
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডানপন্থি-বামপন্থিদের নিয়ে আলোচনা বেশ অনেকদিন ধরেই চলছিল। তবে এই প্রথম দক্ষিণপন্থিদের নিয়ে আলোচনা সামনে এসেছে।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে লেখক, গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশে দক্ষিণপন্থিদেরই রাজত্ব চলছে। দক্ষিণপন্থিরাই বাংলাদেশের রাজনীতি কবজা করে রেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মন্তব্যে দক্ষিণপন্থিদের নিয়ে আলোচনা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
গত শনিবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হচ্ছে, আমি এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।’
বাংলাদেশকে সব সময় একটা সত্যিকার অর্থে উদারপন্থি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখতে চান- এমন আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন মির্জা ফখরুল। তবে তার এই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইসলামপন্থি দু-একটি দল। চরমমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভুল বার্তা দেবে।
বস্তুত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে ডানপন্থি দলগুলোর বড় ধরনের তৎপরতা জনগণের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে দাবিদার আওয়ামী লীগ এখন রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত। কিন্তু অন্য উদারপন্থি বলে পরিচিত দল বিএনপিকে নানা ইস্যুতে ইতোমধ্যে ইসলামপন্থি বলে পরিচিত দলগুলো কিছুটা চাপে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই বিএনপি মহাসচিবের মুখ থেকে দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের কথা উঠে আসার ঘটনাকে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের কেউ কেউ বলছেন, দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হবে এটা আগেই আচঁ করা গিয়েছিল। দেশি-বিদেশি অনেক পর্যবেক্ষক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই অনেকবার এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তারা বলেছেন, স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তথা গণতন্ত্রের চর্চা ব্যাহত হলে দেশে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হবে এবং এমন পরিস্থিতিতে এক সময় দেশে ডানপন্থি বা দক্ষিণপন্থিদের উত্থান ঘটতে পারে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে দেশে রাজনীতির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়েছিল এবং ভিন্ন মত দমিয়ে রেখে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। বিএনপি ছাড়াও জামায়াত ও ইসলামপন্থি অনেক দল সভা-সমাবেশ করতে পারেনি। মামলা-হামলা এ গ্রেপ্তারে দলগুলো কাবু হয়ে পড়েছিল। মানুষের পুঞ্জীভূত এই ক্ষোভ থেকেই এক পর্যায়ে গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতির কারণেই এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, বিদ্যমান এই শূন্যতার কারণেই এতদিন চাপের মুখে থাকা দলগুলো অনেক বেশি শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।
‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুসারে, দক্ষিণ শব্দের অর্থ ডান; যেমন দক্ষিণহস্ত মানে ডানহাত। ডানপন্থিদের এ কারণেই দক্ষিণপন্থি বলা হয়। যেকোনো কট্টর, রক্ষণশীল ও ধর্মাশ্রয়ী দলকেও ডানপন্থি বলে মনে করা হয়।
বাংলা একাডেমির সভাপতি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘বিগত সরকার সাড়ে ১৫ বছর ভিন্নমতকে চাপিয়ে রাখার কারণে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হতে পারে। নির্বাচনের নামে শেখ হাসিনার আমলে নির্বাচন কমিশনের নামে নানা প্রচার হয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া যদি ঠিক থাকলে দক্ষিণপন্থিদের উত্থানের সুযোগ আসতো না। আমরা যদি বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা আনতে পারতাম, রাজনীতি যদি সঠিক ধারায় নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করতে পারতাম তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না। আমাদের রাজনৈতিক দুর্বলতার কারণেই দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হয়েছে। রাজনৈতিক অবস্থা মোটামুটি ভালো থাকলে আজকের এই অবস্থা হতো না।’
