
অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবহেলা-বঞ্চনার আরেক বছর পার করল বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ছয় জেলার মানুষ। জুলাই বিপ্লবের পর ন্যূনতম চাওয়া পূরণের আশায় বুক বাঁধলেও এবারও জুটল না কিছুই। পূরণ হলো না ফরিদপুর-কুয়াকাটা সড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার দাবি। উন্নত স্বাস্থ্যসেবার আকাঙ্ক্ষাও রয়ে গেল অপূর্ণ। একই সঙ্গে অপূর্ণ রইল ভোলা-বরিশাল সেতুর স্বপ্ন। সরকারের অবহেলায় কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত উলটো হুমকির মুখে পড়েছে। প্রায় এক যুগ ফাইলবন্দি ‘সৈকত রক্ষা প্রকল্প’ আলোর মুখ না দেখায় উত্তাল ঢেউয়ে সাগরপারের বহু স্থাপনা বিলীন হয়েছে।
প্রমত্তা পদ্মা নদীর কারণে ৪৮ বছর ধরে ঢাকা থেকে বরিশাল অনেক দূরে ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের পর অবাক হয়ে সবাই দেখল মাত্র ৩ ঘণ্টায় বরিশাল থেকে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছানো যায়। এ যাত্রাকে আরও মসৃণ করেছে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে। তবে ভাঙ্গার পরই ভাঙতে শুরু করে দক্ষিণের মানুষের কপাল। দেশের অন্যতম প্রধান এ জাতীয় সড়কটি এখনো চওড়ায় মাত্র ২৪ ফুট। কোথাও কোথাও এ প্রস্থ কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ ফুটে। বিশেষ করে বরিশালের পর কুয়াকাটা পর্যন্ত ১১২ কিলোমিটার ১৮ ফুট চওড়া হওয়ায় চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। অথচ এ মহাসড়ক ধরে পায়রা সমুদ্রবন্দর, তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, কুয়াকাটা, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরে যেতে হয়। প্রস্থ কম হওয়ায় মহাসড়কটি ছয় লেনে উন্নীত করার কথা বারবার দাবি উঠেছে। অথচ সেই দাবির বাস্তবায়ন দেখেনি দক্ষিণের মানুষ।
২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) বৈঠকে সড়কটিকে ছয় লেনে উন্নীত করার প্রয়োজনে ফরিদপুর থেকে বরিশাল পর্যন্ত ১৫২ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দেয় সরকার। সাত বছরের মাথায় মাত্র ৩৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বরিশাল থেকে পটুয়াখালী পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণের ফাইল এখনো পায়নি অনুমোদন। ফরিদপুর থেকে মহাসড়কটি কুয়াকাটা যাওয়ার কথা থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকার তা ছোট করে নিয়ে এসেছে পায়রা সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত। রহস্যজনক কারণে মেলেনি পায়রা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে থাকা কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত সড়কের অনুমোদন।
বরিশালের নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি পিছিয়েছে এ মহাসড়কের কাজ। দাতা সংস্থা বসে আছে অর্থসহায়তা দেওয়ার জন্য। সবরকম সম্ভাব্যতা যাচাইও শেষ। এরপরও কেন কাজটি থামিয়ে রাখা হচ্ছে, সেটির জবাব বর্তমান সরকারই ভালো দিতে পারবে। বরিশাল সড়ক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান খান বলেন, গত ৭ মের একনেক বৈঠকে জমি অধিগ্রহণ প্রকল্পের বর্ধিত মেয়াদের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। অধিগ্রহণও চলছে পুরোদমে। আশা করি, আগামী বছরের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে ছয় লেন প্রকল্পের কাজ।
