
গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দেশে একটি পরিবর্তনের আকাঙ্খা তৈরি হয়। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক ধারায় সংষ্কারের বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে। আগামীতে কোনো সরকার যাতে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে সেরকম সংষ্কারের দাবি আসে বিভিন্ন মহল থেকে।
অন্যদিকে জুলাই আন্দোলনে জড়িত সম্মুখ সারির নেতৃত্বদানকারী, অংশগ্রহণকারীদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণেই চলতি বছরের ১২ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে । সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজকে এই কমিশনের সহ-সভাপতি করা হয়েছে।
সর্বমোট ১১টি কমিশনের সুপারিশকে একত্রিত করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংষ্কার প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। যদিও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আছে আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
দেশের ৬৪ জেলায় ১৫টি নাগরিক সংলাপ ও বিস্তৃত জনমত জরিপের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত জুলাই সনদের খসড়া তৈরি হয়। কমিশন ছয় মাস ধরে ৩০টির বেশি দলের সঙ্গে আলোচনা করে সনদের চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করেছে। পরে বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক শেষে ২০২৫ সালের জুলাই সনদের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এতে মোট ৯৫টি প্রস্তাব অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৮৪টিতে সর্বসম্মত সমর্থন মিলেছে এবং ১১টিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রয়েছে।
সরকার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সকল সুপারিশকে জুলাই সনদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে জুলাই আন্দোলনে জড়িত সম্মুখ সারির নেতৃত্বদানকারী, অংশগ্রহণকারীদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা, জুলাই গণ অভ্যুত্থান স্বীকৃতি এবং দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকর সংষ্কারের স্বার্থে জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তির কথা বলছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতির প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো কোন ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ পরবর্তী সংসদে পাশ করার পক্ষে। আবার জামায়াত, এনসিপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি আগামী সংসদ বসার আগেই দেয়ার পক্ষে।
এমনকি জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি না দিলে রাজপথে নামার প্রস্তুতিও নিচ্ছে বলে জানা গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে জুলাই সনদের আইনগত স্বীকৃতি দেরি হলে রাজপথে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। যেটি কোন দলের জন্যই সুখকর হবে না বলে মত দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সনদ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও তারা সনদে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু পরবর্তীতে না মানলে কিছুই করার থাকবে না।
তারা মনে করেন, জুলাই সনদের চূড়ান্ত রূপের মধ্যেই অনেক রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নিহিত। জুলাই সনদ আইনগত ভিত্তি পেলে সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনমুখী হবে বলেও তারা বিশ^াস করেন।
লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত জরুরি। মতপার্থক্য থাকার পরও তারা যদি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে বাধ্য তাহলে নির্বাচনের পর এ সনদ গুরুত্ব হারাতে পারে। এমনকি সেটা তখন একটি কাগুজে বাঘ হয়ে থাকতে পারে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন জনককণ্ঠকে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে সমস্ত ছাত্র জনতা জড়িত ছিলো। তাদের জন্য কিছু করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ফলে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা এবং তা বাস্তবায়ন করা জরুরি।’
‘বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বৈঠকে বসলে এটি মীমাংসা হয়ে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এক্ষেত্রে অন্য দলের শীর্ষ দুএকজনকেও রাখা যায়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কাজী মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সব দল আন্তরিকতার সঙ্গে জুলাই সনদ তৈরির ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে হবে। কিছু বিষয় নিয়ে রানৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে সরকার প্রধান দেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রধানদের সঙ্গে মিটিং করে জুলাই সনদের চূড়ান্ত রূপ দিতে পারেন। জুলাই সনদের সমস্যার সমাধান হলে রাজনীতিতে অনেক কিছুরই সমাধান হয়ে যায়।’
‘প্রয়োজন হলে অন্তর্বতীকালীন সরকার প্রধান ড. ইউনুস এবং বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া অথবা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু ঠিক করে নিতে পারেন। তবে যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক তারা জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে।’
জানা গেছে, বিএনপি পিআর পদ্ধতিতে ১০০ আসনের উচ্চকক্ষ গঠন, দুদক ও তিন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিক নিয়োগ কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার সিদ্ধান্তে একমত নয় । দলটি জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে তারা এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে না।
অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, সংবিধান ও আইনের ওপরে প্রাধান্য পাবে সনদ। সনদ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারের সিদ্ধান্তগুলো নির্বাচনের আগেই কার্যকর করা হবে। বিএনপি এসব অঙ্গীকারে একমত নয়।
ঐক্যমত্য কমিশনে পাঠানো সনদের খসড়ার মতামতে বিএনপি বলেছে, সংবিধানের ওপরে কিছুই প্রাধান্য পেতে পারে না। আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ বন্ধ হলে নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হবে। যেসব সংস্কার কার্যকরে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেগুলো আগামী সংসদে বাস্তবায়ন হবে।
এদিকে জামায়াতসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল মনে করছেন দেশের এ সংকটময় মুহুর্তে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক খুবই জরুরি। তারা মনে করছেন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকের পর অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
জানা গেছে, গত মঙ্গলবার বিএনপি এবং জামায়াতের সঙ্গে মন্ত্রিপাড়ায় একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে বৈঠকে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। সূত্র জানায়, জামায়াত নেতারা বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে খুবই আগ্রহী।
সম্প্রতি জামায়াতসহ ৭টি রাজনৈতিক দল জুলাই সনদ ইস্যুতে বৈঠক করেছে। এতে এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ এবং খেলাফতের দুই পক্ষ অংশগ্রহণ করেন। তারাও সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি চায় এবং জুলাই সনদের অধীনেই নির্বাচন চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, কোনো সমঝোতা দলিল ‘সুপ্রা কনস্টিটিউশনাল ইনস্ট্রুমেন্ট’ (সংবিধানেরও ওপরে) হতে পারে না। সংবিধানের মধ্যে থেকে আইনিভাবে বৈধ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় কীভাবে সমঝোতা দলিলটা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা যায়, সে চিন্তা করতে হবে।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা উচ্চকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন, দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি না থাকা, দুই সংসদের নির্বাচিত প্রার্থীদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন এবং বেশ কিছু বিষয়ে ঐক্যমত জরুরি। এগুলো না মানা হলে এনসিপি জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে না।’
‘আমরা জুলাই সনদের আইনগত ভিত্তি চাই। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে গনভোট হওয়া দরকার। নতুন সংবিধান তৈরিতে গণপরিষদ ভোটও বাঞ্ছনীয়।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া না হলে এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ থাকে। কারণ যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে তারা জুলাই সনদকে ছুড়ে ফেলে দিলে কিছুই করার থাকবে না। সেকারণেই তারা আইনি ভিত্তির ওপর জোর দিচ্ছি।’
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে জুলাই সনদকে পুরোপুরি বাস্তবায়ন না করলে জুলাই সনদ শুধু দলিল আকারে থাকলে। এই সরকারকেই সনদ বাস্তবায়নের স্পষ্ট পথ এবং আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে হবে।’