Image description
 

আইন থাকলেও এর যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অতীতে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। এতে সহায়ক ভূমিকায় ছিলেন ওইসব নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারা। ফলে ইমেজ সংকটে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন এ চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে পাতানো নির্বাচন ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতার আনার চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে এসব বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়েছে।

 

 

 

এ লক্ষ্যে নির্বাচনি আইন ও আচরণবিধি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক কর্মশালা সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে সম্পন্ন হয়। কর্মশালায় নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা অতীত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। কর্মশালায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

 

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অতীতে তিনটি নির্বাচন ছিল জালিয়াতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর মধ্যে সাবেক সিইসি কেএম নুরুল হুদা কমিশনের আয়োজন করা নির্বাচনটি ছিল সবচেয়ে নিকৃষ্ট। বিরোধীরা ওই নির্বাচনকে ‘নিশিরাতের ভোট’ বলে অভিহিত করেন। এ ধরনের ঘটনা যেন আর না ঘটে, সে ব্যবস্থাই নিচ্ছে ইসি।

 

কর্মশালার মূল প্রবন্ধে বলা হয়, আচরণবিধি যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হবে, সবার মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হবে, ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন এবং ভোট দিতে পারবেন। তবে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা এবং আইন প্রয়োগে নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে। বিগত সময়ে অনুষ্ঠিত বেশিরভাগ জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একচ্ছত্র অনৈতিক আধিপত্য ও প্রভাব এবং মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্রিয় ভূমিকার অভাবে জনগণের মধ্যে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা গেলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে। আচরণবিধি লঙ্ঘন নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে যে পদ্ধতি প্রচলিত আছে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনার পাশাপাশি নির্বাচনি আচরণবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালনের লক্ষ্যে সম্পূরক অথবা বিকল্প এক বা একাধিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সময়ের দাবি, যেন পরিবর্তিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় এগুলো অবাধ, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও ন্যায়ানুগ নির্বাচন আয়োজনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

 

মূল প্রবন্ধে আরো বলা হয়, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ-১৯৭২ (সংশোধিত)-এ অপরাধ ও দণ্ড অধ্যায়ের অপরাধগুলো এবং আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের বিষয়ে বিদ্যমান আইনে সাতটি ধারার কথা বলা হয়েছে। এগুলোর আলোকে নির্বাচনে অপরাধ দমনে নির্বাচনি কর্মকর্তারা ব্যবস্থা নিতে পারেন। এগুলো হলোÑনির্বাচনি অনুসন্ধান (ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি) কমিটি থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনের সুপারিশের ভিত্তিতে ইসি কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সংক্ষিপ্ত বিচারিক আদালতের মাধ্যমে ব্যবস্থা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ব্যবস্থা, আরপিওর ৮৭(এ) অনুসারে রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক ব্যবস্থা, আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে আদালতে নালিশি মামলা করা এবং নির্বাচনি অপরাধের বিষয়ে থানায় নিয়মিত মামলা করা। এ আইন থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনি অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে। এজন্য নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

 

আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনি অপরাধ রোধ ও আচরণবিধি প্রতিপালনে কর্মশালায় ছয়টি বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা হয়। সেগুলো হলোÑসংসদ নির্বাচনে সাধারণভাবে আইন ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ধরন, আইন ও আচরণবিধি বাস্তবায়নে বর্তমানে ও প্রস্তাবিত কাঠামো (গঠন, কাজের সময়কাল, সমন্বয়, ব্যবস্থাপনা, কর্মপদ্ধতি ও আইনি কাঠামো) ইত্যাদি এবং আইন ও বিধি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে প্রচলিত কাঠামোর পর্যালোচনা।

 

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে কমিটির কাঠামো, কার্যপরিধি এবং চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এক সদস্যবিশিষ্ট ৩০০টি ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি গঠন করা হয়। নির্বাচনপূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা এ কমিটির দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনপূর্ব যে কোনো অনিয়ম অনুসন্ধান করে এ কমিটি তিনদিনের মধ্যে কমিশনকে অবহিত ও সুপারিশ করে।

 

