Image description

বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
========================
১৪ অগাস্ট ১৯৭৫। রাতের বেলা মা আমাকে ও পরশ-কে গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন।
গানটি ছিল-
"ও তোতা পাখিরে
শিকল খুলে উড়িয়ে দিব
আমার মা-কে যদি এনে দাও..."
পরের দিন ভোর বেলায় গুলির আওয়াজে ঘুম ভাঙল। সাড়ে তিন বছরের অবুঝ শিশু ভয়ে চিৎকার করে মা-বাবাকে খুঁজতে গিয়ে দেখে — বাবা-মা সিঁডির উপর রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে আছে। শুধু রক্ত আর রক্ত। ডুকরে ডুকরে ‘শিশুটি’ কাঁদে আর বলে - মা ওঠো, বাবা ওঠো। কিন্তু, বাবা-মা আর ওঠেনি, আর  কখনোই ফিরেনি। গত পঞ্চাশ বছর মায়ের সেই গানের  সুরই আমার স্মৃতি হয়ে রইল-


"ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে
কখন যে মা গেলো চলে..."
বুঝ আসার পর থেকেই মনের ভিতর একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও বাসনা জন্মেছিল যে, এক দিন এই দেশে আইনের শাসন এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা পাবে। যার ফলশ্রুতিতে আমিও আমার পিতা-মাতার হত্যার বিচার পাবো। একজন সন্তান এবং দেশের নাগরিক হিসেবে শুধু এটুকুই ছিল আমার চাওয়া।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল — দীর্ঘ ২১ বছর আইনের শাসন ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। সময় সময় স্থগিত ও কাঁটা-ছেঁড়া করা হয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন — সংবিধান। Indemnity Ordinance প্রণয়ন করে রুদ্ধ করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ। কেড়ে নেওয়া হয়েছে নাগরিকের বিচার পাওযার মৌলিক অধিকার। অপরাধ এবং অপরাধীকে দেওয়া হয়েছে আইনি সুরক্ষা।


তারপর এসেছিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করল। আশায় বুক বাঁধলাম। মনে হলো, এবার বুঝি স্বপ্ন পূরণের পালা!ইতোমধ্যে, আমি আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করলাম। Indemnity Ordinance বাতিল করে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংগঠিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করা হলো। তরুণ আইনজীবী হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সিরাজুল হক এর Chamber-এ যোগদান করলাম। আমার লক্ষ্য ছিল, আমি যেন উক্ত বিচার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থাকতে আরি। আমি সম্পৃক্ত হলাম।

নিম্ন আদালতের বিচারকার্য,পরবর্তীতে High Court Division এবং তৎপরবর্তী Appellate Division-এ বিচারকার্য সম্পন্ন হতে পেরিয়ে গেলো তেরোটি বছর। ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আমার জীবনের এক ঐতিহাসিক স্মরণীয় মুহুর্ত ও আনন্দের দিন হয়ে ধরা দিলো।সেই দিন Appellate Division of the Supreme Court of Bangladesh কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় প্রদান করা হলো। কাকতালীয়ভাবে সেই দিনটি ছিল আমার জন্মদিন। আমি আমার জন্মদিনের অন্যতম উপহারটি পেলাম।


এই দীর্ঘ আইনী সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধ হত্যা মামলা পরিসমাপ্তির মাধ্যমে দেশে বিচারহীনতার অবসান হবে। সূচনা হবে আইনের শাসন ও ন্যায় বিচারের পথপরিক্রমা। শুরু করা যাবে বাবা (শেখ ফজলুল হক মণি) ও মা (শামছুন্নেছা আরজু) হত্যাকাণ্ডের বিচার। কিন্তু,"“সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!"
যদিও ১৯৯৬ সালেই আমাদের বাসায় সংঘটিত আমার বাবা-মায়ের হত্যাকাণ্ডের এজাহার রুজু করা হয়েছিল। কিন্তু, আজ অবধি সেই মামলার তদন্ত সম্পন্ন হয়নি এবং অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়নি। শুরু করা হয়নি মামলার বিচারকার্য।


২০১০ সাল থেকে ১৫ অগাস্ট আসলেই সরকারের পক্ষ হতে আশ্বস্ত করা হতো যে,বিচার শুরু করা হবে, গঠন করা হবে কমিশন। দেয়া হতো আরো কত কি সান্ত্বনা ও মিথ্যা আশ্বাস! ঘটা করে মাসব্যাপী শোক পালনের আনুষ্ঠানিকতার নিচে চাপা পড়ে গেলো পিতা-মাতা হারা সন্তানের ক্রন্দন। অধরা রয়ে গেলো নাগরিকের বিচার পাওয়ার সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার।আদর্শ ও নীতি বিবর্জিত সংকীর্ণ রাজনৈতিক কূটকৌশলের কাছে পরাজিত হলো আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার।


একজন বিজ্ঞ Jurist লিখেছেন — “Justice delayed is justice denied”. তাই প্রশ্ন জাগে, আর কি কখনো হবে শেখ ফজলুল হক মণি ও শামছুন্নেছা আরজু হত্যাকাণ্ডের বিচার? আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবার কি কখনো পাবে হত্যাকাণ্ডের বিচার? হয়েছে কি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী ৩০ লক্ষ শহীদদের হত্যার বিচার? হয়েছে কি নূর হোসেন, ডাক্তার মিলন, মঞ্জুরুল ইমাম কিংবা শাহ এম এস কিবরিয়া হত্যার বিচার? বিগত ৫৪ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সংগঠিত সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম ও গণঅভ্যুত্থানে আত্মহুতি দেওয়া শহীদদের হত্যার বিচার আদৌ কি কোনো দিন সম্পন্ন হবে?
অভাগা আমি, অভাগা এই দেশ ও জাতি! কবি গুরু হয়তো সেজন্যই লিখে গিয়েছেন — "বিচারের বানী নীরবে নিভৃতে কাঁদে”।
শেখ তাপস
৩১ শ্রাবণ ১৪৩২
১৫ অগাস্ট ২০২৫