Image description
 

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ মাদারীপুরে তিন যুগেরও বেশি সময় আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগের। তবে আগামী নির্বাচন ঘিরে নতুন হিসাব-নিকাশ কষতে শুরু করেছেন এলাকাবাসী আর সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ফ্যাসিবাদ বিদায় হওয়ায় বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন দলের নেতারা ফুরফুরা মেজাজে নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছেন।

 

জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী ঘরানার দলগুলো মানুষের মন জোগাতে মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে পুরো জেলা জুড়েই সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের নজর কাড়ছেন।

 

পাঁচটি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভা নিয়ে মাদারীপুরের তিনটি আসন। আড়িয়ালখাঁ, কুমার, নিম্ন কুমারসহ ছোট-বড় সাতটি নদীবেষ্টিত মাদারীপুর জেলায় গত নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৩ হাজার ৭৪২ জন। আয়তনের দিক থেকে জেলার ৩টি আসনের মধ্যে মাদারীপুর-২ আসনে সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তিনটি আসনেই বিএনপির একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে দলীয় টিকিট যাকে দেবেন, তার পক্ষেই নির্বাচন করবেন প্রার্থীরা। অন্যদিকে আগেভাগেই জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন সব আসনেই প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন।

 

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের বাড়ি মাদারীপুরে হলেও জেলায় উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগেনি। মাদারীপুর পৌর শহরের মাঝ দিয়ে ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে চার লেনের সড়ক করলেও পাঁচ বছরেই তার বেহাল দশা। ১০০ শয্যার জেলা সদর হাসপাতালকে আড়াইশ’ শয্যায় উন্নীত করা হলেও পাঁচ বছরেও পূর্ণাঙ্গ সেবা চালু হয়নি। অন্যদিকে জেলায় কোনো শিল্প-কলকারখানা হয়নি। মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের দাবি থাকলেও তাতে সাড়া দেয়নি সরকার।

 

মাদারীপুর-১ (শিবচর)

মাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন পেতে এরই মধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন একাধিক নেতা। বিভিন্ন এলাকায় জনসভা, কর্মিসভাসহ রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন তারা। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী শিবচর উপজেলার আমির মাওলানা সরোয়ার হোসেনকে এবং ইসলামী আন্দোলন মাওলানা আকরাম হোসেনকে প্রার্থী করেছে।

৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই গাঁ ঢাকা দিয়েছে। যারা এলাকায় আছে, তারা চুপচাপ থাকলেও কেউ কেউ আবার বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোতে যোগ দিয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরির চেষ্টা করছেন। বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকায় সুবিধা হচ্ছে সুযোগ-সন্ধানী তথাকথিত এসব আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর। এ আসন থেকে এবার বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে শিবচর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কামাল জামান নূরুদ্দিন মোল্লা, সাবেক সংসদ সদস্য নাদিরা মিঠু চৌধুরী, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকী ও উপজেলার সাবেক সভাপতি ইয়াজ্জেম হোসেন রোমানের নাম শোনা যাচ্ছে।

 

অন্যদিকে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছে জামায়াতে ইসলামী। উপজেলা আমির মাওলানা সরোয়ার হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে দলটি। উপজেলা সদর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এমনকি গ্রাম পর্যায়ে নেতাকর্মীরা গণসংযোগ শুরু করেছে। এরই মধ্যে নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করা সম্পন্ন করেছে তারা। একইভাবে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাদারীপুর জেলার উপদেষ্টা মাওলানা আকরাম হোসেনও মাঠে রয়েছেন।

 

বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাবিলা মিঠু চৌধুরী বলেন, ‘আমি সব সময় বিএনপির রাজনীতিতে মাঠে ছিলাম। অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি দলের জন্য। আমার শ্রম ও ত্যাগ দলের নেতাকর্মীরা যেমন জানেন, তেমনি হাইকমান্ডও জানে। তাই আমি সম্পূর্ণভাবে আশাবাদী আমি নমিনেশন পাব।’

 

আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি ২০১৮ সালের নির্বাচন করেছি, তাই আশা করছি আমি মনোনয়ন পাব।’

 

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছি। কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি করা হয়ে গেছে। বেশকিছু এলাকায় সমাবেশ করেছি। এছাড়া হাট-বাজারগুলোতে বৈঠক করছি। সমাবেশ ও বৈঠকগুলোতে ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়ম থেকে দেশকে বাঁচাতে জামায়াতে ইসলামীকে একবার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান করছি।’

 

মাদারীপুর-২ (রাজৈর ও সদরের একাংশ)

মাদারীপুর-২ আসনে প্রায় ৩ যুগ ধরে একচ্ছত্র রাজত্ব করেছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান। তার পতনের পর এ আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য এক প্রকার যুদ্ধে নেমেছে মাদারীপুরের কয়েকজন বিএনপি নেতা। এ আসনেও জামায়াতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলন তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে রয়েছে।

