
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিজয় ভারতের কলকাতার বুদ্ধিজীবী মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। এখানকার কলামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং লেখকদের মন্তব্যে উদ্বেগ ও হতাশা স্পষ্ট। কেউ কেউ শিবিরের এ অর্জনকে ‘বাঙালি জাতির শত্রু’ এবং ‘রাজাকারের বাচ্চাদের’ বিজয় বলেও আখ্যা দিয়েছেন।
সম্প্রতি ডাকসু নির্বাচনের অধিকাংশ পদে শিবির সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে জয় পান। তাদের জয় বাংলাদেশ ছাপিয়ে আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে কলকাতায়ও।
তিনি আরো বলেন, বামপন্থি মেঘমল্লার বসু ও স্বতন্ত্র উমামা ফাতেমা তুলনামূলকভাবে ভালো ফল করেছে। এ দলগুলো ইসলামপন্থি রাজনীতি এবং রাজাকারদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।
স্নিগ্ধেন্দু মনে করেন, ছাত্র আন্দোলনের তথাকথিত ‘মধ্যপন্থি’ নেতৃত্ব আদর্শহীনতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তারা ডানপন্থি রাজনীতির সঙ্গে আপস করতে গিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়েছে।
শিবির প্রসঙ্গে এ কলামিস্ট বলেন, ইসলামী ছাত্রশিবির পাল্টায়নি। শিবিরকে হাতে পেতে মাহফুজরা নিজেদের পাল্টেছে।
তার এ পর্যবেক্ষণ থেকে বোঝা যায়, তিনি এ ফলকে একটি আদর্শিক পরাজয় হিসেবে দেখছেন। যদিও এ বুদ্ধিজীবী জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক, তবে ইসলামী কোনো দল ক্ষমতায় চলে আসে কি না তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তিনি।
বাংলা পক্ষ নামে কট্টরপন্থি দলের প্রধান গর্গ চট্টোপাধ্যায়। তিনি আরো কঠোর ভাষায় ডাকসুর ফলের সমালোচনা করেন। তিনি এ জয়কে ‘বাঙালি জাতির শত্রু’ এবং ‘রাজাকারের বাচ্চাদের’ বিজয় বলে আখ্যা দেন। তার মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক আদর্শ হলো পাকিস্তানপন্থি এবং মুক্তিযুদ্ধবিরোধী। তিনি বলেন, এরা ১৯৭১ সালের গণহত্যা এবং ধর্ষণের সমর্থক।
গর্গ তার মন্তব্যে বাংলাদেশকে ‘অসভ্য বাংলা’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতার উত্থান থেকে পশ্চিমবঙ্গকে রক্ষা করা বাংলা পক্ষের গুরুদায়িত্ব। এখন থেকে বাংলা ও বাঙালির সব অর্জনের উত্তরাধীকারী কেবল পশ্চিমবঙ্গ। তিনি বিশ্বাস করেন, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে হিন্দি ও উর্দু সাম্রাজ্যবাদের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলার লড়াইয়ে বাংলা পক্ষ জয়ী হবে।
তার এ মন্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তিনি এই ফলকে বাঙালি জাতির আদর্শিক বিভাজন হিসেবে দেখছেন। এর মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব জাতিসত্তাকে আরো শক্তিশালী করার ডাক দিচ্ছেন।
দিল্লিতে নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন ডাকসুতে শিবিরের বিজয়ে অবাক হননি। তিনি এটিকে বাংলাদেশের বর্তমান সমাজেরই প্রতিফলন বলে মনে করেন। তার মতে, দেশ এখন ‘জিহাদি জঙ্গি’, ‘মোল্লা মৌলভি ওয়াজিতে’ এবং ‘ইসলাম-ব্যবসায়ীতে’ ভরে গেছে। দেশ হিন্দুবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী, সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী, খুনি এবং ধর্ষকে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে।
তসলিমা বিশ্বাস করেন, দেশের মাদরাসা এবং মসজিদের সংখ্যা বৃদ্ধি এ ধরনের ফল বয়ে এনেছে। জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াতে ইসলামী বিপুল ভোটে জয়ী হবে এবং দেশ ‘দেশের শত্রুদের কবলে’ চলে যাবে।
তার এ মন্তব্য যে গভীর হতাশা এবং ক্ষোভের প্রকাশ তা স্পষ্ট। যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রতি তার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই বিজয় ভবিষ্যতে জামায়াতে ইসলামীর ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দিচ্ছে, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি করেছে। এমনকি কলকাতার নিউটাউনের আওয়ামী লীগ নেতারাও এই ফল নিয়ে শঙ্কিত। তারা বুঝতে পারছেন না যে, জামায়াত-শিবিরকে কেবল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী তকমা দিয়ে আর রাজনীতি করা যাবে না। তারা হয়তো সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছেন, যেখানে কেবল আদর্শিক স্লোগান দিয়ে ভোট পাওয়া কঠিন। এ ফল কেবল একটি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ফল নয়, এটি বাংলাদেশের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত, যা কলকাতার বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
কলকাতা দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত-শিবিরকে ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ তৈরি করে রেখেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো— বাংলাদেশের ভেতরে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে (আওয়ামী লীগ) সমর্থন জানানো এবং তাদের প্রতি কলকাতার সংহতি প্রকাশ করা। এ বয়ান অনুসারে আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং জামায়াত-শিবিরকে পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে তুলে ধরা হয়। ডাকসু নির্বাচনে শিবিরের জয় এ পুরোনো ন্যারেটিভকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
কলকাতার বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারছেন, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ আর কেবল আদর্শিক বিভাজনের ভিত্তিতে ভোট দিচ্ছে না। এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক হতাশা, নতুন নেতৃত্ব খোঁজা এবং পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর অনাস্থা।
কলকাতার এ প্রতিক্রিয়া তাই কেবল আদর্শিক ক্ষোভ নয় বলেই মনে হয়। এটি একটি সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল, যার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বজায় রাখতে এবং একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য নতুন পথ তৈরি করতে চাইছেন।
এ মন্তব্যগুলোর পেছনের মূলবার্তা হলো- জামায়াত-শিবির কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি বিপদ, যা বাংলাদেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এ বিপদ থেকে বাঁচতে কলকাতার বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলকে আরো সক্রিয় হতে হবে।