তিনি বলেন, আমাদের মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। সংগঠনগত ও আদর্শগত পুনর্গঠনের বিকল্প নেই। আমাদের আদর্শনিষ্ঠা, সততা ও চরিত্র বদলানো লাগবে। গোটা জাতির মধ্যে যে মনোবলহারা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার গভীরতাও বুঝতে হবে। আমাদের আদর্শবোধ ও নিষ্ঠা সুদৃঢ় হলে মৌলবাদ টিকবে না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সময়ে ইসলামী দলগুলোর তৎপরতাকে অস্বীকার করা হয়েছে, তাদের ঘরবন্দি করে রাখা প্রচেষ্টা ছিল- এগুলো কোনো দেশে চলতে পারে না। এ জন্য গণ-অভ্যুত্থানের পর তাদের উত্থান হতে পারে।’
তবে বিএনপি মহাসচিব সরাসরি ইসলামপন্থিদের কথা বলেননি এমনটি দাবি করে তিনি বলেন, ‘এদেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বাধাগ্রস্ত করার তৎপরতা থেকে সবারই বিরত থাকা উচিত। অপতৎপরতা কোনোক্রমেই গণতন্ত্রে সম্ভব নয়। বিশেষ করে নারীদের নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটছে, তা প্রকাশ্যে আসছে। নারীরাই জুলাই অভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাদেরকে আপনারা ঘরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন, এটা হতে পারে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী মনে করেন, তিন কারণে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান হয়েছে। প্রথমত, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির জন্য মানুষ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। অনেকে মনে করছেন, জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো তো চাঁদাবাজি বা দুর্নীতি করে না। দ্বিতীয়ত, ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকার রয়েছে। সেটার রিঅ্যাকশন হিসেবে এখানে একটা ইসলামপন্থিদের উত্থান হতে পারে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশকে ভারতের আধিপত্যের হাত থেকে বাঁচাতে ইসলামপন্থিদের উত্থান হতে পারে। তবে তাদের সত্যিই উত্থান হয়েছে কি না নির্বাচন হলে বোঝা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ইসলামী দল থাকবে এটা স্বাভাবিক। বিগত সময়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ এদের সহায়তা করেছে। বড় সমাবেশ করা মানে নির্বাচনে জয়লাভ করবে, এটা বোঝা যাবে নির্বাচনের পর।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিগত সরকারই এদের (দক্ষিণপন্থিদের) লালন-পালন করেছে। ক্ষমতার প্রয়োজনে তারা এর কাঁধে বন্দুক রেখেছিল, আবারও ওর কাঁধেও বন্দুক রেখেছিল। হেফাজতের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে সিলেবাস বদল করেছিল। ইসলামী আন্দোলনকে গত ১৫ বছর সুযোগ নির্বিঘ্নে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছিল। আবার জামায়াতের লোকজনও ছাত্রলীগ ছিল তা অভ্যুত্থানের পর প্রকাশ্য এসেছে। এর ফলে তাদেরও সঙ্গে আওয়ামী লীগের তলে তলে একটা সম্পর্কও থাকতে পারে। সে (শেখ হাসিনা) বোঝাতে চেয়েছে আমি বেশি ইসলামপন্থি এটা নিয়ে প্রতিযোগিতা করেছে। এটার ফলে তারা ভেতরে ভেতরে শক্তি অর্জন করেছিল এবং অভ্যুত্থানের পর স্ট্রাকচারগুলো ভেঙে যাওয়ায় সুযোগকে ব্যবহার করে তারা বিপদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কৌশল করে যদি দানব বা সাপকে লালন-পালন করে তাহলে তারা তো ছোবল মারবে। ঠিক তাই হয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, জনতার শক্তির কাছে রক্ষণশীল শক্তি টিকে থাকতে পারবে না। সেজন্য এই গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য অর্জনে আমাদের আরও অনেক দূর পর্যন্ত সংগ্রাম করতে হবে এবং সতর্ক থাকতে হবে।’
