
চার দশকের বেশি সময় ধরে যে জায়গায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় পরিচালিত হচ্ছিল, সেখানে সত্যিই কি কোনো গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে যাচ্ছে?
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভবঘুরেদের একটি দল ভবনটি দখলে নিয়েছিল; এখন সেই ভবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ‘ছাত্র’ পরিচয়ধারী আরেকটি পক্ষ। এ বছর জুলাইয়ে ভবনটি দখলে নেওয়ার পর তারা ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে হবে গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
প্রধান ফটকে তাদের লাল ব্যানার দেখে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মজিদের কথা মনে পড়তে পারে। তবে ‘লালসালু’ উপন্যাসের মত কোনো পীরের নাম সেখানে নেই, আছে লেখা- ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’।
অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর ওই ভবনের সামনের সড়কের নামও বদলেছে; বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এখন শহীদ আবরার ফাহাদ অ্যাভিনিউ।
ওই সড়কের ২৩ নম্বর হোল্ডিংয়েই আওয়ামী লীগের অফিস। এখনকার ১০ তলা নতুন ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল ২০১৮ সালে।
সম্প্রতি দুই দিন ওই ভবন ঘুরে ধোয়া-মোছার কাজ চলতে দেখা যায়। এক সময় সেখানে আওয়ামী লীগের সভা বা অনুষ্ঠানের যেসব চিহ্ন ছিল, সেসব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কথিত ছাত্রদের সঙ্গে দেখা গেছে পুরনো দখলদার- ভবঘুরেদেরও।
এই দখলদারদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পুলিশের কাছে নেই।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বলছে, আওয়ামী লীগের ইজারা বাতিল করা হয়নি, কাজেই নতুন করে কাউকে বরাদ্দও দেওয়া হয়নি।
আর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বলছে, ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পাড়ি জমান তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন তার বাসভবন গণভবন, তেজগাঁওয়ের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, এমনকি সংসদ ভবনেও লুটপাট-ভাঙচুর চলে। আর আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ে লুটপাটের পাশাপাশি অগ্নিসংযোগ করা হয়।
এরপর ভবনটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে; ভবঘুরেদের কেউ কেউ রাত্রিযাপন করতে, কেউবা মলমূত্র ত্যাগের কাজটি সারতে সেখানে যেতেন।
এর মধ্যে ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ভবনটিতে ব্যানার টানানো হয়েছে বলে জানালেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। বর্তমানে প্রধান ফটক ছাড়াও ভবনের তিনতলা থেকে একটি বড় ব্যানার ঝোলানো আছে। তবে সেটি মোচড়ানো, কী লেখা আছে তা নিচ থেকে বোঝা যায়নি।
পরিত্যক্ত দশা
আশির দশকে সরকারের কাছ থেকে আট কাঠা জমি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই ইজারার ভিত্তিতেই চার দশকের বেশি সময় সেখানে ‘কেন্দ্রীয় কার্যালয়’ চালিয়ে আসছিল দলটি।
এখন যারা গবেষণার কথা বলে ভবনটিতে অবস্থান করছেন, তারা বলছেন- বর্তমানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। অগাস্ট পেরোবার আগেই পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ হবে। তারপরই তাদের কাজ ‘দৃশ্যমান’ হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি জানতে গত ১২ ও ১৪ অগাস্ট ওই ভবনে যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদকর্মীরা।
