Image description

সরকার পতনের আগের রাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শেখ হাসিনার কাছে খবর পাঠানো হচ্ছিল, পরদিন ৫ আগস্ট লাখ লাখ মানুষ ঢাকার রাজপথে নেমে আসবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর থাকবে না, এমন ইঙ্গিতও ছিল গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোতে। পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও আসন্ন পরিস্থিতির কথা জানিয়েছিলেন।

কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে ছিলেন অনড়। তিনি আরও রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাহিনীগুলোকে চাপ দেন। ৪ আগস্ট অনেক রাত পর্যন্ত তিনি আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টায় ছিলেন।

পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) জবানবন্দি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য, গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং গণভবনে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে গত বছর ৪ ও ৫ আগস্টের শেখ হাসিনার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সরকার পতনের সব ধরনের বাস্তবতা থাকার পরেও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। বরং আগের দিন এ প্রসঙ্গ ওঠায় ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন তিনি। দেশ ছেড়ে পালানোর আগের রাতেও বলেছিলেন, যেকোনোভাবেই হোক আন্দোলন দমন করতে হবে।

কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখতে ছিলেন অনড়। তিনি আরও রক্তপাত ঘটিয়ে হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাহিনীগুলোকে চাপ দেন। ৪ আগস্ট অনেক রাত পর্যন্ত তিনি আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে ব্যবহারের চেষ্টায় ছিলেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের আগের দিন ৪ আগস্টকে ‘ভয়ংকর ও উত্তেজনাপূর্ণ’ বলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক শুনানিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে ও বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।
তৎকালীন আইজিপি ও বর্তমানে কারাবন্দী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের জবানবন্দি

তৎকালীন আইজিপি ও বর্তমানে কারাবন্দী চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে দেওয়া এক জবানবন্দিতে বলেছেন, ৪ আগস্ট দিনে ও রাতে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে গণভবনে শেখ হাসিনা দুই দফা বৈঠক করেছিলেন। এর মধ্যে বেলা ১১টায় আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজে, তিন বাহিনীর প্রধান, তৎকালীন আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ নিরাপত্তা-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির বৈঠক হয়। আন্দোলন পরিস্থিতি এবং তা দমন করার বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে বলা হয়, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এসেছে আন্দোলন গুরুতর পর্যায়ে চলে গেছে। তা দমন করা প্রয়োজন।

সাবেক এই আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সরকারকে সঠিক তথ্য দিতে। সরকার তার দুর্বলতা শুনতে প্রস্তুত ছিল না। এই মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হতে থাকে ও বিভিন্ন স্থানে সমস্যা দেখা দেয়। পরে বৈঠক মুলতবি হয়।’

পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) জবানবন্দি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য, গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং গণভবনে উপস্থিত ছিলেন এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে গত বছর ৪ ও ৫ আগস্টের শেখ হাসিনার কার্যক্রম ও পরিকল্পনা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।
হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনার পলায়নের দৃশ্য। ৫ আগস্ট ২০২৪
হেলিকপ্টারে করে শেখ হাসিনার পলায়নের দৃশ্য। ৫ আগস্ট ২০২৪

দ্বিতীয় বৈঠকটি হয়েছে ৪ আগস্ট রাত ১০টার দিকে। সাবেক এই আইজিপির ভাষ্য অনুযায়ী, এই বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর বোন শেখ রেহানা, তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, তিন বাহিনীর প্রধান, র‍্যাবের ডিজি ও আইজিপি উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠকে শেখ হাসিনার খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমানও (তৎকালীন কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল) উপস্থিত ছিলেন। সেখানে খোলামেলা কথা হয়।

এই বৈঠকে কীভাবে পরদিনের অর্থাৎ ৫ আগস্টের আন্দোলন ও গণজমায়েত দমন করা যায়, তা নিয়ে কথা হয় জানিয়ে সাবেক আইজিপি জবানবন্দিতে বলেন, ‘(গণভবনে) বৈঠক শেষে আমরা সেনাবাহিনীর অপারেশন কন্ট্রোল রুমে চলে যাই। তিন বাহিনীর প্রধান, লে. জেনারেল মুজিব, র‍্যাবের ডিজি, গোয়েন্দা সংস্থা, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ও আমি নিজে ছিলাম। সেখানে ফোর্স মোতায়েন নিয়ে কথা হয়। রাত প্রায় সাড়ে ১২টায় এই বৈঠক শেষ হয়। বৈঠকে ঢাকা শহর, ঢাকার প্রবেশমুখে কঠোর অবস্থান নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, গণভবনে ৪ আগস্ট রাতের বৈঠকে শেখ হাসিনাকে সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, (বৈঠকের) এসব আলোচনা কাজে লাগবে না। সময় ফুরিয়ে গেছে।