এক্ষেত্রে কমিশন চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশে প্রস্তাব করে বলেছে, নির্বাচনি অপরাধ ও অনিয়ম অনুসন্ধানের জন্য তফসিল হওয়ার পর থেকে মাঠে ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটি কাজ করলেও তারা সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। তারা বিচারকার্য পরিচালনার পাশাপাশি অনুসন্ধান কমিটির দায়িত্ব পালন করে। ইসিতে তাদের দেওয়া প্রতিবেদন পৌঁছানো এবং নথিতে উপস্থাপনের পর সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। ফলে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনা প্রতিরোধ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তাবিত আচরণ বিধিমালার ২৬ বিধির ৩(গ) সংযোজনের মাধ্যমে বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা রিটার্নিং অফিসার বা প্রিসাইডিং অফিসার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান যুক্ত করা হয়েছে।

 

তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের দুদিন আগ পর্যন্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয় নির্বাচনে। তারা প্রার্থী, কর্মী, সমর্থক ও রাজনৈতিক দলের কেউ আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে তাৎক্ষণিক সাজা দিতে পারেন। কিন্তু নির্বাচনি কাজে যুক্ত এসব কর্মকর্তা নিজ বিভাগের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নির্বাচনি দায়িত্ব পালন তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এছাড়া এলাকা বিস্তৃত হওয়ার কারণে তাদের দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া এসব কর্মকর্তা সরকারের নির্বাহী বিভাগের অংশ হওয়ায় রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে অক্ষম। এমনকি আচরণবিধি নিয়ন্ত্রণে সঠিক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তি তথা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিদের বিরাগভাজন না হওয়ার চেষ্টা করে নির্বাচনি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন না।

 

এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে তিনটি সুপারিশ করা হয় কর্মশালায়। এগুলো হলোÑম্যাজিস্ট্রেটদের দায়িত্ব পালনে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া, প্রয়োজনীয় সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা এবং তাদের কার্যক্রম তদারক করা।

 

বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের ভোটের দুদিন আগে, ভোটের দিন এবং পরের দুদিনসহ পাঁচদিনের জন্য নির্বাচনের কাজে যুক্ত করা হয়। কিন্তু এসব কর্মকর্তা অতীতে সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ফলে নির্বাচনি অপরাধের তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি। এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে তিনটি সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলোÑনির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনি অনিয়ম ও অভিযোগের তাৎক্ষণিক প্রতিকার নিশ্চিত করা, রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের কার্যকর যোগাযোগ, সমন্বয় সাধন ও লজিস্টিক সাপোর্ট নিশ্চিত করা।

 

কর্মশালায় অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেটদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়। এসব কর্মকর্তা পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিংয়ের জন্য পদ বাঁচিয়ে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করেন বলে অভিযোগ করা হয় কর্মশালায়। এজন্য কমিশন থেকে সুপারিশ করা হয়, নির্বাহী বিভাগের অংশ হলেও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে আচরণবিধি নিশ্চিতে প্রকৃত অর্থে নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

 

কর্মশালায় আরো বলা হয়, নির্বাচন পরিচালনা করেন রিটার্নিং অফিসাররা। কিন্তু ভবিষ্যৎ পদ-পদবির কারণে তারাও ক্ষমতা প্রয়োগে অনেক সময় নিষ্ক্রিয় থাকেন। আবার একই বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ক্ষমতা অর্পণ করায় এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করে। ফলে নির্বাচনি দায়িত্বে কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়ে নির্বাচন ভণ্ডুল হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। এ চ্যালেঞ্জ উত্তরণে প্রয়োজন রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারদের সক্রিয় করা এবং স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। জেলা প্রশাসক অথবা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের মতো পুলিশও দায়িত্ব পালনে নিষ্ক্রিয় থাকে নির্বাচনে। এসব চ্যালেঞ্জ উত্তরণে পুলিশ কর্মকর্তা অথবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার যে কোনো সদস্য নির্বাচনি অপরাধের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মশালায় অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, নির্বাচনি কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। অনেকে পদ-পদবির কারণে প্রভাবশালীদের বিরাগভাজন হতে চান না। এমনকি আচরণবিধি লঙ্ঘন করার পরও রিটার্নিং অফিসারের দপ্তর থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে চিঠি দিলে তারা বলেন, এ দায়িত্ব তার নয়। সেখান থেকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে চিঠি পাঠালে তারা জানান, সময় শেষ হয়ে গেছে। তার ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই। এরই মধ্যে নির্বাচন শেষ হয়ে যায়।

 

অপর এক কর্মকর্তা বলেন, অতীতের নির্বাচনের কিছু কেস স্টাডি কর্মশালায় তুলে ধরা হয়। এর আলোকে পরবর্তী সময়ে পদক্ষেপ নেবে কমিশন।