Image description

ছাত্রদের বড় দুটি নির্বাচন- ডাকসু এবং জাকসুতে বিএনপি সমর্থিত ছাত্রদল কেন এভাবে ব্যর্থ হলো, জাতীয় রাজনীতিতে এর প্রভাব কী পড়তে পারে, এসবের বিচার-বিশ্লেষণ চলছে। প্রথমত আসা যাক ছাত্রদলের ভরাডুবি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের এমন ভূমিধ্বস জয়ের প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে নানা বিশ্লেষণ এসেছে। বিএনপি অভিযোগ করেছে, ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের আঁতাত হয়েছে। তাদের মতে, ছাত্রলীগের ভোট পুরোটাই পেয়েছে শিবির। বিএনপির বাইরেরও কেউ কেউ এ রকমের মতামত দিয়েছেন। এটা অস্বাভাবিক নয় যে, ছাত্রশিবির যেহেতু ইতিপূর্বে দীর্ঘকাল ছাত্রলীগ পরিচয়ে রাজনীতি করেছে। এভাবে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সেই সম্পর্ককেই কাজে লাগিয়েছে ছাত্রশিবির। তবে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ছাত্রশিবির ডাকসু-জাকসু নির্বাচনের জন্য অনেক আগে থেকেই যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে সেই তূলনায় ছাত্রদলের প্রস্তুতি ছিল একেবারেই নগন্য। ছাত্রশিবির নির্বাচনে জয়ের জন্য ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ নামে নির্বাচনী জোটও করেছে। এ জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ফাতিমা তাসনিম জুমা নামে এমন একজনকে যার রাজনীতির সঙ্গে শিবিরের রাজনীতির মোটেই মিল নেই। জুমাকে শিবিরের জোটে অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। ঝুমার নাচও ভাইরাল হয়েছে। কিন্তু ছাত্রশিবির তাদের ইসলামী রাজনীতিকে একপাশে রেখে নির্বাচনে জয়কেই টার্গেট করেছে। শুধু এই একটি উদাহরণই নয়, বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনসহ সব রকমের সম্ভাবনাকেই তারা নির্বাচনে জয়ের কাজে লাগিয়েছে।


অন্যদিকে ছাত্রদল কারো সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা দূরের কথা নিজেদের সুযোগগুলোকেই কাজে লাগায়নি। নিজেদের মধ্যে ছিল কমিটিগত কোন্দল। প্রার্থী বাছাইয়ে অনিয়ম। বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদককে খুঁজেই পাওয়া যায়নি এসময়। ’৯০ এর গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরা এবং সেই সময়কার ছাত্রনেতাদের প্রচারকাজে লাগানো- প্রভৃতি কোনোটিতেই ছাত্রদল বা বিএনপিকে দেখা যায়নি। দীর্ঘকাল ছাত্রদল ছিল ক্যাম্পাসের বাইরে, পাশাপাশি ছাত্রশিবির ছিল ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ছায়াতলে। ৫ আগস্টের পরে ছাত্রশিবির পুরোদমেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে তলে তলে। এই সময়েই ছাত্রদল ছিল অনেকটা ছন্নছাড়া গোছের। দলীয় কোন্দল ও কমিটি গঠন নিয়ে বিভ্রান্ত। নির্বাচন করবে এ রকমের প্রস্তুতিও ছিল না তাদের। তাছাড়া ছাত্ররাজনীতি বন্ধ- এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে ৫ আগস্টের পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। হলগুলো ছিল আগেই থেকেই শিবিরে দখলে। কমিটির বাইরে উল্লেখযোগ্য কোন নতুন রিক্রুট নেই দীর্ঘ সময় ছাত্রদলে। তার উপরে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সাধারণ ছাত্রদের মনস্তত্ত্বে যে পরিবর্তন এসেছে, সেটি বিবেচনা করা হয়নি। এ রকমের অনেক কারণ রয়েছে ছাত্রদলের ভরাডুবি এবং ছাত্রশিবিরের ভূমিধ্বস জয়ের পেছনে।


এবার আসা যাক জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব প্রসঙ্গে। মাহমুদুর রহমান মান্না এ প্রসঙ্গে বলেছেন তিনি দু’বার ডাকসুর ভিপি হয়েছেন। তিনি বা তার দল জাতীয় রাজনীতিতে কোনোই প্রভাব ফেলতে পারেননি। বাস্তবে তাই দেখা গেছে। এদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতা পরবর্তী তরুণদের কাছে জাসদ ছিল একটা ক্রেজ। জাসদ ভেঙে বাসদ হলো, কয়েক ভাগ হলো- তারপরও ডাকসুতে তাদের ছিল একচ্ছত্র প্রাধান্য। কিন্তু কোনো জাতীয় নির্বাচনেই জাসদ বা বাসদ তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে জাসদ-বাসদ এবং ছাত্রশিবিরের প্রেক্ষাপট পুরোপুরি এক হবে না, এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।


