
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যার অভিযোগ কাঁধে নিয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা।
বিদেশে পালানোর পর কিছুদিন ঘাপটি মেরে থাকলেও আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে আসতে থাকেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। শুধু প্রকাশ্যেই আসতে থাকেননি, তারা বিদেশেও আচরণ করতে থাকেন ‘আওয়ামী মহিমায়’। জুলাই অভ্যুত্থানের সংগঠক থেকে শুরু করে সরকারের উপদেষ্টাদের টার্গেট করতে থাকেন অনলাইনে-অফলাইনে।
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডে পৃথকভাবে দুই উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও মাহফুজ আলমকে টার্গেট করে হেনস্তা করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সবশেষ সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) বিকেলে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিমানবন্দর থেকে বেরোনোর সময় তাদের হাতে আক্রান্ত হলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) সদস্য সচিব ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক আখতার হোসেন। ‘মব’ তৈরি করে ডিম নিক্ষেপ করা হয়েছে আখতারকে। এসময় অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করা হয় এনসিপির আরেক নেত্রী ডা. তাসনিম জারাকেও। রেহাই পাননি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও।
এই প্রেক্ষাপটে দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ আসলে কোন পথে হাঁটছে! একদিকে দেশের মাটিতে জুলাই গণহত্যার জন্য তাদের নেত্রী শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী-এমপিদের বিচার চলছে। হত্যাযজ্ঞ, সহিংসতা, উসকানিসহ নানা কারণে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে চলছে দলটির বিচারেরও আলাপ। অন্যদিকে বিদেশের মাটিতে দেশের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রাজনীতিকদের তারা আক্রমণ করছে সংঘবদ্ধভাবে। জুলাই গণহত্যার জন্য কোনো ধরনের অপরাধবোধ বা অনুশোচনার বদলে এই সহিংস রূপে আবির্ভূত হয়ে আওয়ামী লীগ দেশের জনগণের কাছে নিজেদের আরও নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। বিদেশে নিরাপদে থাকা আওয়ামী লীগের লোকদের আচরণে দেশে থাকা দলটির লোকজন নিরাপত্তা শঙ্কায় ভোগেন কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে উদ্বেগ।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, শত শত আন্দোলনকারীকে হত্যার পরও এ নিয়ে অনুশোচনা বা অপরাধবোধ না থাকা বিস্ময়কর। যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত হয়ে আবার যুক্তরাষ্ট্রেরই বিরুদ্ধে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে অভিযুক্ত করা হাস্যকর। তবে বিদেশের মাটিতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এ আগ্রাসী আচরণ সরকারের উপদেষ্টা ও রাজনীতিকদের নাজেহাল করলেও এতে দলটিরই ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। হচ্ছে বাংলাদেশেরও বদনাম।
আর আক্রান্ত নেতাদের সহকর্মী ও রাজনীতিকরা বলছেন, এ ধরনের আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারকে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে হাঙ্গামায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। একইসঙ্গে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে সংঘটিত যাবতীয় অপরাধের বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
আসিফ নজরুল, মাহফুজ আলমের পর আখতার-জারা
পতিত আওয়ামী লীগের বিদেশে পলাতক নেতা-কর্মীরা, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় ভোগবিলাসী জীবন যাপন করা দলটির অ্যাক্টিভিস্টরা শুরু থেকেই জুলাই অভ্যুত্থানকে চক্রান্ত বলে আসছেন। এমনকি পুলিশের গুলিতে শত শত আন্দোলনকারীর প্রাণহানির ভিডিও অনলাইনে থাকলেও তারা তা নিয়ে কথা বলতে চান না। জুলাইয়ে প্রায় ১৪শ মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন, যার সমন্বয়ে শেখ হাসিনা নিজে ছিলেন বলে জাতিসংঘ তদন্ত প্রতিবেদন দিলেও সেটিকে পাতানো বলে আসছেন তাদের নেতা-কর্মীরা। উপরন্তু ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আক্রোশ থেকে তারা অনলাইনে-অফলাইনে গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিকে নানাভাবে টার্গেট করছেন। দিচ্ছেন জানমালের ক্ষয়ক্ষতির হুমকিও।
এর মধ্যে গত নভেম্বরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আওয়ামী লীগের একদল লোকের হাতে হেনস্তার শিকার হন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডি এবং সংস্থাটির গুরত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে দেশে ফিরছিলেন। দূতাবাসের প্রটোকলে তিনি গাড়ি করে জেনেভা বিমানবন্দরে পৌঁছান। গাড়ি বিমানবন্দরে নামার পর হাঙ্গামাকারীরা এসে আইন উপদেষ্টাকে ঘিরে ধরে। উপদেষ্টা বিমানবন্দরে প্রবেশের আগ পর্যন্ত হেনস্তাকারী তাকে বিরক্ত করে। সেখানে সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম জমাদার ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল খান উপস্থিত ছিলেন।
এরপর ২৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রিত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা টার্গেট করে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহফুজ আলমকে। সেদিন নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে ঢোকার সময় তাকে হেনস্তার চেষ্টা করে তারা। তারা মাহফুজ আলমকে উদ্দেশ করে ডিম ছোড়ে, দেয় বিভিন্ন আগ্রাসী স্লোগান। হাঙ্গামাকারীরা কনস্যুলেট ভবনের কাচের দরজাও ভেঙে ফেলে। এরপর ১৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যেও আওয়ামী লীগের টার্গেটে পড়েন মাহফুজ আলম। সেদিন বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের স্কুল অব আফ্রিকান অ্যান্ড ওরিয়েন্টাল স্টাডিজ (সোয়াস) ক্যাম্পাসে জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এক সেমিনারে অংশগ্রহণ শেষে বের হয়ে যাওয়ার সময় তার ওপর হামলার চেষ্টা করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা সবশেষ ‘মববাজি’ দেখাল নিউইয়র্কে গত সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) স্থানীয় সময় বিকেলে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন আক্রান্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের মারমুখী কর্মীদের হাতে। তার পিঠে ডিম নিক্ষেপ করেছে পতিত দলটির লোকজন। এছাড়া সেখানে থাকা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং এনসিপির নেত্রী ডা. তাসনিম জারাকেও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে তারা। এই ঘটনায় আওয়ামী লীগের একজন কর্মীকে আটকও করে নিউইয়র্ক পুলিশ।
দূতাবাসগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
বিদেশের মাটিতে এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভ্যুত্থানের পর আইন অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও তার নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা এ ধরনের সুযোগ পাচ্ছে। ‘অনভিপ্রেত’ এসব ঘটনা বাংলাদেশের সম্মান ও মর্যাদাকে ভূলণ্ঠিত করবে। ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়,
এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দেশে দায়িত্বে থাকা দূতাবাসসহ কূটনীতিকদের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তবে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি এড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলছেন সচেতন মহল।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে ঢাকায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার নিউইয়র্ক সফরকে কেন্দ্র করে যে কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে সেখানে পুলিশ প্রস্তুত থাকবে। পশ্চিমের দেশগুলোতে বাধা দেওয়া, স্লোগান দেওয়া, রাস্তায় মিছিল করা, প্রতিবাদ করার রাস্তা আটকানোর কোনো উপায় আমাদের কেন, কারও নেই। সেসব দেশের সরকার এটা করতে দিতে বাধ্য। ’
জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগদানকালে আওয়ামী লীগের হামলার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক সফরসঙ্গীদের উপর পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের ন্যক্কারজনক হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, জুলাই আন্দোলনের এক বীরসেনানী এবং একজন নারী নেত্রীর ওপর জঙ্গি কায়দায় হামলে পড়া, নিশ্চয়ই যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন আমলে নেবে। ’
তিনি বলেন, ‘আমরা জাতি হিসেবে লড়াই করেছি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য, আর আজ এমন সময়ে এসে যদি আমাদের নেতাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না যায়—তাহলে সেটি কেবল অবহেলা নয়, ইতিহাসের কাছে এক অমার্জনীয় ব্যর্থতা। এই হামলা শুধু ব্যক্তির ওপর নয়, এটি বাংলাদেশের মর্যাদা, আমাদের গণতান্ত্রিক অঙ্গীকার এবং একটি নতুন পথচলার ওপরও হামলা। ’
রাজনৈতিক নেতারা যা বলছেন
নিউইয়র্কের ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনার ঝড় বইছে। বিশেষ করে বিভিন্ন দলের নেতারা আওয়ামী লীগের উগ্রবাদী আচরণের নিন্দার পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় দূতাবাসের ভূমিকার সমালোচনা করেন।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ বাংলানিউজকে বলেন, ‘জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকার আমন্ত্রিত এবং সরকার রাজনীতিকদের প্রতিনিধি দলে অন্তর্ভুক্ত করেছে, তারা সেখানে গিয়েছেন। তাদের প্রতি যে আচরণ করা হয়েছে তা অসৌজন্যমূলক। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের সম্মান এবং মর্যাদাকে ভূলণ্ঠিত করবে এই আচরণ। এটা কোনো অবস্থাতেই ভালো কাজ হতে পারে না, এটা নিন্দনীয়। ’
তিনি বলেন, ‘তারা কারও ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে পারে, প্রতিবাদের বিভিন্ন ভাষা আছে। ডিম নিক্ষেপ করতে হবে কেন? অতীতে তো অনেক প্রতিবাদ হয়েছে। ডিম নিক্ষেপ এক ধরনের আক্রমণাত্মক ভূমিকা। আক্রমণাত্মক ভূমিকা রাখা তো ঠিক নয়। আমরা এটাকে নিন্দনীয় কাজ মনে করি। ’
এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ন টাওয়ারে এনসিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘যে ক্রমাগত হামলা, ষড়যন্ত্র এবং অপতৎপরতা চলমান রয়েছে, তার বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে উপর্যুক্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। যখন উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের ওপর আক্রমণ হয়েছিল, তখনো আমরা বলেছিলাম, গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের টার্গেট করা হচ্ছে এবং এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তা জড়িত। ভেতর থেকে এই তথ্যগুলো লিক (ফাঁস) করা হয়। সরকার ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা প্রদানের যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যবস্থাগুলো যথাযথ ছিল না বলে গতকালের ঘটনাটি ঘটছে। ’
সরকার ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে জবাবদিহি চেয়ে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ যে নানা তৎপরতা দেশে-বিদেশে করছে, তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে গতকালের ঘটনাটি দেখতে হবে। ফলে সরকারের পক্ষ থেকেও বিচার নিশ্চিত করার যে কথা আমরা বারবার বলে আসছি, সেই জায়গায় দুর্বলতা আছে বলেই আওয়ামী লীগ এত তৎপরতা করার সুযোগ পাচ্ছে। ’
নিউইয়র্কের ঘটনাটি নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে যা ঘটেছে তা আবারও প্রমাণ করল– আওয়ামী লীগ তাদের অন্যায়ের জন্য বিন্দুমাত্র অনুশোচনা করে না। আওয়ামী লীগ আজ পর্যন্ত যা অন্যায় করেছে সবকিছুর বিচার আইনের মাধ্যমে হবে। দল ও দেশের স্বার্থে ধৈর্য ধরুন।