Image description

ব্যারিস্টার আরমান ভাইয়ের প্রকাশিতব্য ‘আয়নাঘরের সাক্ষী : গুম জীবনের আট বছর’ বই থেকে।

 

আমার বাবার যখন ফাঁসির রায় হয়ে গেল। তারপর অ্যাপিলেড ডিভিশনেও সে রায় বহাল ঘোষিত হলো, সর্বশেষ প্রক্রিয়া অর্থাৎ রিভিউ শুনানি চলছে, তখন আমি পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। সেটার প্রভাব আমার ব্যক্তিগত জীবনেও পড়ল। সবসময় মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকত। ছোটোখাটো বিষয়ে সবার সাথে রাগারাগি করতাম। 

 

বাবার সাথে সাক্ষাতের সময় আমার এই অবস্থার কথা বাবাকে জানালেন আমার মা। পরে আমি একদিন সাক্ষাতে গেলে বাবা আমার কাঁধে হাত দিয়ে হাসিমুখে বললেন—‘তোমার এত কীসের দুশ্চিন্তা! আমার তো এটা বোনাস লাইফ চলছে। আমার তো আরও চল্লিশ বছর আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল।’

 

তিনি তখন রসিকতা করে বললেন—‘কোনো চিন্তা করবা না। মনে রাখবা, বাংলাদেশের ফাইল আল্লাহ তায়ালা নিজে দেখেন।’ 

 

এরপর তিনি তার জীবনের কঠিন সময়ের গল্পের বাক্সটি খুললেন। বলতে লাগলেন—‘একাত্তর পরবর্তী সময়ে যখন ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেল, তখন আমরা যারা সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বে ছিলাম, তাদের জীবন সংকীর্ণ হয়ে গেল। এমনকি তাদের জীবনের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। তাদের কাউকে হত্যা করে ফেললেও কোনো জবাবদিহির বালাই ছিল না। এ সময় আমাদের আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। গোপনেই আমরা যথাসম্ভব ইসলামি আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যেতে থাকলাম। আমি আশ্রয় নিলাম এক পরিচিতজনের বাড়ির স্টোররুমে। তিনি আওয়ামী লীগার হওয়ার কারণে তার বাড়িটা আমার জন্য ছিল নিরাপদ। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। কিন্তু আমার রাজনৈতিক দর্শনের ছিলেন ঘোর বিরোধী। তার ওপর তখন চলছে ইসলামপন্থিদের ওপর ঝড়ো হাওয়া আর লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য। আমার সেই আশ্রয়দাতা ব্যক্তি মাঝে মাঝে এসে আমার সাথে এসব বিষয়ে আলাপও করতেন। 

 

যেদিন বাকশাল গঠন হয়, সেদিন তিনি একটি পত্রিকা হাতে নিয়ে আমার কাছে এসে বললেন—দেখো, বাকশাল গঠন হয়ে গেছে। তোমার ওই রাজনীতি ছাড়ো। এই দেশে তোমাদের আর রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই। বাকশাল গঠন হয়েছে মানে শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকবেন। এরপর শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল দেশ শাসন করবেন। মোটামুটি আগামী ষাট বছরের নেতৃত্ব এখন সুনির্দিষ্ট। বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা কে থামাবে? 

 

কিন্তু বাস্তবতা কী হলো দেখো! আমরা যখন আত্মগোপনে ছিলাম এবং বাকশাল কায়েম হয়ে গেল, তখন আমরা চিন্তা করলাম, আমরা তো আর স্বাভাবিক জীবনে হয়তো ফিরতে পারব না, বিয়েশাদি-ঘরসংসার হবে কি না কে জানে! হয়তো, আত্মগোপনে থেকেই আমাদের সারা জীবন ইসলামি আন্দোলনের কাজ করে যেতে হবে। অন্তত ষাট বছর পার হতে হবে। আরও অন্তত দুই প্রজন্ম পরে হয়তো প্রকাশ্যে কাজ করার কিছু সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। আমরা যখন এভাবে ভাবছি, ঠিক এর ছয়মাসের মাথায় পঁচাত্তরের আগস্টে পটপরিবর্তন ঘটল। এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা ইসলামি আন্দোলনের কাজ প্রকাশ্যে করার মতো পরিবেশ আমাদের দান করলেন। দেখো, যেখানে ষাট বছরের পরিকল্পনা মাত্র ছয়মাসে ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে, সেখানে হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই; কখনও আশাহত হবে না। হয়তো ব্যক্তিগতভাবে আমাদের ক্ষতি হতে পারে। হয়তো আমাদের ফাঁসি কার্যকর হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ভালো কিছুই অপেক্ষা করছে, ইনশাআল্লাহ।’ তিনি আবার সহাস্যে তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন—‘বাংলাদেশের ফাইল আল্লাহ নিজে দেখেন!’