Image description

নির্বাচনের সময়সীমা বা রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে সরকারের ভেতরে চরম উত্তেজনা চলে আসছিল কয়েকদিন ধরে। জামায়াত এবং এনসিপি প্রাণপণে চাইছিল প্রধান উপদেষ্টার এ সংক্রান্ত ঘোষণা ঠেকিয়ে রাখতে। অবশেষে ব্যর্থ হয়েছে। ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। এবং বলেছেন, এটিই এখন সরকারের প্রধান কাজ। প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণায় অত্যন্ত হতাশ হয়েছেন জামায়াতে ইসলামী এবং ছাত্রদের নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)র নেতারা। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার এ ঘোষণাকে বিএনপির ইচ্ছেপূরণ বলে আখ্যায়িত করেছে এনসিপি। অন্যদিকে জামায়াত বলেছে, নির্বাচনের সময় ঘোষণার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা তাদের সঙ্গে আগাম আলোচনা করেননি। এতে তারা হতাশ। 

সূত্রমতে, দল দুটির নেতারা এমন পরিস্থিতিতে কী করবেন, ভেবে কূল পাচ্ছেন না। এককভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে এনসিপির কোনো আসন পাওয়া দূরের কথা, প্রায় সব নেতারই জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। অন্যদিকে জামায়াত নেতারাও আশংকা করছেন, নির্বাচনে বিএনপিমুখী জোয়ার তৈরি হতে পারে। তাতে কাক্সিক্ষত সংখ্যক আসন পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের নেই। অর্থাৎ অল্প কয়েকটি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতে পারে। তারচে’ বড় কথা হলো, প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসার যে সম্ভাবনা ইতিপূর্বে তৈরি হয়েছিল সেটিও হাতছাড়া হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। বিএনপির সঙ্গে বৈরি সম্পর্কের কারণেই মূলতঃ এমন আশংকা তৈরি হয়েছে। জামায়াত এবং এনসিপির ইতিপূর্বের হিসাব-নিকাশ ছিল, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নিষিদ্ধ ও নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে ক্ষমতাচ্যূত এ দলটির নেতাকর্মীরা তাদের দিকে মোড় নেবে- যেহেতু বিএনপিতে স্থান পাওয়ার সুযোগ নেই বা খুবই সীমিত। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরেই বাধ্য হয়ে জামায়াত-এনসিপিতে যোগ দেবে।
বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ফল হচ্ছে উল্টো। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের বেশিরভাগই অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে আগ্রহী নয়। তারচে’ বরং এরা আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকাটাকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অবশ্য, একটি অংশ গ্রেফতার-কারাগারের পরিবর্তে স্বাভাবিক জীবন-যাপনের পথকেই বেছে নেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এরা বেশিরভাগই জামায়াত-এনসিপির পরিবর্তে বিএনপিমুখী। শুরুর দিকে পিঠ বাঁচাতে কিছু আওয়ামী লীগার জামায়াত-এনসিপির ফরম পূরণ করলেও পরে তারাও অনেকে আবার গতি পরিবর্তন করে বিএনপির দিকে চলে গেছে। বিএনপিতে পদ-পদবি না পেলেও নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরেই এই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকার চেষ্টা করছে।   

জামায়াতের জন্য এটাও বড় একটা সমস্যা ছিল না, যদি বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কটা তাদের ভালো থাকতো। জামায়াত নেতারা আশংকা করছেন, আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে না পারলেও আওয়ামী লীগের ভোটারদের তো আটকানো যাবে না? সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভোটাররা যৌথভাবে তাদের পছন্দের সমমনা কোনো প্রতীকে ভোট দেয়ার কৌশল নিতে পারে। এমন পরিস্থিতি দেখা দিলে জামায়াতের প্রধান বিরোধীদল হওয়ারও সম্ভাবনা আর থাকবে না। বস্তুত, এটিই এ মুহূর্তে জামায়াতের মাথাব্যাথার বড় একটি কারণ। মূলতঃ এ কারণেই নির্বাচন ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছিল দলটি। 

জামায়াত এবং এনসিপি আশা করেনি এত দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যদিও লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে নির্বাচনের সময় নিয়ে চূড়ান্ত সমঝোতা হয়ে গেছে। লন্ডন বৈঠকের পর নির্বাচন নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যকার অনিশ্চয়তা কেটে যায়। তারা নিশ্চিত হয়ে যান, নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু জামায়াত-এনসিপি এরপরও ধরে নিয়েছিল, সংস্কার ও বিচার ইস্যুতে নির্বাচন নিয়ে জটিলতা তৈরি করতে সক্ষম হবেন নেতারা। এটি মাথায় রেখেই পিআর পদ্ধতিসহ বিতর্কিত ইস্যুগুলোতে অনড় অবস্থান নেয় তারা, যেগুলো মেনে নিতে বিএনপি মোটেই রাজি নয়। অবশেষে এই কৌশলেও কাজ হলো না। আদতে গত এক সপ্তাহে যা ঘটেছে এরজন্য জামায়াত এবং এনসিপি নেতারা মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। 

বস্তুত, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার অর্থ দাঁড়ায়, গত এক বছর ধরে দল দুটি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছিল তা থেকে পুরোপুরি ছিটকে পড়া। শুধু এটাই নয়, নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি তাদের জন্য মোটেই অনুকূল হবে না এটা তারা বুঝতে পারছেন। সামনের দিনগুলো বরং তাদের জন্য একেবারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। জুলাই অভ্যূত্থানের ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে নিহত-আহতদের একটি বড় অংশ ছিল যদিও বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনগুলোর। গণহারে গ্রেফতারও হয়েছে এই দলটির শীর্ষ নেতৃত্বসহ বিভিন্ন সারির নেতা-কর্মীরা। কিন্তু ৫ আগস্ট, ২০২৪ এর পর অনেকটা হঠাৎ করেই কতিপয় সমন্বয়ক অভ্যূত্থানের পুরো কৃতিত্ব নিজেদের দখলে নিয়ে যায়। এটা ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর খেলার চাল। সামনে কিছু সমন্বয়ক এবং পেছনে জামায়াতকে দিয়ে তারা পুরো ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানকে নিজেদের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ক্ষমতার চেয়ারে বসানোর ব্যবস্থা করে। বিএনপিকে মাইনাস করার পুরনো খেলায় মেতে উঠে যুক্তরাষ্ট্র। ড. ইউনূসকে ‘শো-পিস’ হিসেবে রেখে এ কাজে মূল ভূমিকা পালন করে জামায়াত। জামায়াত নেতাদের এ সময়ের একান্ত আলাপের বক্তব্য ছিল এমন, ক্ষমতার মসনদের লড়াইয়ে এক পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গেই তাদের চূড়ান্ত ফয়সালা হবে- এটা আগেরই হিসাব-নিকাশ। এক সময় তো লড়াই হবেই, সেটা এখন হচ্ছে। 

শীর্ষনিউজ ডটকমের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একাধিক জামায়াত নেতা এমন মন্তব্য করেছেন- অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুর দিকে যখন তাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল, দীর্ঘকালের আওয়ামী ঝড়-ঝাপটায় বিএনপির ছায়াতলে থেকে এখন উল্টো বিএনপিকেই ‘মাইনাস’ করার খেলায় নেমেছেন এর কারণ কী- এ প্রশ্নের জবাবে। 
দেখা গেছে, ওই সময় জামায়াত নেতারা প্রত্যেকে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ দেয়ার মতো পাল্টা সংগঠন দাঁড় করানোর কাজে এতটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, কথা বলার বা প্রশ্নের জবাব দেয়ার মতো সময়ও তাদের ছিল না! একদিকে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের লাখ লাখ নতুন প্রাথমিক সদস্যপদের ফরম পূরণের কাজ চলে। অন্যদিকে সরকারি দপ্তরগুলো একে একে প্রায় সবই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া হয় অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ মহলের সহযোগিতায়। এটি করতে গিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ চিহ্নিত সরকারি কর্মকর্তাদেরও নিজেদের দলে ভিড়ায় জামায়াত। এ কাজে নেতৃত্ব দেন আলী ইমাম মজুমদারসহ কয়েকজন উপদেষ্টা ও শীর্ষ আমলা। এরা মূলতঃ প্রত্যেকেই এসব দলাদলি-কলাকৌশলের মাধ্যমে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করে নেন। পরবর্তীতে মাঝ থেকে বেকায়দায় পড়ে যায় জামায়াত এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারও। প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে আওয়ামী কর্মকর্তাদের পুনর্বাসন করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমুর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়, জুলাই অভ্যূত্থানের চেতনা ভূলুণ্ঠিত হয়, সংস্কার কার্যক্রমে হাতই দেয়া যায়নি। দেশবাসী চরমভাবে হতাশ হয়েছে।

‘বিএনপি মাইনাস’ কর্মসূচি এ মুহূর্তে তাদের যে একটা বড় ভুল খেলা ছিল এটা জামায়াত পরে বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে জল অনেকদূর গড়িয়ে গেছে, যা শোধরানোর মতো আর সময় ছিল না। অসময়ে হলেও জামায়াত পরে চেষ্টা করেছে বিএনপির সঙ্গে সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে। জামায়াতের আমীর ড. শফিকুর রহমান লন্ডন পর্যন্ত উড়ে গিয়েছেন, খালেদা জিয়া-তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। তবে বিএনপির সঙ্গে কেন এভাবে বেঈমানী করা হলো, এ প্রশ্নের জবাব জামায়াত আমীর দিতে পারেননি। যে কারণে সমঝোতার চেষ্টাও অবশেষে ভেস্তে গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে সরাসরিই বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী জোটের সম্ভাবনা নেই। বরং তিনি এনসিপির জন্য দরজা খোলা আছে বলে জানিয়েছেন। যদিও এনসিপি নেতারা ওই সময় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির দেয়া ‘আসন ভিক্ষা’ নিবেন না বলে জানিয়েছিলেন, অবশেষে এখন আসনের জন্য বিএনপির কাছেই ধর্না দিচ্ছেন, জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপির নেতারা শীর্ষ থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্য প্রভৃতি এত অপকর্ম করেছেন যে, এদের অধিকাংশই নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত দেশে থাকতে পারবেন না বা থাকবেন না। বিএনপির কাছ থেকে ‘দান’ হিসেবে কয়েকটি আসন পেলেও এটা তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় খুব একটা কাজে দেবে না। মূলতঃ এ কারণেই এনসিপি নেতারা চরম হতাশার মধ্যে আছেন এখন। হতাশা এতটা তাদের গ্রাস করেছে যে, বহুল কাক্সিক্ষত এই জুলাই ঘোষণা’র সময়েই দল বেঁধে সাগরপাড়ে গেছেন ‘ঘুরতে’-যারা জুলাই অভ্যূত্থানকে নিজেদের একক কৃতিত্ব দাবি করে থাকেন!

বিশ্লেষকদের মতে, এনসিপি নেতাদের কাছে ‘রাজনীতি’ মুখ্য নয়, প্রায় প্রত্যেকেই ভালোভাবে আখের গুছিয়ে নিয়েছেন গত এক বছরে, বিদেশে উড়াল দেয়ার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু জামায়াতের তো এটা সম্ভব নয়। দেশে থেকেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে তাদের। আর এ কারণেই চোখে পুরো অন্ধকার দেখছেন দলটির নেতারা, বিশেষ করে গত ৫ আগস্ট নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর থেকে।   

শীর্ষনিউজ