Image description

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) খসড়া ভোটার তালিকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের ১১৭ নেতার নাম এসেছে। যাদের গত বছরের ১৫ জুলাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। এ ছাড়া এই অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃতদের মধ্যে সাতজন এবং মামলার ২৭ আসামিও রয়েছেন তালিকায়। যাদের মধ্যে এখন দুজন কারাগারে।

আজ সোমবার বিকেল ৪টায় ডাকসুর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে। ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, এমনটি হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে সবাইকে বাদ দেওয়া হবে।

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকাদের চিহ্নিত করতে জুলাই অভ্যুত্থানের পরে সব হলে ব্যাচভিত্তিক তালিকা করে সর্বসম্মতিক্রমে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ওই বছরই ২১ অক্টোবর ওই হামলার ঘটনায় শাহবাগ থানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাহিন সরকার একটি মামলা করেন। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তের মাধ্যমে গত মার্চে ১২৮ জনকে বহিষ্কার করে। তবে তালিকাটি অসম্পূর্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সমালোচনার মুখে আরেকটি উচ্চ কমিটি করা হয়। সেই কমিটি এখনও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। গত ৩০ জুলাই ডাকসুর নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরের দিন ৩৯ হাজার ৯৩২ শিক্ষার্থীসংবলিত খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়। 

সমকালের বিশ্লেষণে দেখা যায়, হামলার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তে ১২৮ জনকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। কিন্তু বহিষ্কৃতদের তালিকায় থাকা বিজয় একাত্তর হল ছাত্রলীগ সভাপতি সজীবুর রহমান সজীব, নিঝুম ইফতার, পারভেজ মুন্সী, বায়জিদ বোস্তামী, সাকিব হাসান, শেখ মুজিবুর রহমান হলের শাহনেওয়াজ পল্লব ও কবি জসীম উদ্‌দীন হলের আশিকুর রহমানের নাম রয়েছে খসড়া ভোটার তালিকায়।  

বিজয় একাত্তর হলে স্ট্যাম্প হাতে শিক্ষার্থীদের মারতে গিয়েছিলেন সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রোকন খান এবং একই বিভাগের নিঝুম ইফতার। ভিডিও ফুটেজে চিহ্নিত হামলাকারী হল ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ সম্পাদক এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের বায়েজিদ বোস্তামী ও মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের পিয়ার হাসান সাকিব, হল ছাত্রলীগের সভাপতি মনোবিজ্ঞান বিভাগের সজীবুর রহমান সজীব ও একই বিভাগের রেদাউন হোসেন দিপুর নামও খসড়ায় রয়েছে। এর মধ্যে দিপু ছাড়া সবার নামে মামলা রয়েছে এবং সজীব কারাগারে। 

হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামিমুল হক ফকির, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মাজেদুর রহমান, ঢাবি ছাত্রলীগের উপদপ্তর সম্পাদক নৃবিজ্ঞানের কাজী শিহাব উদ্দীন, ক্রীড়া সম্পাদক দর্শন বিভাগের পারভেজ মুন্সী, উর্দু বিভাগের ফরহাদ মিয়া, পালি ও বুড্ডিস্ট বিভাগের সোহেল রানাকেও হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন।  

এ ছাড়া গেস্টরুমে নির্যাতনকারী হিসেবে পরিচিত হল ছাত্রলীগের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাকিবুল হাসান, জাহিদুল হাসান লিয়ন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মনিরুল ইসলাম সৈকত, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ফুজায়েল আহমেদ নাঈম, সাকিবুর রহমান ও শেখ সাদী, ব্যাংকিং ও ইন্স্যুরেন্স বিভাগের আফ্রিদি আহম্মেদ, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের কাওছার হোসেন হৃদয়, ইতিহাস বিভাগের তারেক আজিজ, উর্দু বিভাগের আবু রায়হান, ইসলামিক স্টাডিজের ইমতিয়াজ আহমদ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের ফরিদ মিয়া, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের লোকমান হেকিম, স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের তৌফিকুজ্জামান, সংস্কৃত বিভাগের সাকিব হাসানের নাম রয়েছে খসড়া ভোটার তালিকায়।  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পাদক ব্যবস্থাপনা বিভাগের শাহনেওয়াজ আরেফিন পল্লব, ত্রাণ ও দুর্যোগ সম্পাদক সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শান্ত আলম এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের তৌহিদুল ইসলাম রিসাল নানা সময়ে গেস্টরুমে নির্যাতনকারী ও হামলায় অংশগ্রহণকারী হিসেবে চিহ্নিত হলেও ভোটার তালিকায় তাদের নাম এসেছে। শাহবাগ থানার মামলায় তারাও আসামি।  

শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত থাকায় অমর একুশে হলে সর্বসম্মতিক্রমে বয়কটে থাকা উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, গণিত বিভাগের রেদওয়ান ইসলাম হৃদয়, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ইফতেখারুল ইসলাম, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মর্তুজা রব্বানীর নাম ভোটার তালিকায় এসেছে। তারা সবাই পধদারী নেতা এবং মামলার আসামি। ফজলুল হক মুসলিম হলে ‘ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স’ বিভাগের সাদমান আল রিশান ও মৎস্য বিভাগের রোকনুজ্জামানের নামও রয়েছে খসড়া তালিকায়।  

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম মামলায় কারাগারে আছেন। তাঁর সঙ্গে হামলাকারী হিসেবে চিহ্নিত ভূতত্ত্ব বিভাগের মুহাম্মদ মাহাদী হোসাইন, রসায়ন বিভাগের আশিকুল আমিন আবিদ এবং ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের রাশিদ মাহমুদ মাহীর নাম এসেছে ভোটার তালিকায়।

কবি জসীম উদ্‌দীন হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আশিকুর রহমানের নামে মামলা হয়েছে। দুই বছর আগে মাস্টার্স শেষ করলেও এখন তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত হিসেবে ভোটার তালিকায় নাম এসেছে আশিকের। তাঁর সঙ্গে ব্যবস্থাপনা বিভাগের মেহেদী হাসান এবং আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের হানজালা হাই বেপারী মিশেল সরাসরি শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।  

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে নৃত্যকলা বিভাগের ২০১৫-১৬ বর্ষের মোস্তফা সরকার মিশাদ, ২০১৭-১৮ বর্ষের আব্দুল গফুর মণ্ডল এবং উর্দু বিভাগের সাদী মামুদের ব্যাচের পড়াশোনা শেষ হলেও তারা বছরের পর বছর হলে ছাত্রলীগে সক্রিয় থেকে নির্যাতনে অংশ নেওয়ার কারণে অবাঞ্ছিত করা হয়।  

হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আহমদ রেজা, আরবি বিভাগের রাহাদ ইসলাম, সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের মারুফ রেজা ইমন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের শরীফ খান, ইতিহাস বিভাগের তামজিদ ইবনে আরমিন, মার্কেটিং বিভাগের আল শাহরিয়ার মাহমুদ, বিশ্ব ধর্ম সংস্কৃতির জুবায়ের রহমান, ইসলামিক স্টাডিজের মোনতাছির হোসাইন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফারদিন বিন ফরিদ, উন্নয়ন অধ্যয়নের আহমেদ জাবির মাহাম, ব্যাংকিংয়ের ফারহান লাবিব, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের আল আমিন, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের আরাফাত হোসেন, নাট্য প্রদর্শন কলার শাকিব আহমেদ, ইসলামের ইতিহাসের রাফিউর রহমান এবং সমাজকল্যাণের এনামুল হক– সবাই পদধারী সক্রিয় ছাত্রলীগ নেতা ও ১৫ জুলাইয়ের হামলায় অংশ নেওয়ার কারণে হলে অবাঞ্ছিত। তারাও আছেন ভোটার তালিকায়। এর মধ্যে শাকিব, রাফি ও এনামুলের নামে মামলা রয়েছে।