হুমকির মুখে কুয়াকাটা, উদ্যোগ নেই সৈকত রক্ষার : একই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার বিরল বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। রাজধানী ঢাকা থেকে সড়কপথে মাত্র ৫ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় বলে কুয়াকাটায় এখন প্রতিদিনই ভিড় করে বহু পর্যটক। কুয়াকাটা পর্যটনকেন্দ্রের ওপর ভর করে পুরো দক্ষিণের অর্থনীতি চাঙা হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সব সরকারের অবহেলায় যেন কেবলই একটি গ্রাম ‘কুয়াকাটা’। নানা উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার আওয়াজ শোনা গেলেও বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। উপরন্তু মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে সৈকতের ভাঙন। ৩০ বছরে পাড় ভেঙে লোকালয়ের ভেতরে প্রায় দেড় কিলোমিটার ঢুকে পড়েছে সমুদ্র। বর্ষা মৌসুমে উত্তাল ঢেউ একটু একটু করে ভেঙে নিয়ে যায় সাগরপারের স্থাপনাসহ নানা প্রতিষ্ঠান। চলতি বছর ভাঙনের ভয়াবহতা চলছে সবচেয়ে বেশি। মাত্র দেড় মাসে সাগর গ্রাস করেছে ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ মেরিন ড্রাইভসহ অসংখ্য স্থাপনা। ভাঙন ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ পর্যন্ত করেছেন সাগরপারের বাসিন্দারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে তিনবার প্রকল্প পাঠানো হলেও নানা ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবার ফেরত পাঠায় পরিকল্পনা কমিশন। ট্যুরিজম অ্যাসেসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, সৈকত রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কেবল সাগরপার নয়, হুমকির মুখে পড়বে বিস্তীর্ণ জনপদ। ইচ্ছা থাকলেই এটি করতে পারত যে কোনো সরকার। এবার আমরাও মাঠে নেমেছি। প্রয়োজনে রাজধানীতে গিয়ে কুয়াকাটার মানুষ আন্দোলন করবে।
কলাপাড়া (পটুয়াখালী) পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহ আলম বলেন, সৈকত রক্ষাসহ সাগরপারে সড়ক নির্মাণে ৭৫৯ কোটি টাকার একটি সর্বশেষ প্রকল্প প্রস্তাব দাখিল করা হয়েছে। এটির অনুমোদন পাওয়া গেলে ভাঙন ঠেকানোসহ সব ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
খবর নেই ভোলা সেতুর, পিছিয়ে স্বাস্থ্য খাত : মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন দেশের একমাত্র জেলা ভোলায় যেতে একটি সেতু নির্মাণের দাবি ঝুলে আছে প্রায় চার যুগ ধরে। বিগত সরকারের সময়ে প্রাথমিক সম্ভাব্যতা যাচাই হলেও আর এগোয়নি প্রকল্পের কাজ। চলতি বছরের ৮ মে ভোলায় আসা সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ আব্দুর রউফও শোনাতে পারেননি কোনো আশার বাণী। তখন তিনি বলেন, পরিকল্পনা কমিশনে এ সংক্রান্ত ‘প্রস্তাবিত উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনা’ জমা আছে। বরিশালের লাহারহাট থেকে ভোলার ভেদুরিয়া পর্যন্ত সেতু নির্মাণে ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। বাস্তবতা হলো, কোনো কিছুই হয়নি। পরিকল্পনা কমিশনে পড়ে আছে প্রকল্প প্রস্তাবনা। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি পরিকল্পনা কমিশন বা সেতু মন্ত্রণালয়ের কেউ।
একইভাবে পিছিয়ে আছে এ অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা। এক হাজার বিছানার শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন চিকিৎসা নেয় পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ। অথচ এখানকার জনবল কাঠামো এখনো ৫০০ শয্যার। এর ওপর চিকিৎসকের ৮৭টি পদ শূন্য রয়েছে। ফলে চিকিৎসাব্যবস্থা বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের একমাত্র নির্ভরযোগ্য এ হাসপাতালে।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান বলেন, ৫ আগস্টের পর চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে বাংলাদেশে তিনটি বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয় চীন। এর একটি বরিশালে স্থাপনের জন্য আন্দোলন পর্যন্ত করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা দেয়নি অন্তর্বর্তী সরকার। এখানকার চিকিৎসাসেবার উন্নয়নেও নেওয়া হয়নি বিশেষ কোনো ব্যবস্থা। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া সরকারের কাছে আমাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এর একটিও আলোর মুখ দেখেনি। বঞ্চিত দক্ষিণাঞ্চল অবহেলিতই রয়ে গেল।