
জুলাই মাসে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক উস্কানিমূলক বক্তব্য শুধু পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করেছিল। আন্দোলনকারীদের দাবির প্রতি সহানুভূতির বদলে সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হয় দমনমূলক হুমকি ও অপমানসূচক মন্তব্য, যা পরবর্তীতে সরকার পতনের পথকে তরান্বিত করে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আন্দোলনের শুরু থেকেই ধারাবাহিকভাবে মন্তব্য করে উত্তেজনা ছড়ান। ১৫ জুলাই তিনি বলেন, আন্দোলনের জবাব দিতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তার এই মন্তব্যের পরপরই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মারমুখী হয়ে ওঠে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা বেড়ে যায়। পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলায় নিহত হন একাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী।
এ সময় প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, "এই হত্যার দায় শিক্ষার্থীদেরই নিতে হবে"—যা আন্দোলনকারীদের মধ্যে আরও ক্ষোভের সঞ্চার করে। এর আগে শেখ হাসিনার ‘রাজাকার বংশধর’ মন্তব্যে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিনি প্রশ্ন করেন, “মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কি মেধাবী নয়, রাজাকারের বাচ্চারাই কি কেবল মেধাবী?” এমন বক্তব্য শুনে শুধু আন্দোলনকারীরাই নয়, সাধারণ জনগণও স্তব্ধ হয়ে যায়।
৪, ৬ ও ৮ জুলাই ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যে আন্দোলনকারীদের ‘শিক্ষার্থী’ হিসেবে চিহ্নিত না করে ‘রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। তিনি বলেন, “এখানে পলিটিক্সের উপাদান ঢুকে গেছে।” এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনকে দলীয়করণ করা হচ্ছে ভেবে আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরাসরি সংঘর্ষ হয়। আহত হন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আন্দোলনকারীরা লিমিট ক্রস করছে, পুলিশ বসে থাকবে না। এই মন্তব্যের পর থেকেই পুলিশের ভূমিকা আরও কঠোর হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা বুকে-পিঠে পতাকা বেঁধে রাজপথে নামে। এরপর ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনা সফর নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফের রাজাকার মন্তব্য করেন, যা পরবর্তীতে ঢাবি এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে।
১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা চালায়। এই হামলাকেই অনেকেই মনে করেন সরকার পতনের সূচনা বিন্দু। এরপর ১৯ জুলাই ওবায়দুল কাদের বলেন, “ছাত্রলীগ হামলা করেনি, বরং তাদের উপরই হামলা হয়েছে।” একই সময়ে আইনমন্ত্রী বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী কোটা বাতিল হয়ে যাওয়ায় আন্দোলনের আর প্রয়োজন ছিল না।
সেই রাতেই কারফিউ জারি হয় এবং ওবায়দুল কাদের সরাসরি বলেন, "দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশনা রয়েছে।" একজন রাজনৈতিক নেতার মুখে এমন বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। ২১ জুলাই জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের হত্যার দায় নিতে হবে। একইদিন আন্তর্জাতিক মহলের চাপ এড়াতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে দাবি করেন, এই আন্দোলনে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা জড়িত এবং দেশে নাশকতা চালাচ্ছে।
এই “জঙ্গি” ও “উগ্রপন্থী” তকমা দিয়ে আন্দোলন দমন নীতির আড়ালে চালানো হয় নির্মম হামলা, যেখানে শিক্ষার্থীদের হত্যা করা হয়, গুম করা হয়, গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক বক্তব্য, ধর্মের অপব্যবহার এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক অন্ধ ভক্তির কারণে দেশের পরিস্থিতি দিনদিন আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
২৮ জুলাই গণভবনের ব্যাংকুয়েট হলে নিহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে ডেকে শেখ হাসিনা বলেন, আল্লাহ যেন এই খুনিদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করেন। তবে তখন পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে, অনেকেই এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। যারা যান, তারা স্পষ্টভাবে চাপের মুখে গিয়েছিলেন বলেও জানানো হয়।
সবকিছুর পর মাত্র আট দিনের ব্যবধানে, ৫ আগস্ট রাতের আঁধারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। পতন ঘটে দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ সরকারের।