এদিকে প্রভাবশালী একটি দেশের কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ৪ আগস্ট দিবাগত রাত আড়াইটায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রভাবশালী ওই দেশের দূতাবাসকে জানিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

সেনা সদর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট ভোর চারটায় ডিজিএফআইয়ের তৎকালীন মহাপরিচালককে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছিলেন সেনাপ্রধান। যাতে ৫ আগস্ট বিকেলে সেনা সদরে বৈঠকে দলগুলোর নেতারা আসেন। ৫ আগস্ট বিকেলে ওই বৈঠক চলাকালে সেনাপ্রধানকে ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক জানান যে শেখ হাসিনা চলে যাচ্ছেন।

প্রভাবশালী একটি দেশের কূটনৈতিক সূত্র থেকে জানা গেছে, ৪ আগস্ট দিবাগত রাত আড়াইটায় তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রভাবশালী ওই দেশের দূতাবাসকে জানিয়েছিলেন যে শেখ হাসিনা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

তবে গত ২৫ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলার শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম প্রসঙ্গক্রমে ৪ ও ৫ আগস্টের ঘটনাক্রমের একটি বর্ণনা দেন। তাতে তিনি বলেন, গণভবনে ৪ আগস্টের রাত ছিল খুবই উত্তেজনাপূর্ণ ও ভয়ংকর। ওই রাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কয়েক দফা বৈঠকে রাগারাগি ও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।

শুনানিতে ঘটনার বর্ণনায় বলা হয়, বৈঠকে তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি ওঠানো হয়। তখন শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হয়ে বলতে থাকেন, যা হওয়ার হবে, তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না। এ সময় শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে মেরুদণ্ড শক্ত করে কঠোর হয়ে বিক্ষোভ দমনের নির্দেশ দেন।

বিকেল থেকে ছাত্র–জনতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নেন। ৫ আগস্ট ২০২৪, তেজগাঁওয়ে
বিকেল থেকে ছাত্র–জনতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নেন। ৫ আগস্ট ২০২৪, তেজগাঁওয়েছবি: প্রথম আলো

শুনানিতে পরের ঘটনার বর্ণনায় আরও বলা হয়, শেখ হাসিনার নির্দেশের পর জেনারেল তারিক সিদ্দিক শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বলেন, ‘সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে কিছু লোককে মেরে ফেললেই বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে।’ এ ছাড়া জেনারেল তারিক সিদ্দিক বিমানবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথা বলেন। তখন বৈঠকে উপস্থিত বিমানবাহিনীর প্রধান, তারিক সিদ্দিকের ওপর রেগে যান। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডোবাবে।’

ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে থাকার জন্য সেই রাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘গ্যাং অব ফোর’। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁদের পরামর্শ ছিল, কোনোভাবেই নরম হওয়া যাবে না।

জেনারেল তারিক সিদ্দিক বিমানবাহিনীকে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর কথা বলেন। তখন বৈঠকে উপস্থিত বিমানবাহিনীর প্রধান, তারিক সিদ্দিকের ওপর রেগে যান। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এই লোকটি আপনাকে ডুবিয়েছে এবং আরও ডোবাবে।’

শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এর আগে ৪ আগস্ট দুপুরে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি শেখ হাসিনাকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন। তখন এর তীব্র বিরোধিতা করেন সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে থাকার জন্য সেই রাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ‘গ্যাং অব ফোর’। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। তাঁদের পরামর্শ ছিল, কোনোভাবেই নরম হওয়া যাবে না।

শেষ সময়েও পুলিশ ছিল মারমুখী

৪ আগস্ট রাতে গণভবনে বৈঠক চলাকালে সাড়ে ১০টার দিকে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের ব্যানারে নাশকতাকারীরা রাস্তায় নেমেছে। তাদের দমাতে যেভাবে আইন প্রয়োগ করলে হবে, সেভাবেই করা হবে। তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।

মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিএমপি কমিশনের ওই বক্তব্যের পর পুলিশের কাছে বার্তা যায় শেখ হাসিনা টিকে যাবেন। যার কারণে ৫ আগস্ট সকাল থেকে পুলিশ ছিল মারমুখী। এমনকি শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পরও বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে গুলি করতে দেখা গেছে।

শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, এর আগে ৪ আগস্ট দুপুরে গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি শেখ হাসিনাকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন।

৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহ

গণভবনে ৫ আগস্ট সকালেও একটি বৈঠক হয়েছে বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে দেখিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, “ওরা ভালো কাজ করছে, সেনাবাহিনী পারবে না কেন?” তখন চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, “পরিস্থিতি যে পর্যায় গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এমন কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব না।...অস্ত্র-গোলাবারুদ আর অবশিষ্ট নেই, ফোর্স টায়ার্ড (বাহিনী ক্লান্ত) হয়ে গেছে।” এরপর সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেন।’

শেখ হাসিনা রাজি (পদত্যাগে) হচ্ছিলেন না। পরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা। জয়কে বলেন, প্রাণে বাঁচাতে হলে তাঁর মায়ের পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। সময় গুরুত্বপূর্ণ। আর এখনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন জয় এবং তাঁর কথায় ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।

৫ আগস্ট সকালে সামরিক কর্মকর্তারা শেখ হাসিনাকে গণভবনের অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যান বলে শুনানিতে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর। তিনি বলেন, ওই কক্ষে শেখ হাসিনার কাছে সামগ্রিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয় এবং তাঁকে পদত্যাগ করতে আবার অনুরোধ করেন সামরিক কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ডাকে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির কারণে গণভবন অভিমুখে ঢাকার চারপাশ থেকে মিছিল আসছে। একপর্যায়ে শেখ হাসিনাকে তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজি (পদত্যাগে) হচ্ছিলেন না। পরে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা। জয়কে বলেন, প্রাণে বাঁচাতে হলে তাঁর মায়ের পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই। সময় গুরুত্বপূর্ণ। আর এখনই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মায়ের সঙ্গে কথা বলেন জয় এবং তাঁর কথায় ক্ষমতা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা।

সময়-সংকটের কারণে শেখ হাসিনাকে গোছানোর জন্য ৪৫ মিনিট সময় দেওয়া হয় উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, কারণ গণভবন অভিমুখে লাখ লাখ ছাত্র-জনতার মিছিল আসছিল।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ৫ আগস্ট বেলা ১১টায় আইএসপিআর থেকে বিটিভির মহাপরিচালককে জানানো হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার–উজ–জামান বেলা দুইটায় জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। অবশ্য সেনাপ্রধান বক্তব্য দেন বিকেল চারটায়।

তবে ৫ আগস্ট সকালের ওই বৈঠকে আর কে কে ছিলেন, সব নাম ট্রাইব্যুনালের শুনানিতে বলা হয়নি। তৎকালীন আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুন আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তাতে ৫ আগস্ট সকালে তাঁর গণভবন যাওয়া না-যাওয়ার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেননি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী এবং আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে (সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান যত কথা নবনীতা চৌধুরীর সাথে) বলেছেন, তিনি ৫ আগস্ট সাড়ে ১০টার দিকে গণভবনে খবর নিয়ে জানতে পারেন যে সেনাপ্রধান গণভবনে এসেছেন। তিনি পরে গণভবনে গিয়ে জানেন সেনাপ্রধান চলে গেছেন।

নয়াদিল্লির কাছের গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে ৫ আগস্ট দেশটির স্থানীয় সময় ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করে। সেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান বলে সে দেশের গণমাধ্যমে খবর বের হয়।

শেখ হাসিনা দেশ ছাড়েন যেভাবে

শেখ হাসিনা কীভাবে দেশ ছেড়েছিলেন, এ বিষয়ে গত বছর ৬ আগস্ট তখনকার পরিস্থিতিতে একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রথম আলোর খবরে বলা হয়েছিল, ‘এরপর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে আসেন শেখ হাসিনা। সেখানে তাঁদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয়। এরপর তাঁরা বঙ্গভবনে যান। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেন শেখ হাসিনা।’

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, শেখ হাসিনা এখন ভারতেই অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তাঁর একাধিক অডিও বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ভারতে আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।

পরবর্তী সময়ে জানা যায়, শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে যাননি। শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় গাড়িতে করে গণভবন থেকে নিকটস্থ বাণিজ্য মেলার মাঠে যান। সেখান থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে কুর্মিটোলায় বিমানবাহিনীর বঙ্গবন্ধু এয়ারবেইসে যান। সেখান থেকে বিমানবাহিনীর একটি পরিবহন বিমানে (সি-১৩০) তাঁরা ভারতে যান। নয়াদিল্লির কাছের গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে ৫ আগস্ট দেশটির স্থানীয় সময় ৫টা ৩৬ মিনিটে বিমানটি অবতরণ করে। সেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান বলে সে দেশের গণমাধ্যমে খবর বের হয়।

সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, শেখ হাসিনা এখন ভারতেই অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তাঁর একাধিক অডিও বক্তব্য বিভিন্ন সময়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী ভারতে আছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে।