Image description

‘যে শহরে মানুষ ৫০০ গ্রাম পানি কিনতে ২০ টাকা খরচ করে, সেই শহরে আমি বিনামূল্যে রক্ত দান করছি, এ উপলব্ধিই আমাকে আত্মিক প্রশান্তি দেয়। মানুষ জন্মদিনে কেক কেটে তা উদযাপন করে। আর আমি ৪টি জন্মদিন রক্ত দিয়ে উদযাপন করেছি।’ কথাগুলো বলছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী খালিদ হাসান।

তিনি বর্তমানে অনার্স চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন। উচ্চমাধ্যমিক থেকেই তার রক্ত দেওয়া শুরু হয়েছিল। তখন থেকে শুরু করে অনার্সের এই ৪ বছরে তিনি মুমূর্ষু রোগীদের জীবন বাঁচাতে বিভিন্ন সময়ে ৩৪ বার রক্ত দিয়েছেন, এর মধ্যে ১৮ বার শুধু প্লাটিলেটই। তার লক্ষ্য নিয়মিত রক্ত দিয়ে ১০০তম বার পূর্ণ করা।

খালিদ হাসানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালিদ তার মায়ের অনুপ্রেরণায়ই মুমূর্ষু রোগীদেরকে নিয়মিত রক্ত ও প্লাটিলেট দিয়ে যাচ্ছেন। রক্ত দিয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর মধ্যে অনেক সওয়াব বা কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলে মা তার ছেলে খালিদকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেন। যার কারণে, সুস্থতা যতদিন থাকবে, ততদিন মায়ের এ অনুপ্রেরণাকে মনে-প্রাণে ধারণ করে রক্ত দিয়ে নিজেকে মানুষের তরে বিলিয়ে দিতে পণ করেছেন খালিদ। রক্ত দেওয়া যেন তার কাছে একপ্রকার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে।

রক্ত দেওয়ার শুরুটা কীভাবে হল, এ বিষয়ে জানিয়ে খালিদ হাসান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শুরুটা হয়েছিল কলেজে পড়াকালীন সময়ে, যখন সরকারি বিজ্ঞান কলেজের প্রথম বর্ষে পড়ি। একদিন সিনিয়র ভাইয়েরা বললেন, একজন রোগীর জন্য রক্ত প্রয়োজন। আমি রাজি হয়ে প্রস্তুতও হয়েছিলাম, কিন্তু রাত ১টার সময় বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে শুনলাম, রক্ত ম্যানেজ হয়ে গেছে। এরপর এক হাসপাতালে পাঁচ ঘণ্টা বসে থেকেও রক্ত দিতে পারিনি। অবশেষে চতুর্থ ডাক পেয়ে ঢাকা মেডিকেলে প্রথমবারের মতো রক্ত দিতে সক্ষম হই। সেই মুহূর্ত থেকে রক্তদান আমার কাছে অন্যরকম ভালোলাগা কাজ শুরু করে। এরপর থেকে প্রায় চার মাস অন্তর ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে রোগী খুঁজে বের করে নিয়মিত রক্ত দিতে শুরু করি। মানুষের উপকার করছি ভেবেই ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভালো লাগত। ধীরে ধীরে রক্তদান আমার নেশায় পরিণত হল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গল্প শেয়ার করে খালিদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর যোগ দেই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বাধনে’। আগ্রহ আর উৎসাহে প্রথম মাসেই পাই সেরা রক্ত সংগ্রহকারীর পুরস্কার। তখন আমি নিজে লাল রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি প্লাটিলেট দেওয়াও শুরু করি। যদিও ক্যাম্পাস সাংবাদিকতার ব্যস্ততার কারণে বাধনে সক্রিয়ভাবে থাকতে পারিনি, তবুও হল বাধনের দায়িত্বে যারা এসেছেন, তারা আমার নাম মনে রাখেন। কবে আমি রক্ত দিয়েছি, সেটাও অনেকে খেয়াল রাখেন। মাস পার হলেই সিনিয়র বা বন্ধুরা বলেন- “রোগী আছে, রক্ত দিতে পারবি?” আমিও সকল ব্যস্ততা একপাশে রেখে রাজি হয়ে যাই।

রক্ত দিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা বর্ণনা করে খালিদ বলেন, একসময় টানা তিনবার রক্ত দিতে গিয়ে ‘রিজেকশন’ দেখতে হলো। ডাক্তার জানালেন, আমার হিমোগ্লোবিন কমে গেছে। তাই টানা আট মাস রক্ত দেওয়া বন্ধ রাখলাম। ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করে আবার সিদ্ধান্ত নিলাম, এবার থেকে নিয়মিত প্লাটিলেট দেবো। এরপর থেকে প্রতি মাসে অন্তত একবার প্লাটিলেট দান চালিয়ে যাচ্ছি। আমি ভাবি, যে শহরে মানুষ ৫০০ গ্রাম পানি কিনতে ২০ টাকা খরচ করে, সেই শহরে আমি বিনামূল্যে রক্ত দান করছি- এ উপলব্ধিই আমাকে আত্মিক প্রশান্তি দেয়।

মায়ের অনুপ্রেরণায় রক্তদান করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ জন্মদিনে কেক কেটে উদযাপন করে। আর আমি ৪টি জন্মদিনে রক্ত দিয়ে উদযাপন করেছি। এর ভেতরেই খুঁজে পাই মানসিক শান্তি। আমার অনুপ্রেরণা আমার প্রিয় মমতাময়ী আম্মা। তিনি সবসময় বলেন- “রক্ত দেওয়ার চেয়ে সওয়াবের আর কী হতে পারে?” প্রতিবার রক্ত দেওয়ার সময় বেডে শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কানে বাজে আম্মার সেই কথা। আর আমি নতুন করে চেষ্টা করি, আল্লাহর অনুগ্রহে একজন রোগীকে বাঁচিয়ে তোলার ক্ষুদ্র অংশীদার হতে। এই অচেনা শহরে একজন অপরিচিতকে সাহায্য করে যেতে। যাদের দোয়ায় দুনিয়া ও আখেরাতে হয়তো আল্লাহ আমাকে মুক্তি দিবেন।

নিয়মিত রক্তদানের পণ করে খালিদ বলেন, এখন পর্যন্ত ৩৪ বার রক্ত দান করেছি, যার মধ্যে ১৮ বার প্লাটিলেট। আমার লক্ষ্য- শতবার রক্তদান পূর্ণ করা। যতদিন সুস্থ আছি, চেষ্টা করবো নিজেকে মানুষের তরে বিলিয়ে দিতে।