একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়েই একটি বৃহত্তর ‘নির্বাচনি সমঝোতায়’ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে দেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি দলগুলো। কোনও কোনও দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনি জোট গঠনের প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানো হলেও বড় দলগুলো চাইছে ‘সমঝোতা’। এই সমঝোতার রূপ কী হবে, বেশ কয়েকটি দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে একটি আভাস পাওয়া গেছে।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামি দলগুলোর একটি ঐক্য প্রচেষ্টার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জামায়াত জানিয়েছে, বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।
ইসলামী দলগুলোর প্রভাবশালী নেতারা বলছেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতির পর মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষের চাহিদা ইসলামপন্থি দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম হোক। স্বাধীনতার ৫৩ বছর তিনটি দল দেশ পরিচালনা করেছে। মানুষ তিনটি দলকে দেখেছে। এখন ইসলামপন্থিদের ক্ষমতায় দেখতে চায়। বড় দলগুলোর পারফরম্যান্স দেখে তারা আশাহত হয়েছে।’
একটি ধর্মভিত্তিক দলের অন্যতম একজন নেতার ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে মাথায় রেখে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ইসলামী ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘এক মঞ্চ' বা ‘ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে’ আনা যায় কিনা, তা নিয়ে কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে যাত্রাবাড়ী বড় মাদ্রাসায় ইসলামপন্থি দলগুলোর একটি বৈঠকও হয়েছে। সেখানে দলের আমির, নায়েবে আমিরসহ শীর্ষ নেতারা উপস্থিত থেকে জোট গড়ার জোরালো প্রস্তাব দেন।’
‘এখন থেকে আমরা সবাই একে অপরের জন্য। সবাই সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থাকবো ইনশাআল্লাহ। অতীতের কোনও আচরণের জন্য আপনারা যদি সামান্য কষ্ট পেয়ে থাকেন, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই। আশা করি আপনারা আমাদের ক্ষমা করে দেবেন।’ গত বছর সরকারের পতনের পর ১৮ আগস্ট রাজধানীর মগবাজারে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-উলামা, পীর-মাশায়েখের সঙ্গে আমিরে জামায়াতের মতবিনিময় সভায়’ এমন বক্তব্য ছিল ডা. শফিকুর রহমানের।
ডা. শফিকুর রহমানের এই আহ্বানের আগে ও পরে বেশ কিছু দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে জামায়াত। এসব বৈঠকে ইসলামি রাজনীতির অনুসারী দলের মধ্যে ছিল খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজি আন্দোলন, মাজারভিত্তিক সংগঠন জাকের পার্টি, ১২ দলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন ইকরাম, ইসলামী ঐক্যজোটের (একাংশ) চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব আব্দুল করিম।
এসব বৈঠকে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্মে আনার আলোচনার সূত্রপাত করে জামায়াত। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কওমি মাদ্রাসার আলেম ও রাজনীতিকদেরও আমন্ত্রণ করা হয়। এরপর দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা যেকোনও ছাড়ের বিনিময়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখেন।
জানতে চাইলে সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দিক থেকে এখনও নির্বাচনি কোনও রোডম্যাপ প্রকাশ করা হয়নি। এসব যদি প্রকাশ্যে আসে তাহলে এর রূপ সম্পর্কে বলা যাবে।’
সদ্যই রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী। মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের এই নায়েবে আমির বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘মনে হয় নির্বাচনি একটি সমঝোতা বা জোট হবে। বিক্ষিপ্তভাবে যা শুনছি, বুঝতে পারছি।’
এই ঐক্যে জামায়াত থাকছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মুহিউদ্দিন রব্বানী বলেন, ‘জামায়াত সহকারেই হবে। আমাদের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐক্য দ্বারপ্রান্তে। শেষ পর্যন্ত কী হয়, তা এখনও বলার সময় আসেনি। সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ প্রকাশ করার পর এসব প্রসঙ্গ আসবে।’
ইসলামী আন্দোলনের একজন নেতার ভাষ্য, নির্বাচনি জোট না হয়ে নির্বাচনি সমঝোতা হতে পারে। যেহেতু কেউ কারও প্রতীক ব্যবহার করছে না বা করবে না, সেখানে প্রতীক দলীয় থাকবে। তবে আসনকেন্দ্রিক সমঝোতা হতে পারে, এক আসনে এক ইসলামপন্থি।
দলটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে ভেদাভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করতে হবে, এটিকে সামনে রেখে ইসলামী সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় ও যোগাযোগ শুরু করে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট একাংশ, গণ-অধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। যার মূল লক্ষ্য হলো আগামী সংসদ নির্বাচন। ইসলাম, দেশ ও মানবতা—এই তিনটিকে বেসিক ধরে ইসলামী আন্দোলন জোট গঠনে অগ্রসরমান।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সহকারী মহাসচিব মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘জোট ও মহাজোটের বাইরে থাকা বড় ইসলামপন্থি দল হিসেবে পরিচিত ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ রাজনীতিতে বেশ সক্রিয়। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল এমন কয়েকটি ইসলামি দলকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে একত্রিত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন তারা। ইতোমধ্যে কয়েকটি দলের সঙ্গে মতবিনিময়ও হয়েছে। মতবিনিময় চলমান রয়েছে।’
মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে সামনে নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হয়, তার ওপর। তবে ইসলামী সংগঠনগুলোর উপলব্ধি হলো— মাঠের জনগণ চায় আমরা এক হই। এটাকে বিবেচনায় নিয়ে কথাবার্তা চলছে। তবে কোন ফরম্যাটে কী হবে, তা নির্ভর করবে নির্বাচন কেমন হয় তার ওপর।’
দেশে প্রায় শতাধিক নামে-বেনামে ইসলামি দল ও জোট রয়েছে। নির্বাচন এলেই এসব জোট সক্রিয় হয়ে ওঠে। কওমি মাদ্রাসার বাইরে অন্যান্য সুফি ও তরিকতপন্থি দলগুলো নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনও পরিকল্পনা সামনে আনেনি।
কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক দলগুলোর মধ্যেও ছোট ছোট কিছু দলকে ইসলামি জোটের বাইরে রাখার চেষ্টা করছে একটি বড় দল। এক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায়, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে মনে করেন একাধিক দলের প্রভাবশালী নেতা।