Image description

জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ কয়েকটি অভিন্ন দাবিতে মাঠে নামছে জামায়াতে ইসলামীসহ চারটি দল। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে দলগুলো প্রাথমিকভাবে তিন দিনের বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করবে। এরপর নতুন কর্মসূচি দেবে।

জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিস গতকাল সোমবার পৃথক সংবাদ সম্মেলন করে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আগের দিন রোববার কর্মসূচি ঘোষণা করে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আল ফালাহ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। আজ সোমবার দুপুরে
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের আল ফালাহ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। আজ সোমবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

এদিকে গতকাল রাতে জানা যায়, এই চার দলের সঙ্গে নতুন করে আরও তিনটি দল যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত হচ্ছে। দল তিনটি হচ্ছে নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)। খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী ও জাগপার সহসভাপতি রাশেদ প্রধান প্রথম আলোকে জানান, তাঁরা আজ মঙ্গলবার নিজ নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দলগুলোর এই কর্মসূচির লক্ষ্য জুলাই সনদের বাস্তবায়নসহ নির্বাচনে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরির জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা। এর মধ্যে জামায়াত ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচির পরিকল্পনা নিয়েছে বলে জানা গেছে।

এর আগে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের সময় ঘোষণার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। এখন জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপিসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধের মধ্যেই জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনসহ চারটি ইসলামি দল অভিন্ন দাবিতে এই প্রথম একযোগে কর্মসূচি ঘোষণা করল।

দলগুলোর এই যুগপৎ কর্মসূচিকে নির্বাচনী রাজনীতি মাঠে গড়ানোর ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আবার কেউ কেউ এটাকে নির্বাচনকেন্দ্রিক সমঝোতা বা বোঝাপড়ার আভাস হিসেবেও দেখছেন।

চারটি দলের সংশ্লিষ্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন আয়োজনসহ চার-পাঁচটি অভিন্ন দাবিতে প্রাথমিকভাবে আটটি দল যুগপৎ কর্মসূচি শুরুর বিষয়ে একমত হয়েছিল। এ লক্ষ্যে দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে একাধিক বৈঠকও হয়। কিন্তু গণমাধ্যমে এ–সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি বিবৃতি দিয়ে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এবং গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুঠোফোনে যুগপৎ কর্মসূচির ব্যাপারে ভিন্নমত প্রকাশ করেন।

রাজধানীর পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। আজ সোমবার দুপুরে
রাজধানীর পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন দলের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের। আজ সোমবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের গতকাল সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, সরকার জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদানের সুস্পষ্ট উদ্যোগ না নিলে পরবর্তী সময়ে বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

জামায়াতসহ চারটি দল যেসব দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, তা অনেকটাই এক ও অভিন্ন। কর্মসূচির তারিখও এক। দেখা গেছে, কেউ পাঁচ দফা, কেউ ছয় দফা কর্মসূচি দিলেও মূল দাবিগুলো অভিন্ন। দাবিগুলো হচ্ছে জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান, জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে (কেউ কেউ উচ্চকক্ষে) পিআর পদ্ধতি চালু করা, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য প্রতিটি দল ও প্রার্থীকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার সমান সুযোগ) নিশ্চিত করা, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের সহায়ক হিসেবে জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।

এসব দাবিতে ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায়, ১৯ সেপ্টেম্বর বিভাগীয় শহরে এবং ২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশে জেলা-উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে চারটি দল। কৌশলগত কারণে দলগুলোর নেতারা মুখে না বললেও এটি কার্যত চারটি দলের যুগপৎ কর্মসূচি।

পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

রাজধানীর পুরানা পল্টনে আইএবি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির (চরমোনাইর পীর) মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। আজ সোমবার দুপুরে
রাজধানীর পুরানা পল্টনে আইএবি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির (চরমোনাইর পীর) মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম। আজ সোমবার দুপুরেছবি: প্রথম আলো

কয়েকটি দল কর্মসূচিতে না থাকলেও দাবির প্রশ্নে কাছাকাছি অবস্থানে

অন্যদিকে এনসিপি, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদ যুগপৎ আন্দোলন বা জোটবদ্ধ কর্মসূচিতে না থাকলেও সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রশ্নে দল তিনটির অবস্থান কাছাকাছি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কৌশলগত কারণে একটি দল এখনই কর্মসূচিতে যাচ্ছে না। আর একটি দলের দুই মুখ্য নেতার চিন্তা বিপরীতমুখী। একজন বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় আগ্রহী, অন্যজন এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন বিএনপির সঙ্গে যেতে আগ্রহ হারিয়েছেন। অন্য আরেকটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এক অংশ জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে আগ্রহী হলেও আরেকাংশের ভিন্নমত রয়েছে। এতে দলটিতে ভাঙনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

গত রোববার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় কয়েকটি দলের যুগপৎ কর্মসূচির বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানে এই কর্মসূচি ঘিরে দেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ ও রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বৈঠক-সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান বৈঠকে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ আন্দোলনে নামার প্রসঙ্গটি তোলেন। তিনি বলেন, জুলাই জাতীয় সনদসহ সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোতে সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে। অবরোধের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। আলোচিত একটি দল এই আন্দোলনে নেই বললেও শেষ সময়ে তারাও যুক্ত হতে পারে। তখন একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল একা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কর্মসূচি ঘোষণা উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করিম বলেন, ‘সরকার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের ঘোষণা না দিলে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামব। কেবল নির্বাচন ও ক্ষমতার পালাবদলের জন্য জুলাই অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়নি। দেশকে স্থায়ীভাবে ফ্যাসিস্ট ও স্বৈরতন্ত্রের কবল থেকে রক্ষা করতে মৌলিক সংস্কার ছিল এ অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য। কিন্তু সংস্কার ও বিচারকে গুরুত্ব না দিয়ে নির্বাচনকে মুখ্য করে তোলা হয়েছে, যা দেশকে অশুভ বন্দোবস্তে নিপতিত করবে।’

চরমোনাই পীর জানান, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে যারা অংশীজন ছিল, তাদের নিয়ে এই আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁরা সরকারকে চাপে রাখতে চান।

কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিএনপির দিকে হেলে গেছে। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর থেকে সরকার বিএনপির চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে চলছে বলে তাঁদের অভিযোগ। এ অবস্থায় জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিয়ে এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজন না করলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। এই বাস্তবতা সামনে রেখে কয়েকটি দল প্রাথমিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।

ইসলামপন্থীদের ভোট এক বাক্সে আনার উদ্যোগ

আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ভোট এক বাক্সে আনার উদ্যোগ নিয়ে তৎপরতা চালান চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করিম। সে উদ্যোগে শামিল থাকার কথা জানিয়েছেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান। এর সঙ্গে আহমদ আবদুল কাদেরের খেলাফত মজলিস ও মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসও যুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবার যুগপৎ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু হচ্ছে।