সেলিম আরও বলেন, ‘এই দক্ষিণপন্থিরা যতই অপচেষ্টা করুক না কেন, অভ্যুত্থানের নায়ক ছিল জনগণ। কিন্তু এখন এটাকে বিভ্রান্ত করে উল্টো দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে এবং সেটি হলো ভয়ের কথা। সেই বিপদ সম্পর্কে সতর্ক থেকে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে; যেমন এখন সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এত সংস্কার করে আমরা সামনের দিকে যাব নাকি পিছনের দিকে যাব, এটা বলা হচ্ছে না।’
দক্ষিণপন্থিদের ডানপন্থি তথা প্রগতি-বিরোধী মতামত বলে মনে করা হয়। দক্ষিণপন্থিরা শুধু বাংলাদেশ নয়, ইউরোপসহ অন্যান্য মহাদেশেও মধ্যপন্থি তথা উদারপন্থিদের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে। ২০০০ সালে ইউরোপে (ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন) অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা শহর থেকে প্রথম উগ্র-ডানদের উত্থান শুরু হয়েছিল। সে বছরই প্রথম একটি মধ্য-ডানপন্থি দল আর ফ্রিডম পার্টি নামে একটি উগ্র-ডানপন্থি দলের সঙ্গে জোট গড়ে। এরপর থেকে সুইডেনে ‘সুইডেন ডেমোক্র্যাটস পার্টি’, ফিনল্যান্ডে ‘দ্য ফিন্স পার্টি’, স্পেনে ‘ভক্স পার্টি’, জামার্নিতে এএফডি পার্টি, গ্রিস, পোলান্ড, হাঙ্গেরি, ইতালি- সবখানেই উগ্র-ডানপন্থি দলগুলোর তালিকা লম্বা হচ্ছে। এ ছাড়া ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে কট্টরপন্থি ও গোঁড়া ধর্মভিত্তিক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব আরও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে বলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও আলোচনা রয়েছে।
অন্যদিকে, ডানপন্থার বিপরীত মতবাদ বামপন্থা হিসেবে পরিচিত। ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে রাজনীতিতে বামপন্থা ও ডানপন্থা শব্দের প্রচলন বেশি দেখা যায়। মূলত রাষ্ট্রপতি বা স্পিকারের ডান পাশে যারা বসতেন তাদের বলা হতো ডানপন্থি এবং বাম পাশে যারা বসতেন তাদের বলা হতো বামপন্থি। ডান পাশে অভিজাত শাসনব্যবস্থা, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র এবং প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম তথা চার্চ প্রতিষ্ঠানের সমর্থকরা থাকতেন। আর বাম পাশে কট্টর রক্ষণশীলদের সমর্থকরা থাকতেন। তবে ১৯১৭ সালে সোভিয়েত বলশেভিক বিপ্লবের পরে পুঁজিবাদের বিপরীতে সমাজতন্ত্রীরা বামপন্থি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বামপন্থিরা সব সময় আলোচনায় থাকলেও নির্বাচনের রাজনীতিতে তারা কখনোই খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। সেই তুলনায় ডান বা ইসলামপন্থি দলগুলো রাজনীতিতে কম-বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াতে ইসলামীর তৎপরতা ব্যাপকভাবে জনমনে স্পষ্ট হয়েছে। পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলন, হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য ইসলামপন্থি দল এবং সংগঠনের তৎপরতা বেড়েছে কয়েকগুণ। গত ২৮ জুন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশে ব্যাপক জনসমাগম হয়। এরপর ১৯ জুলাই একই স্থানে জামায়াতের জাতীয় সমাবেশেও নেতা-কর্মী ও সর্মথকদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্য দিয়ে ইসলামপন্থি তথা দক্ষিণপন্থিদের উত্থান সবার নজর কেড়েছে। এর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ইসলামপন্থিরা নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও শেখ হাসিনার সরকার তাদের কঠোর হস্তে দমন করে। ওই ঘটনায় হত্যা ও গুমের অভিযোগ আছে। এরপর অনেকদিন ইসলামপন্থিরা কণ্ঠস্বর জোরালো করলেও আলোচনায় তেমন একটা স্থান পায়নি।
পুঁজিবাদে বিশ্বাসী বিএনপি ডানপন্থি হিসেবে পরিচিত হলেও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকে দলটি কট্টর নয়। তাদের অবস্থান হলো ডানের বামে এবং বামের ডানে। বিশিষ্ট গবেষক বদরুদ্দীন উমর সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দলটিকে প্রগতিশীল ও উদার বলে উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে আগস্টের অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের গঠিত দল এনসিপি বলেছে, তারা বামপন্থিও না, দক্ষিণপন্থিও না, তারা মধ্যপন্থি।