Image description

আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার তৎপরতা শুরু করেছে। দলীয় কার্যক্রম পুনরায় সক্রিয় করতে মাঠের রাজনীতিতে প্রকাশ্যে না নামলেও সংগঠনের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়ে উঠেছে সরব। একইসঙ্গে রাজধানীমুখী লোক সমাগম ও সংঘাতমূলক কর্মসূচির পরিকল্পনাও নিচ্ছে দলটি।

গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক সূত্র বলছে, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই দেশজুড়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঢাকায় এনে সমাবেশের ছক কষছে আওয়ামী লীগ। ইতোমধ্যে ‘ধানমন্ডি ৩২’, ‘ইউনূস হঠাও’, ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘প্রজন্ম ৭১’, ‘শেখ হাসিনা’ ইত্যাদি নামে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক গ্রুপে অপপ্রচার, মিথ্যাচার এবং আতঙ্ক ছড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সংগঠনের সক্রিয় সদস্যরা।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ ইউনিট সিটিএসবির উধ্বর্তন এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মফস্বলের বহু নেতাকর্মী বর্তমানে ঢাকায় আত্মগোপনে রয়েছেন এবং সেখান থেকেই বিদেশে থাকা শীর্ষ নেতাদের নির্দেশে দেশব্যাপী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এই চক্রান্তের মূলহোতা সাদেকুল হক সাদেক নামে ওই মেজর এবং তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন দু'জনই বিনা নোটিশে ১৫০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার সময় শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে নেতাকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। আর সরকার উৎখাতের এই পরিকল্পনার বিষয়টি কলকাতায় বসে সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তাকে সহযোগিতায় সেখানে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তারা। এ ছাড়া সরকার উৎখাতের এই পরিকল্পনায় কৌশলগত সহযোগিতা করছেন দিল্লিতে অবস্থান করা পলাতক অতিরিক্ত আইজিপি ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম এবং ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান পলাতক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিবুর রহমান।

এই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে মফস্বলের কয়েকজন নেতার ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন এবং সরকারবিরোধী নানা অপপ্রচার ছড়িয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে ৮ জুলাই রাজধানীর ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কে বি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় একটি গোপন বৈঠক। ওই বৈঠকে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ এবং অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাসহ ৩০০–৪০০ জন অংশ নেন। সেখানে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য শাহবাগ মোড় অবরোধ, সহিংস বিক্ষোভ ও জনমনে আতঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা হয়। বৈঠকে সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি ভাটারা এলাকার ওই কনভেনশন সেন্টারে সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ করে রাখার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরে এ ঘটনায় পুলিশ কনভেনশন হলটির ব্যবস্থাপক মুজাহিদকে গ্রেপ্তার করে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ওই বৈঠকের মূল পরিকল্পক ছিলেন মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিক। তার নির্দেশেই বরগুনার যুবলীগ নেতা সোহেল রানা ও গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন বিভিন্ন স্থান থেকে তৃণমূল কর্মীদের সংগঠিত করেন এবং ঢাকায় এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বসুন্ধরা ছাড়াও রাজধানীর অন্তত চারটি স্থানে এমন প্রশিক্ষণ হয়েছে, যার ভিডিও ফুটেজ পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। মেজর সাদিককে সেনাবাহিনীর হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। সেনা সদরের ব্রিফিংয়ে এ তথ্য নিশ্চিত করে বলা হয়, তদন্তে দোষ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রচলিত নিয়মে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বসুন্ধরার ওই গোপন বৈঠকের ঘটনায় ভাটারা থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করেছে পুলিশ। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগসহ অন্তত ২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ডিএমপির গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা নজর রাখছি। কেউ যদি অস্থিরতা বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এই বৈঠক এবং ৮ আগস্টের বিষয়ে সামাজিক মাধ্যমে নানা ‘হুমকির’ আলোচনা প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তালেবুর রহমান বলেন, ‘আমরা গত একটা বছরে বিভিন্ন সময় দেখেছি, নানা সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিনষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে কার্যক্রম অনেকেই করেছে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা সজাগ রয়েছি।’

মামলার তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’সহ একাধিক গোপন অনলাইন গ্রুপের সদস্য। এসব প্ল্যাটফর্মে তারা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র ও সহিংস কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করে আসছিল।

জিজ্ঞাসাবাদে সোহেল রানা ও শামীমা নাসরিন জানিয়েছেন, মেজর সাদিকের পরিকল্পনায় বসুন্ধরার কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় বৈঠক হয় এবং সেখানে সরকার উৎখাত ও রাজধানীমুখী অভিযানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একটি সূত্র জানায়, সোহেল রানা ও শম্পাকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করে তথ্য যাচাই করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া মেজর সাদিকুল হক ওরফে মেজর সাদিককে হেফাজতে নেওয়া হয়।

সূত্র আরও জানায়, এখনও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে থাকা নেতাকর্মীরা চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনায় সক্রিয় রয়েছে।

এ বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘নিষিদ্ধ ঘোষণা কেবল কাগজে-কলমে থেকে গেলে চলবে না। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা আত্মগোপনে থেকেই হামলা চালাচ্ছে। আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রকাশ্যে চলাফেরা, নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়া এবং সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা না নেওয়া চরম শৈথিল্যের পরিচয়।’ তিনি বলেন, ‘যারা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছিল, তাদের প্রকাশ্যে বিচারের আওতায় না আনলে এসব অপতৎপরতা আরও বাড়বে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত তিনজন রাজনৈতিক নেতা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অতিরিক্ত নমনীয়তাই নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোকে আবারও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। তারা অভিযোগ করেন, এখনো সারাদেশজুড়ে এমন বহু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মী প্রকাশ্যে চলাফেরা করছেন, যারা গত জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি। এই বিচারহীনতার সংস্কারই তাদের আবারও সংগঠিত হওয়ার সাহস দিচ্ছে।

অন্যদিকে, নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সহিংসতা এবং রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের চেষ্টার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতারা এখন দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর প্রতি সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাচ্ছেন।

গত ২৩ জুলাই দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে জাতীয় স্বার্থের জায়গায় যেকোনো মূল্যে ঐক্যবদ্ধ থাকাতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, ‘পুলিশ যেন কোনো দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার না হয়, বরং নিরপেক্ষভাবে অপরাধীদের ধরতে হবে। রাজনীতির আড়ালে কেউ যেন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক থাকা জরুরি বলেও জানান তিনি।