১২ অগাস্ট দুপুর সোয়া ১টার দিকে গিয়ে দেখা গেল, প্রধান ফটক কাপড় দিয়ে আটকানো। ফটকে কোনো তালা নেই। ভেতরে কেউ আছে কি না তা বোঝার উপায় নাই।
কাপড় সরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল কিছু চেয়ার। গুনে দেখা গেল, লাল ও খয়েরি রঙের চেয়ার আছে ১৩টি।
একটি চেয়ারের ওপর পলিথিনে মোড়ানো কিছু জিনিসপত্র দেখা গেলও সেগুলো কী তা বোঝা গেল না।
ভেতরটা অন্ধকারাচ্ছন্ন, তবে কিছু জায়গা যে ইতোমধ্যে পরিষ্কার করা হয়েছে, তা নজর এড়ায় না।
দোতলায় উঠতেই নজরে পড়ল একটি ছোট চৌকি; তার ওপর সাদা কাপড় বিছানো। পাশে তিনটি চেয়ার রাখা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা গেল কিছু উপকরণ, যেগুলো মাদক সেবনে ব্যবহার হয়। তবে সেখানে কাউকে দেখা গেল না।
তৃতীয় তলা দেখা গেল আবর্জনায় ভরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ছাপ নেই। গা ছমছম করা পরিবেশ। সেখান থেকে দ্রুত নেমে এসে দুজনকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখা গেল।
একজন নিজেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিলেন; নাম বললেন আল-আমীন।
তার ভাষ্য, ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ বিশেষ কারোর সংগঠন নয়, এটি ‘আম-জনতার’ সংগঠন।
তবে নিজে ওই ‘আমজনতার’ কেউ নন দাবি করে আল-আমীন বললেন, “আমি তাদের কেউ না। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করি। যেমন টাকা পাই, তেমন কাজ করি।”
ইতোমধ্যে ১৫ দিন কাজ করার কথা জানালেন তিনি।
কতজন এখানে কাজ করছেন? আল-আমীন বললেন, “কখনও ১০ জন, কখনও ছয়জন, কখনও সাতজন কাজ করি। সবদিন করি না। টাকা পাইলে করি।”
ভবনটির বাইরে থেকে দেখা যায়, ষষ্ঠতলায় পরার কিছু কাপড় ঝুলছে, যা কারো বসবাসের ইঙ্গিত দেয়।
সেই কাপড়ের সূত্র ধরে করা প্রশ্ন করলে আল-আমীন বলেন, তিনি রাতে এ ভবনেই থাকেন।
কারা এখানে কতদিন ধরে থাকছেন, তার উত্তর খুঁজতে এরপর কথা হয় এক দোকানির সঙ্গে। ভবনের সামনের এ দোকানি নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় কথা বলতে চাইছিলেন না।
কথা বলানোর চেষ্টার এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “এখানে ছাত্রদের দেখি। তারাই থাকে।”
তারা কি রাতেও থাকে? দোকানি বললেন, “দিন কী আর রাত কী, সবসময়ই থাকে। এখনও আছে। বিকালে একসাথে সবাই বের হয়।”
তারা কোথায় যায় তখন? কী করে? এ প্রশ্ন শুনে আর কথা বাড়াতে চাইলেন না দোকানি।
আরও কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে তিনিও মুখে কুলুপ আঁটেন।
ভবনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পরিচয় দানকারী আল আমীন বললেন, বিস্তারিত জানতে চাইলে একদিন বিকালে আসতে হবে; তখন ‘সিনিয়র ভাইরা’ থাকেন।
ফের সরেজমিনে
একদিন বাদে ১৪ অগাস্ট ফের ওই ভবনে যান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের একদল সংবাদকর্মী। সেদিন বিকাল সোয়া ৪টার দিকে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তারা ভেতরকার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন।
খানিকবাদে দেখা গেল, সদ্য ঘুমভাঙা একজন সাততলায় মুখ ধুচ্ছেন। স্যান্ডো গেঞ্জি আর জিন্স পরা; কুলকুচি করে পানি ফেলছেন ভবনটির মাঝের ফাঁকা জায়গা দিয়ে।