মাদারীপুর সদর উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন, একটি পৌরসভা ও রাজৈর উপজেলা নিয়ে মাদারীপুর-২ আসন গঠিত। মনোনয়ন দৌড়ে নাম রয়েছে বিএনপির সাবেক সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি হেলেন জেরিন খানের। তিনি এর আগেও এ আসন থেকে নির্বাচন করেছেন। আলোচনায় আছেন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাহান্দার আলী জাহানের। রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক নেতা মিল্টন বৈদ্যের নামও শোনা যাচ্ছে। তিনি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে এ আসনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন।

মিল্টন বৈদ্য বলেন, ‘আমি সব সময় মাঠে কাজ করেছি। আমি শতভাগ বিশ্বাস করি দল আমাকে মনোনয়ন দেবে।’

 

এ আসন চষে বেড়াচ্ছেন সরকারি নাজিমউদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক ভিপি ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব মাসুদ পারভেজ। মাদারীপুর আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক জাফর আলী মিয়ার নামও আছে মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকায়। এসব নেতাকে ঘিরে বিএনপি কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

 

এ আসনে জেলার সাবেক আমির ও ফরিদপুর অঞ্চল টিম সদস্য মাওলানা আব্দুস সোবাহান খাঁন এবং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক মাওলানা লোকমান হোসেন জাফরী।

 

জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও মনোনয়নপ্রত্যাশী জাহান্দার আলী জাহান বলেন, ‘৪৪ বছর ধরে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই দীর্ঘ সময় আমি বিএনপির সব আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম। একাধিকবার জেল খেটেছি, শিকার হয়েছি অনেক নির্যাতনের। আমি কখনো চাঁদাবাজি, দখলবাজি বা ক্ষমতার অপব্যবহার করিনি। সেই হিসাবে শতভাগ নিশ্চিত আমি মনোনয়ন পাব।’

 

মাসুদ পারভেজ বলেন, আমি শতভাগ আশা রাখি, আমাকে বিএনপি মনোনয়ন দেবে। আমি দলের নাম ভাঙিয়ে কোথাও চাঁদাবাজি করিনি।

জামায়াতে ইসলামের প্রার্থী মাওলানা আব্দুস সোবাহান খাঁন বলেন, ‘আমরা নির্বাচনকে সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি। এ সংসদীয় আসনে প্রতিটি কেন্দ্রে কেন্দ্র কমিটি গঠন করা হয়েছে। পোস্টার, লিফলেটসহ বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মিটিং করছি।’

 

AmarDesh_Madaripur-2

 

মাদারীপুর-৩ (কালকিনি, ডাসার ও সদরের একাংশ)

মাদারীপুর-৩ আসন বরাবরই আওয়ামী লীগের ঘাঁটি ছিল। তবে চরম দুর্নীতিবাজ হিসেবে কুখ্যাত আব্দুস সোবাহান গোলাপ নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে নৌকার সমর্থন কমতে থাকে। বিএনপির দুই কেন্দ্রীয় নেতার মনোনয়ন যুদ্ধের জেরে এখানে দলটির নেতারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই সুযোগ নিয়ে স্থানীয় বিএনপির কিছু নেতা দখল ও চাঁদাবাজি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন তাদের প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে।

 

মাদারীপুর সদরের একাংশ, কালকিনি উপজেলা ও ডাসার উপজেলা নিয়ে গঠিত মাদারীপুর ৩ আসনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মাশুকুর রহমান মাশুক মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনও প্রার্থী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। দুজনই নির্বাচনি এলাকায় কর্মীদের কাছে দৌড়ঝাঁপ করছেন।

 

মাদারীপুর-৩ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কালকিনি পৌরসভার আমির রফিকুল ইসলাম মৃধা। এই আসনেও নির্বাচন পরিচালনা কমিটিও গঠন করেছে তারা। প্রতি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে চালাচ্ছে প্রচার। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী ফরিদপুর অঞ্চলের যুব আন্দোলনের নেতা মাওলানা এসএম আজিজুল হক।

 

বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মাশুকুর রহমান বলেন, ‘আমি ৪৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতি করি। এই আসনে যখন বিএনপির কথা বলার লোক ছিল না তখন থেকে আমি বিএনপির কথা বলেছি। তিলে তিলে এই আসনে বিএনপির রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছি। ৫ আগস্টের পরে এই অল্প দিনেই অনেকের গায়ে কাদা লেগেছে, কলঙ্কের তিলক লেগেছে। আমি মনে করি দলের জন্য সততা ও নিষ্ঠার জন্য আমি মনোনয়ন পাওয়ার জন্য প্রাপ্য, আমিই হকদার।’

 

জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা মোকলেসুর রহমান বলেন, ‘মাদারীপুর-৩ আসনের প্রতিটি কেন্দ্রে কমিটি করা হয়েছে। এছাড়া ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলাভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করা হয়েছে। এই আসনের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে গণসংযোগ করা হচ্ছে।’