ছাত্রশিবিরের মূল রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী নিঃসন্দেহেই জাতীয় রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা পাবে। অবশ্য এমন বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই যে, দলটি বিএনপির সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিতে পারবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ডাকসুর নির্বাচনী ফল আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বড় কোনো প্রভাব নাও ফেলতে পারে। বরং এটি একটি প্রতীকী নির্বাচন হয়েই থাকতে পারে, যার প্রভাব সীমিত থাকবে মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।


ছয় দফা, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলন- সবক্ষেত্রেই ডাকসুর সক্রিয় নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করার দীর্ঘ এই ঐতিহ্যের কারণেই ডাকসুকে বলা হয় বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় সংসদ।


১৯২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ৩৮ বার ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। তবে মূলত স্বাধীনতার পর থেকে ডাকসু নির্বাচন নিয়ে সরকারগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়। যার ফলে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ১৯ বার নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও মাত্র সাতবার এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ডাকসুর নির্বাচন হয়নি। ১৯৯০ সালের পর ২৮ বছর বিরতিতে ২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন হয়। এর ছয় বছর পর গত ৯ সেপ্টেম্বর হলো ৩৮তম নির্বাচন। সবশেষ নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে বিপুল ভোটে জয়ী হলো বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল। এরপরে ১১ সেপ্টেম্বরের জাকসু নির্বাচনেও অনেকটা তাই।


১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত, এক দশক জুড়ে ডাকসু নির্বাচনগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ওই সময়গুলো ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং চূড়ান্তভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন বুননের এক অগ্নিগর্ভ অধ্যায়।


স্বাধীনতার পর ডাকসু নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যাবে- জাতীয় সংকট, জন মানুষের আন্দোলন এবং সামগ্রিক জাতীয় রাজনীতিতে ডাকসু নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে পারলেও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলে সেসময় ডাকসু নির্বাচনগুলো বা এর বিজয়ী নেতৃত্ব প্রত্যক্ষভাবে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। এর পেছনে রয়েছে তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁক।


১৯৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল জয়লাভ করে। এ সময় আমানউল্লাহ আমান ভিপি নির্বাচিত হন এবং খায়রুল কবির খোকন জিএস হন। উভয় নির্বাচনই এরশাদ সরকারের আমলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং বিজয়ী ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল তৎকালীন বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহযোগী সংগঠন। এই সময় ডাকসু নেতৃত্ব স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলকে সরাসরি প্রভাবিত করার মতো ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না।


দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের আলোচিত মুখ নুরুল হক নুর। পরবর্তীতে তিনি ‘বাংলাদেশ গণঅধিকার পরিষদ’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। কিন্তু তিনি নিজে বা তার দল গণঅধিকার পরিষদ জাতীয় রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন বলা যায়।


গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ৩৮তম ডাকসু নির্বাচনে বিস্ময়করভাবে ভিপি-জিএস-এজিএস পদে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল। তারা দেশের অন্যতম প্রধান এবং বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এরপরের দিন অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনেও প্রায় এই রকমের ফলাফল এসেছে। আসন্ন রাকসু এবং চাকসু নির্বাচনেও হয়তো তাই হবে।
কিন্তু, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ছাত্রদলের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী এবং বড় ছাত্র সংগঠনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করা শিবিরের সাংগঠনিক সক্ষমতা এবং দৃঢ়তার পরিচায়ক। এই বিজয় নিঃসন্দেহে জামায়াতকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। কিন্তু অতীতের মতোই জাতীয় রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারবে না।


স্বাধীন বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি নির্বাচনে জামায়াত অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়নি। এরমধ্যে দলটির নিজস্ব প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে ৫টি সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে জামায়াতের অংশগ্রহণ করা পাঁচটি নির্বাচন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত পাঁচটি নির্বাচনে দলটি গড়ে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এসব নির্বাচনে এ পর্যন্ত ৫০টি আসন পেয়েছে জামায়াত। তাদের অর্জিত গড় আসন মাত্র ১০টি। ভোটের মাঠে গড়ে ১০টি আসন পাওয়ার মতো উপযোগী রাজনৈতিক দল স্বভাবতই তাই সামনের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরও বেশি সংখ্যক আসন প্রাপ্তির প্রত্যাশা করছে। তারা বিএনপির সঙ্গে বড় রকমের দরকষাকষিরও চেষ্টা চালাবে নিঃসন্দেহেই। আর এ লক্ষ্যেই চরমোনাইয়ের ইসলামী আন্দোলনসহ আট দলের সমন্বয়ে রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের মূল দাবি হলো, জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ এবং পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়ন। সংবিধান সংশোধন ছাড়াই জুলাই ঘোষণা এখন থেকে বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে তারা। কিন্তু এ তিনটি উদ্দেশ্যের কোনোটিই পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত নেই। ড. ইউনূস সরকারকে জামায়াতের নিজেদের সরকার হিসেবেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে কী ধরনের আন্দোলনে নামবে জামায়াত তা এখনো পরিষ্কার নয়। এমন অবস্থায় কঠোর কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে গেলে নিজেদের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে, মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
শীর্ষনিউজ