এরপর ভেতরে ঢুকতেই একজনের দেখা মিলল, নিজেকে পরিচয় দিলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে। নাম নশু সর্দার। লুঙ্গি, ডেনিম শার্ট পরা নশু শার্টের নিচে একটি টি-শার্ট পরেছিলেন।
তিনি বললেন, এখানে তিনিসহ পাঁচজন রাতে থাকেন। ৫ অগাস্ট থেকেই ‘এখানে থাকায়’ পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সর্দার বনে গেছেন বলে তার ভাষ্য।
এর মধ্যে সাংবাদিক পরিচয় শুনে ‘সিয়াম’ বলে একজনকে তিনি ডাকেন।
সিয়ামের আসতে দেরি হওয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সংবাদকর্মীরা দোতলায় যান।
সেখানে সিয়াম নামের সেই তরুণের দেখা মেলে। তিনি কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেন। বলেন, তিনি বাংলায় পড়েন ২০২০-২১ সেশনে।
তার সঙ্গে ছিলেন হাবিবর রহমান নামে পরিচয় দেওয়া আরেকজন। তিনি একই কলেজের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের ইংরেজির শিক্ষার্থী হিসেবে পরিচয় দেন।
তাদের সঙ্গে আরেকজন ছিলেন, যিনি নিজের নাম বলেছেন- আনসার আলী।
পরে নশু সর্দারই পুরো ভবনটি ঘুরিয়ে দেখান। সিয়াম সাত তলার ওপরে আর না যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “গেলে এমনিই বমি চলে আসবে।”
ভবনের দোতলা পর্যন্ত পুরোপুরি পরিষ্কার দেখা গেলেও তিন তলায় দেখা গেল, ময়লা পরিষ্কার করে এক পাশে জমিয়ে রাখা হয়েছে। এর ওপরের তলাগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কোনো ছাপ দেখা গেল না। দেয়াল ও ভাস্কর্য ভাঙার ইট-সুড়কি পুরো ফ্লোরে পড়ে আছে।
‘স্বৈরাচারের রুম দখল’
সাত তলার সামনের অংশ বেশ পরিষ্কার; এ তলা বরাদ্দ ছিল আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের জন্য। তবে দখলদাররা ভাবছেন, এটি ছিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কক্ষ; তাই সেটি দখল করে আছেন।
এ তলায় ছোট ছোট দুটি কক্ষের মত অংশে নশু সর্দার থাকেন। বক্স চৌকি পাতা সেখানে। তার ওপর গার্মেন্টের পাতলা কম্বল বিছানো আর একটা চাদর। একটা কম্বল ভাঁজ করে তার ওপর পেপার পেঁচিয়ে বালিশের মত বানানো হয়েছে। আর দুটো কম্বল রাখা হয়েছে ভাঁজ করে।
নশু সর্দার বললেন, “হাসিনা আইলে এই রুমে থাকত। আমরা তাই স্বৈরাচারের রুম দখল করছি।”
এই কক্ষেই কি শেখ হাসিনা থাকতেন? এ প্রশ্নের উত্তরে নশু বললেন, “হ্যাঁ, আমরা তাই জানি।”
পাশের কক্ষে তখনও শুয়ে আছেন একজন। ভাঙা দরজা একটা পাতলা বোর্ড দিয়ে ঢেকে রাখার চেষ্টা নজর এড়াল না। দেয়ালে রশি টানিয়ে কাপড় রাখা হয়েছে সেখানে। বোঝা গেল কাপড় কয়েকজনের।
কক্ষের সামনের এ অংশটি পরিষ্কার, সেখানেই ছাত্রদের কেউ কেউ থাকেন বলে নশুর ভাষ্য।
ওপরের তলায় উঠলে দেখা যায়, সেখানে পরিচ্ছন্নতার কাজে হাতই দেওয়া হয়নি। ময়লা পানি জমে উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে।
এ ভবনে কেন থাকছেন? নশু সর্দার বললেন, “৫ অগাস্ট থেকে আছি। গণভবন থেকে শুরু করে এখান পর্যন্ত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে- যা করার করেছি। এখন এখানে আছি। ৩২ নম্বর, গণভবন, এই আওয়ামী লীগ অফিস ভাংচুরের মধ্যে আমি আছি। আরও ছেলেপেলে আছে। এখন জেলে আছে। এখন এটা বাদ।
“ঘটনা হইল, বর্তমানে আমি এখন এখানে আছি। এই সাততলায়। এখন দেখাশোনা করা লাগতিছে। পয়পরিষ্কার করি; আর বড় ভাইদের সাথে ঘোরাফেরা করা লাগে, এই।
“একবছর এখানেই আছি। আজ পর্যন্ত আমাকে কেউ বলে নাই নেমে যেতে।”
এক প্রশ্নের উত্তরে নশু বলেন, “আমার এখন থাকার জায়গা নাই। বিল্ডিংটা একটু দেখাশোনা করা লাগে; আর পয়পরিষ্কার করতেছি।”
বড় ভাইরা কারা? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, “একটা হল মুন্না, আর বহুতগুলা আছে। সবার তো নাম জানি না।”
পরিষ্কার করার টাকা কারা দেয়? নশু বললেন, “একজনের নাম সাখাওয়াত। উনার পরিচয়, এখানকার ইনচার্জ। তিনি নিজ স্বাধীনভাবে এখানে থাকেন।
“এখানে টোটাল ৯ দিন কাজ করেছি। একদিন বারোজন, একদিন নয়জন আর বাদবাকি ছয়জন কইরা।”
প্রতিদিন ৭০০ করে টাকা পান জানিয়ে নশু বলেন, ‘বড় ভাইয়েরা’ দু-দিন পরপর টাকা দেন। কোনো টাকা বাকি নাই।
তাদের দিয়ে কার্যালয়টি আসলে আওয়ামী লীগই দখল করে রেখেছে- এমন গুঞ্জনের বিষয়ে নশু বলেন, “না; আওয়ামী লীগের কোনো অবজেকশনই নাই এখানে।
“এখন এখানে আপনিও যদি বলেন, ‘আপনি আওয়ামী লীগ’…মোবাইল সার্চ করা হবে। ফেইসবুক ঘাঁটা হবে। সবকিছু ডিটেইল বার করার পরে আপনি যদি অরিজিনাল আওয়ামী লীগ হন, তাহলে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হবে। আর যদি না হন, আপনাকে কিছুই বলা হবে না।”
এ পর্যন্ত এভাবে কাউকে ধরা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে নশু বলেন, “হ্যাঁ; এ পর্যন্ত শয়েক-দু’শো গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিল্ডিং থেকে। আসছে, ছবি তুলছে।
“আমরা তাদের আটকাইছি। মোবাইল দেখছি। দেখার পরে, সবকিছু দেখছি যে, শিওর যে- আওয়ামী লীগ করে, তখন প্রশাসন আছে, প্রশাসনের হাতে তুলে দিছি।”
তবে এমন কাউকে মারধর করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, “মাইর দিয়া কী করুম?”
কাদের নেতৃত্বে এ ধরপাকড় চলে? নশুর উত্তর, ‘ছাত্র’।
তিনি বলেন, “আমরা যতটুকু জানি, আওয়ামী লীগের এখানে কোনো ফ্যাক্ট নাই। এই জায়গায়।”
‘ইউল্যাবে ইন্টারমিডিয়েট’ করা এক দখলদার
ভবনের উপর থেকে নামার পথে দ্বিতীয় তলায় ফের কথা হয় কথিত শিক্ষার্থী সিয়ামের সঙ্গে।
তিনি বললেন, “এখানে অবস্থান করতেছি আজকে ১৮ দিন হবে। এখানে ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’-এর ব্যানারে চলছে পরিষ্কার কার্যক্রম। তারপরে জুলাইয়ের আহতদের কর্মসংস্থানের জন্য এখানে পুনর্বাসন করা হবে। যাতে করে তারা কিছু একটা করে খাইতে পারে।
“এখানে এতিমখানা হবে। একেকটা ফ্লোর একেকটা সেক্টর হবে। এতিমখানা হবে। তারপরে আপনার মসজিদ হবে। কালচারাল হাব হবে। লাইব্রেরি হবে। একেকটা ফ্লোর একেকটা ডিপার্টমেন্ট হবে।”
পরিকল্পনা কীভাবে বাস্তবায়ন করবেন? সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া হয়েছে? সিয়াম বললেন, “সেটার জন্য, হ্যাঁ, সরকারের আবেদন করা হইছে। তবে এখন পর্যন্ত আমরা কোনো সঠিক তথ্য- আমরা পাই নাই।”
সরকারের কোন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা আমি সঠিক বলতে পারব না। সেটা আমার সিনিয়র যারা আছে, তারা জানে।”
তহবিল কোত্থেকে আসবে? সিয়াম বলেন, “বিল্ডিংটা আমরা চাচ্ছি, সরকারের হাতে এটা হস্তান্তর করব। যাতে তারা উদ্যোগ নিয়ে আমরা যেমনটা চাই, জুলাই আহতদের পুনর্বাসন, সেটা যতো দ্রুত সম্ভব করার জন্য। এটা ছয় মাস, এক বছর যতদিন লাগে। যত দ্রুত সম্ভব।”
এখানে ছাত্ররা কতজন আছেন? সিয়াম বললেন, “প্রায় অনেকজনই আছে। পরিচ্ছন্ন কর্মী যারা আছেন, উনারা এখন ক্লিনিংয়ের কাজ করছেন আপাতত। আর আমরা অবস্থান করতেছি প্রায় অনেকজনই। সঠিক সংখ্যা আমার জানা নাই।”