মামলার আসামিসহ ৬ জনের নাম এসেছে এফ রহমান হলের খসড়া ভোটার তালিকায়। হামলায় জড়িত থাকায় হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের মহিবুল্লাহ লিয়নের নামে মামলা হয়েছিল। তিনিসহ হলটিতে স্টাম্প নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক সমাজবিজ্ঞানের জয়নাল আবেদীন, ইসলামিক স্টাডিজের আজিজুল হক, ঢাবি ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ইসলামের ইতিহাসের মেহেদী হাসান শান্ত, হল ছাত্রলীগের নেতা পালি ও বুদ্ধিস্ট বিভাগের শেখ সাদী সাইমন। 

রোকেয়া হল সভাপতি আতিকা বিনতে হোসাইনের সঙ্গে ছাত্রলীগের ১০ নেত্রীকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা হল থেকে বের করে দিয়েছিল ঘটনার দিন রাতেই। এই ১০ জনের মধ্যে ছাত্রলীগের বর্ণালী ঘোষ বর্ণ, সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগ নেত্রী মালিহা আফরিন সিনথিয়া, সংগীত বিভাগের সৈয়দা মেহজাবিন রেজা সারার নামও রয়েছে ভোটার তালিকায়।  

১৫ জুলাই মল চত্বরে হামলায় সূর্য সেন হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ইসলামিক স্টাডিজের হল ছাত্রলীগের উপ-কর্মসংস্থান সম্পাদক কামরুজ্জামান খান, যোগাযোগ বৈকল্যের হল ছাত্রলীগের সহসম্পাদক জাবের বিন আমিন, নাট্যপ্রদর্শন কলা বিভাগের হাবিবুর রহমান ও তানভীর নেওয়াজ, নৃবিজ্ঞানে আয়ান হাসান ও উপ-মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা সম্পাদক হেদায়েত উল্লাহ এবং তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের হল ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য সাজিদ আহমেদ সুইট রয়েছেন। তাদের সবাই মামলার আসামি।  

এ ছাড়া ইসলামিক স্টাডিজের জারির উদ্দিন, সাগর মোল্লা ও নাহিদ হাসান; ইংরেজি বিভাগের জাফর খান হৃদয়, দর্শন বিভাগের তামিম ইকবাল ও রাজিব হোসাইন, শিক্ষা ও গবেষণার তাইয়েব বিন ইসলাম, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের মাহবুবুল আলম, ভাষাবিজ্ঞানের ওয়ালিউল্লাহ, ভূগোল ও পরিবেশের মাহমুদুল হাসান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের কাউসার, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের মির্জা অন্ত আহদী নূর, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রেজাউল করিম ও আব্দুল্লাহ আল জাবির রিয়াদ, সমাজকল্যাণে জোবায়ের আহাম্মদ, প্রিন্টিং পাবলিকেশনের রুবেল হাসান, ব্যবস্থাপনা বিভাগের কামরুল হাসান, সংস্কৃত বিভাগের সাব্বির হুসাইন অবাঞ্ছিত হলেও সবার নাম ভোটার তালিকায় রয়েছে।  

মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের রাজিব চৌধুরী, এইচএমডি আবু মুসা, মাহমুদুল হাসান ও শায়খুল ইসলাম; সমাজকল্যাণের হাসিবুর রহমান ও শাকিল মণ্ডল, পালির মাহমুদুল হাসান, ইসলামিক স্টাডিজের নাজমুস সাকিব, ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাহমুদ মমিন শাওন, তোফায়েল আহম্মদ, জিসান আকন্দ; অপরাধবিজ্ঞানের জামিল শামস, শান্তি ও সংঘর্ষের আসাদুল্লাহ আল মাহমুদ, লোকপ্রশাসনের আবু সাঈদ, ইতিহাস বিভাগের শিহাব শাহরিয়ার রিজা, পপুলেশন সায়েন্সের সাজ্জাদ হোসেন, ফারসির ফারদিন আশিক ও খোরশেদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শামিম হোসাইন, ভূগোল ও পরিবেশের মেহেদি হাসান, নৃবিজ্ঞানের সাদমান রাফিদ, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের এরশাদুল হক সুমন অবাঞ্ছিত হলেও ভোটার তালিকায় নাম এসেছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমেদ সমকালকে বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়। বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। সবাইকে বাদ দেওয়া হবে। সময়ের অভাবে যে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল, ওই কমিটি এখনও বসতে পারিনি বলে জানান তিনি।