
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস’ আজ মঙ্গলবার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের এই দিনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ক্ষমতায় টিকে থাকতে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চলে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। প্রাণ হারায় নারী, শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। কিন্তু সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ কয়েকজন ছাড়া গত এক বছরেও জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও নেপথ্যের কুশীলবদের অধিকাংশই ধরা পড়েনি। গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছেন। কেউবা দেশেই আত্মগোপনে আছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, পলাতকদের বড় অংশই ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে জুলাই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা ও নেপথ্যের কুশীলবরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্বজনরা আসামিদের বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, এখনও যারা গ্রেপ্তারের বাইরে আছে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
গত বছর আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার পর ১৬ জুলাই সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার শুরু করে। এতে রাজধানীসহ সারাদেশে একের পর এক নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা হতাহত হতে থাকে। হতাহতের ঘটনায় ইতোমধ্যে সারাদেশে ১ হাজার ৭৩০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৭৪৯টি। ইতোমধ্যে ১৫টি মামলায় পুলিশ চার্জশিট দিয়েছে। ১ হাজার ৭৩০টি মামলায় ১ হাজার ৫১০ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬৪ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য। কিন্তু হত্যাকা-ের নির্দেশদাতা ও নেপথ্যের কুশীলবদের অধিকাংশই অধরা, তারা ছাত্র-জনতার রক্ত ঝরিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা করেছিলেন। ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এখনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় রয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর সূত্রে জানা গেছে, এখনও গ্রেপ্তারের বাইরে রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, ডিএমপির ডিবির সাবেক প্রধান হারুন উর-রশীদ, রংপুর রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন, রংপুরের সাবেক পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, রাজশাহী রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি আনিসুর রহমান, আরএমপির সাবেক পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার, সিটিটিসির সাবেক প্রধান ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার বিশ্বাস, মেহেদি হাসান, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, পুলিশের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান প্রমুখ।
পলাতক কুশীলবদের মধ্যে শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকার সাবেক পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান ভারতে এবং সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বেলজিয়ামে আত্মগোপনে আছেন। অন্যদিকে গ্রেপ্তারকৃত কুশীলবদের মধ্যে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এনটিএমসির সাবেক প্রধান জিয়াউল হাসান রয়েছেন কারাগারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এইচ এম শাহাদাত হোসাইন আমাদের সময়কে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মামলায় যারা আসামি, তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যারা গুলি করেছে, গুলির নির্দেশ দিয়েছে তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে পুলিশ বদ্ধপরিকর ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে আশুলিয়া থানার পার্শ্ববর্তী সড়কে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী শহীদ আরাফাত মুন্সি। স্থানীয় একটি স্কুলে পড়ত ছেলেটি। ঘটনার দিন আরাফাত মুন্সি বিক্ষোভ করতে রাস্তায় নেমে আসে। পরে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
আরাফাত মুন্সির চাচা মহিউল আলম (পৃথ্বীরাজ) গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আরাফাতের মৃত্যু আমাদের পরিবারের সবার জন্য একটা বড় ধাক্কা। এতটুকু ছেলেকেও রেহাই দেয়নি পুলিশ। তিনি আরও বলেন, আমরা একটা গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসককে বিদায় দিয়েছি ঠিকই; কিন্ত এর কুশীলবদের তো এখনো কিছুই হলো না। তৎকালীন প্রশাসনের কিছু লোক গ্রেপ্তার হলেও অনেকেই বহাল তবিয়তে আছেন। শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে ২৪-এর জুলাই আন্দোলনে প্রতিটি হত্যাকা-ের কুশীলবদের গ্রেপ্তার করে বিচার ত্বরান্বিত করার দাবি জানাই। যারা বিদেশে পালিয়ে গেছে তাদের দেশে এনে বিচার করতে হবে।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশারাফুল হুদা আমাদের সময়কে বলেন, জুলাই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। বিশেষ করে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা গুলির নির্দেশ দিয়েছে, গুলি চালিয়েছে প্রত্যেককে ধরতে হবে। তিনি বলেন, পুলিশের ইমেজ উদ্ধার এবং পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ফেরাতে হত্যাকা-ে জড়িত পুলিশ সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে হবে। কেউ কেউ হয়তো গ্রেপ্তার এড়াতে বিদেশে পালিয়ে গেছে। কেউ দেশেই আত্মগোপনে আছে। তাদের আইনের আওতায় আনতে সব ধরনের প্রচেষ্টা নিতে হবে।
পুলিশের তদন্তকারীরা বলছেন, গত বছর জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের নীতির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে বিক্ষোভকারীদের ওপর ‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের সরাসরি নির্দেশদাতা ছিলেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিবিসি, আল জাজিরা ও জাতিসংঘের পৃথক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সময় তিনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিক্ষোভকারীদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার নির্দেশের পরই পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর একের পর এক প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। যার ফলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা গুলিতে হতাহত হতে থাকে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও শেখ হাসিনার ওই নির্দেশ বহাল ছিল।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ দমনে র্যাব, পুলিশ, বিজিবির পাশাপাশি কোথাও কোথাও ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা গুলি চালায়। দেশি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলে পড়ে। জুলাই বিপ্লবে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়েছিল রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভার। সেখানে শহীদ হন শিক্ষার্থীসহ ৭১ জন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর বসিলা মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়। সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় এসব এলাকায়।
এদিকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে বলা হয়, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ঘটনায় এক হাজার ৪০০ জনকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে ১১৮ জনই শিশু। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জুন প্রকাশিত বাংলাদেশ সরকারের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন অনুসারে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ৮৪৪ জনকে শহীদ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই সময়ে বলা হয়েছিল, তালিকা অব্যাহত থাকবে।