কোথায় পড়ছেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “আমি কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী। দেখাশোনার দায়িত্বে আছি।”
উচ্চ মাধ্যমিকে কোন কলেজ ছিল? এ প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের নাম বলেন সিয়াম। এরপর ‘ভুল করে ফেলেছেন’ বুঝতে পেরে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যান।
তার সঙ্গে থাকা হাবিবুর রহমান বলেন, “কলেজ ছিল এলাকায়।”
কোন এলাকায় জিজ্ঞাসা করলে বলেন, “কুমিল্লায়।”
কুমিল্লার কোথায়–এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘বললে তো আবার চিনে যাবেন’ বলে এড়িয়ে যান হাবিবুর।
‘ইনচার্জ মালয়েশিয়া ফেরত’, দপ্তর অদৃশ্য
নশুসহ অন্যদের সঙ্গে আলাপচারিতায় ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ এর ইনচার্জ হিসেবে একজনের নাম এসেছে। তিনি শাহ আলম। বলা হলো, তিনি মালয়েশিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই।
আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে বসবাসকারীদের কাছ থেকে পাওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করা হয় শাহ আলমের সঙ্গে। তিনি নিজেকে এ ইনস্টিটিউটটির ফিল্ড ইনচার্জ হিসেবে পরিচয় দেন।
শাহ আলম বলেন, “এখন একটু ক্লিনিং (ভবনটির) প্রসেসটাই কন্টিনিউ করতেছি। বুঝে নিতে হবে কোনো সহায়তা ছাড়া, অনুদান ছাড়া এ ধরনের কাজ করা সম্ভব না। আমাদের নিজস্ব ফাইন্যান্স থেকে যতটুকু করা সম্ভব- আমরা তা করতেছি।”
অর্থায়ন কি নিজেরাই করছেন? নাকি অন্য কোথাও থেকে আসছে? কথিত ইনচার্জ বললেন, “ক্রাউড ফান্ডিং এখনো করি নাই। এখন ওই যারা এটার সঙ্গে জড়িত আছেন, তারাই আরকি নিজেদের ওই বেতন আছে, যারা জব করে, তাদের বেতন থেকে চাই। তারা কিছু দিতেছে। যারা ব্যবসা করে, সেখান থেকে কিছু দিতেছে এই আরকি।”
আপনি কী করছেন–এমন প্রশ্নে শাহ আলম বলেন, “আমার ভাই ছোটখাটো একটা অনলাইন ব্যবসা আছে।”
কোথায় পড়েছেন? শাহ আলম বললেন, “আমি মালয়েশিয়াতে পড়েছি।”
ভবনটি ব্যবহারের জন্য সরকারের কাছে কোনো আবেদন করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে উত্তরে তিনি বলেন, “সেটার… ওটা প্রসেস চলতেছে। আবেদন করা হইছে।”
কোন দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে? শাহ আলম বললেন, “ওটা কন্টিনিউয়াসলি আছে। অনুদানের জন্য হচ্ছে অনেকটা ধীরে ধীরে আগাচ্ছে।”
কোন দপ্তরে আবেদন করা হচ্ছে–ফের জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা বলতেছি ভাই, সেটার জন্য তো আমার যে সিনিয়র লোক আছে; তারা যেভাবে পারতেছে- করতেছে।”
ভবনটি নিয়ে এখন কী ভাবনা, কোন তলায় কী করা হবে? শাহ আলম বললেন, “দেখেন উদ্দেশ্যটা হচ্ছে এটা টোটালি রিফর্ম করা। রিফর্ম করে একটা এই যে, যেটা আমাদের আছে আন্তর্জাতিক গণহত্যা এবং ফ্যাসিজমের যেটা আছে, ইনস্টিটিউট আছে, তার এইটা একটা অফিস করে এবং আরও অন্যান্য কালচারাল অফিস করা এখানে।
“যেমন হচ্ছে- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য একটা অফিস বরাদ্দ করা। যারা আহত আছে, যাদের ফ্যামিলিতে নিহত হয়েছে এবং আশেপাশের যে ছিন্নমূল যারা আছে, এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।”
