Image description

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে বিভেদ দেখা যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু নির্বাচন ঘিরে। প্লাটফর্ম থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে এবার তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্যানেল থেকে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে দলের অমতে প্রার্থী হওয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকার দল থেকে বহিষ্কারও হয়েছেন। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব যারা দিয়েছে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনে চমক দেখাতে পারলে এনসিপির রাজনীতিতে ইতিবাচক সাড়া ফেলবে, এমন ধারণা এনসিপি নেতাদের মধ্যে শুরু থেকে ছিল। যে কারণে ক্যাম্পাসগুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে যে সব আন্দোলন হয়েছে, সেখানে নেতৃত্বেও ছিল বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ডাকসুর নির্বাচনি প্রক্রিয়া শুরুর পর দেখা গেছে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী ও এনসিপির কেউ কেউ আলাদা তিনটি প্যানেলে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

এতে অন্তত এটি স্পষ্ট হচ্ছে যে একদিকে যেমন নিজ দলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে এনসিপি, অন্যদিকে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বিভেদ আরো স্পষ্ট হচ্ছে। তবে কোন্দল বা বিরোধ হিসেবে না দেখে একে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য হিসেবেই দেখছে এনসিপি।

এনসিপির সদস্যসচিব ও সাবেক ডাকসু নেতা আখতার হোসেনবলেছেন, ক্যাম্পাসগুলোয় আবহ তৈরি হয়েছে। ভয়ের পরিবেশ নেই। যে কারণে প্রার্থীর সংখ্যা বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যেকোনো দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে হলে অনেকগুলো শর্তের প্রয়োজন হয়। যেটি এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বের মধ্যে না থাকায় ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিরোধ ও বিভেদ বাড়ছে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

তিন প্যানেলে বৈষম্যবিরোধী নেতারা

গত বছরের জুলাই অগাস্টে কোটা সংস্কারের দাবিতে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তীব্র আন্দোলনে অসংখ্য প্রাণহানির পর গত বছরের তেসরা অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

আন্দোলনের মুখে ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসগুলো ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পরে ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরই মধ্যে ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, বামজোটসহ বিভিন্ন সংগঠন।

এর পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের গঠিত ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদও ডাকসু নির্বাচনের মনোনয়ন সংগ্রহ করে।গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের প্যানেলে ভিপি পদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক দুই সমন্বয়ক আবদুল কাদের ভিপি পদে এবং জিএস পদে আবু বাকের মজুমদার মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। এই প্যানেল থেকে এজিএস পদে আশরেফা খাতুন নির্বাচন করবেন। তাঁরা প্যানেলের নাম দিয়েছেন ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’।

মনোনয়ন সংগ্রহের পর সোমবার রাতে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহবায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের সাথে ছিলাম। আমরা আশাবাদী ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা আমাদের তাদের মূল্যবান ভোট দিয়ে আমাদের নির্বাচিত করবেন।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র ছিলেন উমামা ফাতেমা। গত জুনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। এবার ডাকসু নির্বাচনে উমামা নেতৃত্বাধীন একটি প্যানেল আলাদাভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। এই প্যানেল নির্বাচনে লড়ছে ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ ব্যানারে।

উমামা ফাতেমা ভিপি পদে নির্বাচন করছেন। এই প্যানেল থেকে জিএস ও এজিএস পদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির আরও দুজন নেতা নির্বাচন করছেন জিএস ও এজিএস পদে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব পদে ছিলেন মাহিন সরকার।

সরকারও ‘ডিইউ ফার্স্ট’ নামে স্বতন্ত্র প্যানেল ঘোষণা করেছেন। তিনি জিএস পদে নির্বাচন করবেন। তাঁর প্যানেলে ভিপি পদে নির্বাচন করবেন ‘স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্রসংসদের’ নেতা জামালুদ্দীন মুহাম্মাদ খালিদ।

পরিস্থিতি গড়িয়েছে বহিষ্কার পর্যন্ত
এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মাহিন সরকার ডাকসু নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। এ বিষয় সামনে আসার পর সোমবার রাতেই ‘গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগ' এনে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে এনসিপি।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাহিন সরকার দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের নির্দেশক্রমে তাকে পদ ও দায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

এতে আরও জানা হয়, বহিষ্কারাদেশটি অবিলম্বে কার্যকর হবে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে।

