
গত বছরের ৩১ জুলাই। হাইকোর্ট চত্বরে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করা মেয়েটির নাম নুসরাত জাহান টুম্পা। তিনি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই মুহূর্তের ছবি আর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। আর তিনি হয়ে ওঠেন আন্দোলনের এক মুখ। জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি সামনে রেখে সমকালের সঙ্গে আলাপে টুম্পা তুলে ধরলেন তাঁর রাজপথে নামার গল্প।
তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকে আন্দোলনে যুক্ত ছিলাম, তবে অনলাইনে। রাজপথে নামার প্রবল ইচ্ছা ছিল। পরিবার থেকে অনুমতি পাচ্ছিলাম না। একপর্যায়ে মাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করি। মা প্রতিদিন দেখছিলেন শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি নির্যাতন। একসময় তিনি রাজি হয়ে যান।’
১৭ জুলাই রাতে সব প্রস্তুতি সেরে ডেমরার বাসা থেকে বের হন টুম্পা। যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনে যোগ দেন। সেদিন যাত্রাবাড়ীর অবস্থা ছিল বিভীষিকাময়। শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছিল পুলিশ। চোখের সামনে ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাসের শেল, এমনকি রাবার বুলেট ছোড়া হচ্ছিল। অনেককে আহত অবস্থায় তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। তাদের বাড়ি পৌঁছে দেন।
পরদিনও আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন টুম্পা। ১৯ জুলাই ইন্টারনেট বন্ধ করে দিলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। একা যাত্রাবাড়ী গিয়ে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। আতঙ্কিত পরিস্থিতির কারণে বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরে যান।
৩০ জুলাই রাতে পরিকল্পনা করেন, পরদিন হাইকোর্ট অভিমুখে মার্চে অংশ নেবেন। সকালে ক্যাম্পাস গেটে অবস্থান নেন। উপস্থিত ছিলেন পাঁচজন শিক্ষার্থী। গ্রেপ্তারের ভয় আর সরকারের হুমকির কারণে মাঠে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলক কম। বন্ধুবেশে দুজন দুজন করে রওনা দেন হাইকোর্টের দিকে।
হাইকোর্টের মূল ফটকের কাছাকাছি গিয়ে দেখেন, কিছু শিক্ষার্থী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে জড়ো হচ্ছে। তখন পুলিশ বুঝে ফেলে, কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ করে পুরো ফোর্স এসে তাদের ঘিরে ফেলে। তার সঙ্গে থাকা নূরকে গ্রেপ্তার করতে চেষ্টা করে পুলিশ।
টুম্পা জানান, তিনি নূরের হাত আঁকড়ে ধরেন। পুলিশ তাঁর হাতে-পায়ে আঘাত করে। একসময় তাঁকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তিনি আবার দৌড়ে নূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তখন পুলিশ তাঁকে ঠেলে সরিয়ে দিতে থাকে। সাহায্য করতে এগিয়ে আসায় তিন নারী পুলিশ অপরিচিত এক ব্যক্তিকে টেনে নিয়ে যায়।
টুম্পা বলেন, ‘আমি দৌড়ে গিয়ে পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়াই। তখন আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, যতক্ষণ পর্যন্ত আমার ভাইদের সবাইকে ছেড়ে না দিচ্ছেন, আমি এখান থেকে সরব না। আমার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যান।’ টুম্পা বলেন, ‘আমি জানতাম না, এরপর কী হবে। আমাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন আইনজীবীরা আমাকে আশ্রয় দেন। বলেন, আমাকেও গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা ছিল। নূর ভাইয়াকে সন্ধ্যার দিকে রমনা থানা থেকে ছাড়া হয়।’
পরদিন থেকে টুম্পা আবারও নিয়মিত আন্দোলনে অংশ নেন। এক দিন শহীদ মিনারে, আরেক দিন মিছিলে, কখনও গণভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচিতে। ৫ আগস্ট সকালবেলা শাহবাগে পৌঁছে টুম্পা প্রত্যক্ষ করেন বিজয়ের মুহূর্ত। তিনি বলেন, ‘সবাই বলছিল, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তখন মনে হচ্ছিল, আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যায়নি। আমি একজন সাধারণ ছাত্রী, আজ ইতিহাসের অংশ। কেউ একজন মিষ্টি খাওয়াল। কেউ বলছিল, ঈদ মোবারক। এক নারী কোলে ছয় মাসের শিশুকে নিয়ে এসেছিলেন।’ তবে আন্দোলনের এক বছর পরও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলে মনে করেন টুম্পা। তিনি বলেন, ‘শহীদরা বিচার পাননি। আন্দোলনের ভয়াবহতা, শিক্ষার্থীদের আত্মত্যাগ– ঝাপসা করে দেওয়া হচ্ছে। কোনো সংস্কার হয়নি।’