Image description

পুরনো রাজনীতিকদের সম্পর্কে একটি অভিযোগ আছে, তারা মাঠে কর্মীদের মন চাঙ্গা করতে যত গরম কথাই বলুন না কেন, ভেতরে ভেতরে আপসের জন্য প্রস্তুত থাকেন। স্বাধীনতার পর দুই সামরিক শাসকের আমলে এটি বেশি দেখা গেছে। মাঠে গরম বক্তৃতার মাধ্যমে সরকারকে এই বার্তাই দিতে চান যে, তাদের পেছনে বিপুল জনসমর্থন আছে, কোনোভাবে অগ্রাহ্য করা যাবে না।
সমপ্রতি এনসিপি নেতাদের কঠিন কথাবার্তা শুনেও মনে হচ্ছে, যা তারা মাঠে বলছেন, তা আসল কথা নয়। আসল কথা হলো দরকষাকষি। অর্থাৎ নতুনেরাও পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস যেদিন মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে জানিয়ে দিলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে আমরা প্রস্তুত, নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করে দিয়েছি,’ সেদিনই ঢাকায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।’


এটি অন্তর্বর্তী সরকার ও সরকার প্রধানকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ। একজন রাজনীতিক যত ক্ষমতাধরই হোন, তিনি বলতে পারেন না, নির্বাচন হবে না। বরং তিনি বলতে পারেন নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে সরকারকে কী কী করতে হবে। সরকার সেই দাবি-দাওয়া পূরণ না করলে তারা নির্বাচন বর্জনেরও ঘোষণা দিতে পারেন।


আর যদি এটা দরকষাকষির অংশ হয়ে থাকে, তাহলে আপত্তির কিছু নেই। সরকারের কাছ থেকে দাবি- দাওয়া আদায় করার জন্য রাজনীতিকরা অনেক কিছুই করে থাকেন। এনসিপি’র নেতা হয়তো তারই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন।  যেই যুবসম্মেলনে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সরকারকে চরমপত্র দিলেন, সেই সম্মেলনে এনসিপি প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে ছাড় দিলেও জুলাই সনদে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।


প্রথম আলো’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৫ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস যে জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন, তা নিয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায়নি জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তবে জুলাই জাতীয় সনদ নিয়ে তারা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। এই সনদের আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়নের পদ্ধতির ব্যাপারে এনসিপি ছাড় দিতে রাজি নয়। এনসিপি’র নেতারা বলেছেন, জুলাই সনদের বিষয়টি সুরাহা হওয়ার পর তারা নির্বাচনমুখী কার্যক্রমে মনোযোগ দেবেন।


এনসিপি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র, নির্বাচনের সময় নির্ধারণসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিএনপি’র চাওয়াকেই প্রাধান্য দিয়েছে সরকার। এখন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিএনপি যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সে জন্য দলটির ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করতে চায় এনসিপি। সংস্কার ও বিচারকাজ শেষ করেই নির্বাচন হতে হবে বলেও মন্তব্য করেন এনসিপি’র এই নেতা। অবশ্য তার এ বক্তব্য ব্যক্তিগত না দলীয় পরিষ্কার নয়। জামায়াতের মতো এনসিপিও আনুপাতিক ভোটের কথা বললেও সারা দেশে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির সময় নিজেদের সম্ভাব্য প্রার্থীর নামও ঘোষণা করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কিছুটা বেকায়দায় থাকা এনসিপি’র নেতাকর্মীদের মনোভাব চাঙ্গা করতে কিংবা অন্যান্য দলের সঙ্গে দরকষাকষি বাড়াতেও তারা এ কৌশল নিতে পারে।


লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এগুলো একেক দলের রাজনৈতিক অবস্থান। প্রতিটি দলই নির্বাচনী দৌড়ে আছে। এ জন্য তারা পরস্পরকে চাপে রাখবে, এমনকি সরকারকেও চাপে রাখবে- এটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেন, আজকে এনসিপি যদি মনে করতো তারা নির্বাচন করে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬০ আসন পাবে, তারা পিআরের পক্ষে বলতো না। আবার বিএনপি যদি মনে করতো তারা ৭০ আসন পাবে, তারা পিআরের পক্ষে বলতো। আসলে ভোটের হিসাবনিকাশেই রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী কৌশল নির্ধারিত হয়। এনসিপি’র নির্বাচনে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটি সমস্যা হলো দলটি এখনো নিবন্ধন পায়নি।


প্রধান উপদেষ্টা ৫ই আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছিলেন। নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে তার দপ্তর থেকে নির্বাচন কমিশনে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।


এবারের নির্বাচনী মাঠে আওয়ামী লীগ থাকছে না। সরকার নির্বাহী আদেশে দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। সেক্ষেত্রে ভোটের মাঠে বিএনপি’র প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবে? ধারণা করা হচ্ছে, জামায়াতই হবে বিএনপি’র প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে এই দুই দলের মধ্যে নির্বাচনী সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জামায়াত ইতিমধ্যে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে ও প্রচারও চালাচ্ছে। অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে জামায়াত নির্বাচনী সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগি করতে পারে। এনসিপি সে সমঝোতায় নিজেকে যুক্ত করবে, না এককভাবে ভোট করবে, তা পরিষ্কার নয়। এনসিপি’র রাজনীতি যারা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা বলেছেন, যেই দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা লাভজনক হবে, সেই দলের সঙ্গেই তারা যাবে। দাবি-দাওয়ার বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে যত মিল থাকুক না কেন, এনসিপি নিজেকে মধ্যপন্থি দলই মনে করে। সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো ইসলামী দলের সঙ্গে সখ্য করলে তাদের লাভ-ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় থাকবে।
জামায়াত, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এলেও আগামী নির্বাচনে এটি সম্ভব নয়। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের ২ ধারায় আছে, ‘একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী তিন শত সদস্য লইয়া সংসদ গঠিত হইবে।’ সে ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে নির্বাচন করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে।


সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রথমে সংবিধান পুনর্লিখনের কথা বললেও পরবর্তী আলোচনা বর্তমান সংবিধানকে ভিত্তি ধরেই এগোচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় উচ্চকক্ষে আনুপাতিক হারে ভোটের বিষয়ে মোটামুটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিম্নকক্ষের বিষয়ে আলোচনা হয়নি।
নির্বাচনের ঘোষণা ইতিবাচক হলেও মাঠের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘিরে সংশয় এখনো কাটেনি বলেই মনে করে অনেক দল। তারা বলছে, বিদ্যমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে।


ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভে ৩’-এর ফলাফলে দেখা যায়, ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ বলছেন, কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। গত বছরের অক্টোবরে ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। কাকে ভোট দেবেন, তা বলতে চান না ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ। আর ভোট দেবেন না বলেছেন ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নির্বাচনের দিন-তারিখ কাছাকাছি ভোটারের মনস্থির করার কথা। তাহলে ভোটারদের মধ্যেও কি নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় রয়ে গেছে?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেন-এ প্রশ্নে ১২ শতাংশ বিএনপি, ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী ও ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ জাতীয় নাগরিক পার্টির কথা বলেছেন। আট মাস আগে গত অক্টোবরে একই প্রশ্ন করা হলে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ বিএনপি, ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ জামায়াত ও ২ শতাংশ মানুষ এনসিপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ আট মাস পর বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কিছুটা কমেছে আর এনসিপি’র ভোট সামান্য বেড়েছে।


জরিপে গত অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ভোট দেয়ার কথা বলেছিলেন। সেটি এখন কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আপনার নির্বাচনী এলাকায় কোন দলের প্রার্থী জিতবে বলে মনে হয়-এমন প্রশ্নে ৩৮ শতাংশ মানুষ বিএনপি’র কথা বলেছেন। এ প্রশ্নের উত্তরে ১৩ শতাংশ মানুষ জামায়াত ও ১ শতাংশ এনসিপি’র কথা বলেছেন। আর আওয়ামী লীগের কথা বলেছেন ৭ শতাংশ মানুষ। গত ১ থেকে ২০শে জুলাই পর্যন্ত সময়ে এই জরিপ চালানো হয়।
এই জরিপে এনসিপি’র ভোট সামান্য বাড়ার কথা বলা হলেও সেটি কোনোভাবে বিএনপি, জামায়াত বা কার্যক্রম নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের কাছাকাছি নয়। এটাও এনসিপিকে নতুন ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। ফলে দরকষাকষির রাস্তাটি খোলা রাখতে চায় দলটি।


নির্বাচনের ঘোষণাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র, সংস্কারপ্রক্রিয়া ও জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার ঘিরে মতভেদ রয়েছে কোনো কোনো দলের মধ্যে। এ ছাড়া নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়েও রয়েছে সংশয়।


আগামী বছর ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের তোড়জোড় শুরু হলেও নির্বাচন ঘিরে এখনো সংশয় কাটেনি বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না সংকটের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু নির্বাচনকালে ল’ অ্যান্ড অর্ডারের ইস্যুটা নিয়ে সংশয় আছে।’


প্রায় সব দলের নেতারা যে আরেকটি ১/১১-এর আশঙ্কা করছেন, সেটা তাদের মনের কথা নয়। বরং জনগণকে এটাই দেখানো যে, আমরা তাদের চেয়ে কম ফ্যাসিবাদবিরোধী নই। বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্ব ১৫ই আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিনে কেক কেটে উৎসব না করার আহ্বান জানিয়েছিল নেতাকর্মীদের প্রতি। একজন জাতীয় নেতার প্রতি সম্মান জানানো ও সমালোচনা এড়ানোর জন্য  কয়েক বছর ধরে তারা এই নীতি অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এই আহ্বানে অন্তত ছাত্রদলের অতি উৎসাহী নেতাকর্মীরা সাড়া দেননি। তারা ১৪ই আগস্ট রাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে মিছিল ও স্লোগান দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন, এনসিপি ও জামায়াতের চেয়েও তারা বেশি ‘আওয়ামী লীগবিরোধী’।


এবারের ১৫ই আগস্ট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ৫০তম বার্ষিকী ও বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ৮০তম জন্মদিন।