এর কিছুক্ষণ পরই সালেহউদ্দিন সিফাত গণমাধ্যমে একটি বার্তায় জানান, ডাকসু নির্বাচনে মনোনয়ন গ্রহণের আগে মাহিন সরকার দলের শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে অনুমতি নেননি। এটি দলীয় শৃঙ্খলার গুরুতর ব্যত্যয় হিসেবে গণ্য হয়েছে। মাহিন সরকারের কাছে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি সাড়া দেননি।

তবে মাহিন সরকার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে একটি পোস্ট দিয়ে জানান, ‘আজকে কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই বহিষ্কার করে দিলেন। সর্বোপরি, মাহিন সরকার তাদের একজন যার হাতে অভ্যুত্থানের ব্যানার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গঠিত হয়েছিলো। অন্তত আমার কথাগুলো বলার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। যদি গুরুতর আর্থিক অনিয়ম কিংবা চারিত্রিক স্খলনের মতো অভিযোগ থাকে তারপরও সংগঠনসমূহে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। আমি সে সুযোগও পাইনি, এটা সামগ্রিকভাবে নবগঠিত রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষতিকর হয়ে গেল।’

এ নিয়ে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা জানান, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে শীর্ষ নেতৃত্বকে ম্যাসেজ দিয়ে জানিয়েছিল মাহিন সরকার। তবে জাতীয় রাজনীতির নেতা মাহিন সরকারকে ডাকসু নির্বাচনের প্রার্থী হতে না করেছিল এনসিপি।

যে কারণে প্রার্থী হওয়ার পর তাকে গুরুত্বর শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে বহিষ্কার করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে এনসিপি।

চাপে পড়েছে এনসিপি?
গত বছরের অগাস্টে শেখ হাসিনা সরকার পতনের ছয় মাস পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে যাত্রা শুরু করে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও নেতা-কর্মীদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল এনসিপি।

রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যাত্রা শুরু করলে ক্যাম্পাসগুলোতে সক্রিয় ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মটি। যার বর্তমান নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক সমন্বয়ক রিফাত রশীদ। এর পাশাপাশি এনসিপির ছাত্র সংগঠন হিসেবে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ বা বাগছাস।

শেখ হাসিনা পতনের আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা প্রমাণের একটি ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট নিয়ে এগুচ্ছিল বলে এনসিপির এক নেতা জানিয়েছিলেন বিবিসিকে।

যে কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চারও ছিল তারা। বৈষম্যবিরোধীদের পাশাপাশি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে শিবিরও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হয়। এক পর্যায়ে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাও করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু ডাকসু নির্বাচনে অন্তত তিনটি প্যানেল থেকে এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা প্রার্থী হওয়ার পর এ নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে আছে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলটি।

এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন অবশ্য বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের নেতৃবৃন্দ যদি নিজেরা বসে নিজেদের আলাপ আলোচনা মধ্য দিয়ে প্যানেলের সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারতো তাহলে হয়তো সেটা আরেকটু ভাল হতে ‘। কিন্তু কেন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি নিজ দলের নেতাকর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারল না?

এর জবাবে এনসিপি নেতা আখতার হোসেন বলেন, ‘এই প্লাটফর্মে অনেক ঘরাণার মানুষ ছিল। তাদের একটা বড় অংশ অভ্যুত্থানের পর এনসিপির সাথে যুক্ত হয়েছে। সবাইকে যদি আমরা এক সাথে পেতাম তাহলে হয়তো অবশ্যই ভালেঅ হতো।’

ডাকসু নির্বাচন ঘিরে কেন্দ্রীয় নেতাকে বহিষ্কার কিংবা তিনটি প্যানেলে বিভক্ত হলেও এনসিপির এই নেতা মনে করছেন তা দলের জন্য বড় কোনো সংকট তৈরি করবে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য না থাকার কারণে দলের মধ্যে শুরু থেকে কোন্দল ও বিভেদ স্পষ্ট হয়েছে। যেটি আরো প্রকট হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে।

বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এনসিপির রাজনৈতিক লক্ষ্য বা কর্মসূচি এখনো স্পষ্ট না। বহু তারা যদি তাদের রাজনীতি স্পষ্ট না করে তাহলে তো টেকার কোন কারণ দেখি না।’

ফলে দলটিতে ভবিষ্যতেও দলটি এরকম সংকটের মুখোমুখি হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা