
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ১৮টি আবাসিক হলে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছে শাখা ছাত্রদল। ৫৯৩ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিতে ডজন দুয়েক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী স্থান পেয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের কমিটিতে অনুপ্রবেশের অভিযোগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের ৬ নেতাকে পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছিল দলটির কেন্দ্রীয় শাখা।
সাধারণ শিক্ষার্থী এমনকি খোদ ছাত্রদল সংশ্লিষ্ট নেতারাও বলছেন, অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিদ্রুপকারীরও জায়গা হয়েছে এই কমিটিতে। সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়কের একাধিক পদে জায়গা হয়েছে ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকা সম্পাদক পদে নেতারাও। পাশাপাশি কমিটিতে বিগত সময়ে নির্যাতন সহ্য ত্যাগী কর্মী ও জুলাই আন্দোলনকারীদেরও উপেক্ষিত রাখা হয়েছে— এমনটাই অভিযোগ পদবঞ্চিত অনেকের।
এছাড়াও অভিযোগ, ঘোষিত এই কমিটিতে প্রাধান্য পেয়েছে শাখা ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের কর্মীরা। উপেক্ষিত রয়েছেন তাদের বাইরের কর্মীরা। স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে আপন ছোট ভাই মো. মাহদীজ্জামান জ্যোতিকে দায়িত্ব দেওয়ায় স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে ঢাবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের বিরুদ্ধে। এদিকে সমালোচনা ও ঘটনার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি করেছে শাখা ছাত্রদল। কমিটির প্রতিবেদন আগামী তিনদিনের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে।
হলভিত্তিক অভিযোগ
ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্ হল: এই হলে ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক পদ পেয়েছেন রাকিবুল হাসান সৌরভ। তিনি জীববিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন।
কবি সুফিয়া কামাল হল: হলটিতে ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম-আহবায়ক পদ পেয়েছেন জাকিয়া সুলতানা আলো। উর্দু বিভাগের ২০২২-২৩ সেশনের এই শিক্ষার্থী ছাত্রলীগ নেত্রী সাজিয়া রহমান সিলভীর (রোকেয়া হল) কাছের ছোটবোন হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুলের সঙ্গে তার ছবি রয়েছে; যা নিয়ে সমালোচনা করছেন নেটিজেনরা।
বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল: অভিযোগ উঠেছে, হলের সদস্য সচিব জান্নাতুল ফেরদৌস পুতুল ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের কালচারাল টিমের সদস্য ছিলেন। ২০২২-২৩ সেশনের নাট্যকলা বিভাগের এই ছাত্রী এই প্রথম বর্ষের এই ছাত্রী জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের সাথে।
অমর একুশে হল: হলের সদস্য সচিব হিসেবে মনোনীত হয়েছেন আব্দুল হামিদ। নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন হামিদ। ইতেমোধ্যেই তার একটি ছবি সামাজিকমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে; যেখানে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগের পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।
শামসুন্নাহার হল: শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে মনোনীত হয়েছেন নিতু রাণী সাহা। এর আগে তিনি তিনি ছাত্রলীগের উপ-গণযোগাযোগ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেছেন।
হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল: শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে মনোনীত হয়েছিলেন রোমান মিয়া। অভিযোগ, তিনিও ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ছাত্রদলের হল কমিটি ঘোষণার পরই তার একটি পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। হলটিতে সদস্য পদ পাওয়া আহমেদ জাবির মাহামের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের উপর হামলা ও একদফা ঘোষণা বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার তাকেও তার নিজের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ থেকে বয়কট করা হয়।
এই হলের ছাত্রদলের আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক পদে মনোনীত হয়েছেন জনি প্রামাণিক। তিনিও ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ জানিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে থাকা তার ছবি শেয়ার করেছেন কেউ কেউ।
শেখ মুজিবুর রহমান হল: শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক পদে মনোনীত হয়েছেন মোস্তফা হোসেন লিখন। তিনিও ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে তার একটি ছবিও ফেসবুকে ছড়িয়েছে। তাছাড়া হলটিতে যুগ্ম আহ্বায়ক পদে মনোনীত হয়েছেন আব্দুল্লাহ আল নোমান। তিনিও ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে তার ছবি দেখা গেছেন।
ফজলুল হক মুসলিম হল: শাখাটির যুগ্ম আহ্বায়ক হয়েছেন রাকিব হাসান। তিনিও ছাত্রলীগের নেতা মাজহারুল কবির শয়নের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন অভিযোগ পাওয়া গেছে। ছাত্রলীগের কর্মসূচি নিয়েও তার পোস্ট রয়েছে।
স্যার এ এফ রহমান হল: হল শাখা ছাত্রদলের নতুন কমিটিতে সদস্য সচিব হয়েছেন মো. মাহদীজ্জামান জ্যোতি। আগে দলীয় কোনো পদ না থাকলেও ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের এই শিক্ষার্থী সরাসরি পেয়েছেন সদস্যসচিব পদ। এ নিয়ে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রদলের একাংশের নেতাকর্মীরা। জানা গেছে, মো. মাহদীজ্জামান জ্যোতি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের আপন ছোট ভাই। ফলে স্বজনপ্রীতির ব্যাপারটিই সামনে আনছেন অনেকেই। এছাড়া শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক পদ পাওয়া শাখাওয়াত হোসেন ২০২২ সালের ছাত্রলীগের হল কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন।
মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল: শাখা ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ৫১ সদস্যের এ আহবায়ক কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিদ্রুপকারী রাজু শেখ। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে বলে জানা গেছে। রাজুর বিরুদ্ধে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া হল শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক রায়হান আহমেদ এক সময় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন।
শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল: ছাত্রদলে সদস্য সচিব পদ পওয়া শাহরিয়ার লিয়ন ও যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পাওয়া মো. রাসেল হোসেনকে ছাত্রলীগে সক্রিয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে দেখা গেছে। রাসেল ২০২১-২২ সেশনের শিক্ষার্থী। তাছাড়া লিয়নকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণায়ও অংশ নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিজয় একাত্তর হল: ছাত্রদলে সদস্য যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পাওয়া রাকিবুল হাসান রাকিব ছাত্রলীগের সময় গেস্টরুমে শিক্ষার্থীদের টর্চার করার অভিযোগ রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে যারা আমাদের প্রাথমিক সদস্য পদ পূরণ করে আমাদের সাথে থেকেছে এবং অভ্যুত্থানের আগেও আমাদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো, তাদেরকে আমরা কমিটিতে রাখার চেষ্টা করেছি। এরপরও যদি কেউ পরিচয় গোপন করে থাকে তাহলে আমরা সে বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্হা নিবো। আমরা ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্যদিকে ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে এবং সেটা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।