হোসেনের সত্যতা স্বীকার করেন। জাবি হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গণনায় অসঙ্গতি হয়। এই পদে মোট চারজন প্রার্থী মিলে ভোট পেয়েছেন ৫০৯টি, যদিও হলটিতে সর্বমোট ভোট পড়েছে ৪৬৯টি।

১২. নির্বাচন শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও উপাচার্য বরাবর আমরা লিখিত আবেদনে সব কেন্দ্রের ভোট প্রদানকারী ভোটারদের তালিকা ও সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চাইলেও অদ্যাবধি আমাদের তালিকা বা ফুটেজ দেওয়া হয়নি। তারা কৌশলে কালক্ষেপণের রাস্তা বেছে নিয়েছেন বলে আমরা মনে করি।