আপনিই কি এ সংস্থার প্রধান? উত্তরে তিনি বললেন, “না। ফিল্ড ইনচার্জ। সিনিয়র আছে। সিনিয়র আছে, বিভিন্ন ব্যবসায়ী আছে। তারাই সরকারের সঙ্গে আলাপ করতেছে।”
শাহ আলম আর কোনো ‘সিনিয়রের’ নাম বলতে চাননি।
কী বলছে সরকারি দপ্তর
আওয়ামী লীগ অফিসের বরাদ্দ সরকার বাতিল করেছে কি না–এ প্রশ্নের উত্তর জানতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত সচিব নজরুল ইসলাম সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগের কার্যালয় ব্যবহারের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ আবেদন করেনি।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের ইজারা বাতিল করা হয়নি, কাজেই নতুন করে কাউকে বরাদ্দও দেওয়া হয়নি।”
ওই ভবনে গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ আছে কি না–এমন প্রশ্নের উত্তরে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর অনুবিভাগের যুগ্ম সচিব হারুন-অর-রশীদ বলেন, “এরকম কিছু হচ্ছে বলে আমার কাছে কোনো তথ্য নাই।”
গত বছরের ৫ অগাস্টের পর ‘জুলাই যোদ্ধা’ পরিচয়ে একাধিকবার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ব্যানার টানানো হয় বলে জানিয়েছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, “আমরা এ পর্যন্ত সাতটি গ্রুপের তথ্য পেয়েছি; যাদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে ব্যানার টানিয়ে অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এদের নিজেদের মধ্যেও ঝামেলার তথ্য শুনেছি।”
তবে এসব পক্ষের নাম ও তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের তথ্য দিতে পারেননি পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
তার ভাষ্য, কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না দেওয়ায় এবং জুলাই আন্দোলনের ব্যানারে বিভিন্ন সময়ে কিছু যুবকের অবস্থানের কারণে পুলিশ ‘খুব বেশি’ খতিয়ে দেখেনি।
সবশেষ গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউটের নামে কারা ওই কার্যালয় দখল করে রেখেছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই পুলিশের কাছে।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার মো. শাহরিয়ার আলী বলেন, “আপনারা যতটুকু জানেন, আমরাও ততটুকুই জানি। এরা কারা এ বিষয়ে আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।”
ওই কার্যালয়ে যাওয়া মানুষজনের মোবাইল তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদ করে আওয়ামী লীগ ‘সংশ্লিষ্টতা’ সন্দেহে প্রায় দুইশজনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার যে দাবি করেছেন নশু, তা ‘সত্য নয়’ বলে দাবি পুলিশের।
উপকমিশনার শাহরিয়ার আলী বলেন, “সেখান থেকে কাউকে আটক করে আমাদের হাতে দেওয়া হয়নি। আর সেখানে কারা আছে, তারা কেন মানুষের মোবাইল তল্লাশি করবে? তারা কেন কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে? এটাতো তাদের কাজ না, পুলিশের কাজ।”
আওয়ামী লীগের কার্যালয় যেভাবে গুলিস্তানে
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের অফিস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত আটবার। পুরান ঢাকার কে এম দাশ লেনের রোজ গার্ডেনে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগ।
শুরুর দিকে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাসায় বসে দল পরিচালনার নীতি-কর্মসূচি গ্রহণ করা হত, কোনো কার্যালয় ছিল না।
১৯৫৩ সালে কানকুন বাড়ি লেইনে অস্থায়ী একটি কার্যালয় ব্যবহৃত হত। ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকার ৫৬, সিমসন রোডের ঠিকানায় যায় আওয়ামী লীগের কার্যালয়।
১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯১, নবাবপুর রোডে দলীয় কার্যালয় নেন। এর কিছু দিন পর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে বসা শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পরে পুরানা পল্টনে দুটি স্থানে দীর্ঘদিন দলের কার্যালয় ছিল।
১৯৮১ সালের দিকে শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা হয় তখনকার ২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ। তারপর সেখানেই আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ের স্থায়ী ভবন করা হয়।
পুরনো ভবনটি ভেঙে ফেলা হয় ২০১৬ সালে। ওই জমিতে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে দৃষ্টিনন্দন দশ তলা ভবন নির্মাণ করা হয় আওয়ামী লীগের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।
২০১৮ সালের ২৩ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা ভবনটি উদ্বোধন করেন।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর ভবনটির লিফট থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত স্টিল, তার ও লোহাজাতীয় অংশ খুলে নেওয়া হয়।
নিকট অতীতেও বিভিন্ন জিনিসপত্র যন্ত্র দিয়ে কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন অবশিষ্ট আছে কেবল ইটের দালান।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী পরিচয়দানকারী নশু সর্দারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তারা এখানে থাকতেও কীভাবে বিভিন্ন জিনিস খোয়া যাচ্ছে।
উত্তরে তিনি বলেন, “শয়তানে কাটছে আর ইবলিশে নিয়ে গেছে। আর ভাইঙ্গা কিছু বলতে পারুম না। বুইঝ্যা লন।”
ভবনটির প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত প্রতিটি তলার আয়তন ৪ হাজার ১০০ বর্গফুট। চতুর্থ তলা থেকে ওপরের সবগুলো তলা ৩ হাজার ১০০ বর্গফুটের।
দ্বিতীয় তলায় মাঝখানে কনফারেন্স রুম আর দুই পাশে বেশ কিছু কক্ষ করা হয়েছিল। কনফারেন্স রুমে ৩৫০ জনের বসার ব্যবস্থা ছিল।
তৃতীয় তলায় ২৪০ জনের বসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। এই তলার সামনের অংশে ছিল ‘ওপেন স্কাই টেরেস’। আর ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলা বরাদ্দ ছিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সহযোগী-ভ্রাতৃপ্রতীমসহ সমমনা অন্যান্য সংগঠনের কার্যালয়।
চতুর্থ ও পঞ্চম তলায় সাজানো হয়েছিল দলের অফিস, ডিজিটাল লাইব্রেরি ও মিডিয়া রুম। ষষ্ঠ তলায় সম্মেলন কক্ষ। সপ্তম তলা বরাদ্দ করা হয়েছিল দলের কোষাধ্যক্ষের জন্য।
অষ্টম তলায় সাধারণ সম্পাদকের অফিস। নবম তলায় বসতেন দলের সভানেত্রী। তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে এ ফ্লোরটি ‘বুলেটপ্রুফ’ করা হয়েছিল। দশম তলায় ছিল কাফেটেরিয়া।
দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের জন্য রাখা হয়েছিল সুপরিসর কক্ষ। সভাপতির কক্ষের সঙ্গে বিশ্রামাগার ও নামাজের জায়গা রাখা হয়েছিল।
এছাড়া ভবনে ব্যবস্থা করা হয়েছিল ভিআইপি লাউঞ্জ, সাংবাদিক লাউঞ্জ, ডরমিটরির। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত পুরো ভবনটি ওয়াইফাইয়ের আওতায় ছিল।