
ছয় বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেনি রাজশাহী জেলা বিএনপি। জেলা-উপজেলাসহ বিভিন্ন কমিটি গঠন নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে সৃষ্টি হয়েছে অচলাবস্থা।
২০১৯ সালের ৫ জুলাই জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাক্ষরিত তিন মাসের জন্য ৪১ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
তিন মাসের আহ্বায়ক কমিটি ছয় বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কেন্দ্র থেকে মীমাংসার জন্য কমিটি গঠন করা হলেও বিভেদ কমছে না। বরং সংঘর্ষে গড়াচ্ছে অনেক ইউনিটে। ফলে চলমান নির্বাচন কেন্দ্রিক সভা-সমাবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন দলের সিনিয়র নেতারা।
সময় যতই যাচ্ছে, কমিটি গঠন নিয়ে মতবিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, দখলসহ নানা কারণে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল আরো প্রকাশ্য হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হামলা-সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক আহত এবং তিন নেতাকর্মী খুন হয়েছেন।
কমিটির বাইরে থাকা নেতাকর্মীদের অভিযোগ, দলীয় পদে থাকা বিএনপির কতিপয় নেতা পদ-পদবি ভাঙিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছেন। তারা আওয়ামী লীগের দোসরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। করছেন মামলা বাণিজ্য। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছেন দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা, যারা গত ১৬ বছর জেল-জুলুমসহ স্বৈরাচারী সরকারের অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার।
অপর পক্ষের নেতাকর্মীদের পাল্টা অভিযোগ, যারা বিগত ১৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রামে রাজনীতির মাঠে অনুপস্থিত থেকেছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারাই এখন মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দখলবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়াচ্ছেন।
এতে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। দলের কোনো পদে না থেকেও তারা দলের নাম ভাঙিয়ে সব অপকর্ম করে যাচ্ছেন। কেন্দ্র থেকে একাধিকবার সতর্ক করার পরও তারা থামছে না।
২০১৯ সালের ৫ জুলাই রাজশাহী জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ভেঙে দিয়ে তিন মাসের জন্য আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। ৪১ সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় আবু সাঈদ চাঁদকে; আর সদস্য সচিব করা হয় বিশ্বনাথ সরকারকে। তিন মাসের এই কমিটি পার করে দিয়েছে ছয় বছর। এরপরও সম্পন্ন হয়নি ইউনিট কমিটিগুলো।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে বিএনপির অধীনে ইউনিট রয়েছে ২৩টি। এর মধ্যে ১৪টি পৌরসভা ও ৯টি উপজেলা। ২৩ ইউনিটের মধ্যে গত ছয় বছরে ৯টিতে শুধু সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে আংশিক কমিটি করা হয়েছে এবং দুটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছে। এগুলো হলো গোদাগাড়ী উপজেলা এবং গোদাগাড়ী পৌরসভা।
তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বলছেন, কমিটি গঠন নিয়ে দলের জেলা নেতৃত্ব আন্তরিক নয়। তৃণমূলের প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপ এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সৃষ্ট কোন্দলের কারণে কমিটি গঠন সম্ভব হচ্ছে না। এতে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে; সঙ্গে বাড়ছে কোন্দলও। তারা অবিলম্বে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা ইউনিটে পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের নিয়ে নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়ারও দাবি জানান।
বাগমারা উপজেলা বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতা একরাম হোসেন বলেন, আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা প্রয়োজন।
আরেক তৃণমূলের নেতা আব্দুর রাকিব বলেন, সুসময়ে এখন ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে নেতার অভাব নেই। নেতৃত্বের জট লেগে যাচ্ছে। দলের জন্য যারা হাসিনার আমলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের যেন মূল্যায়ন করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।
জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির সদস্য গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, জেলার ২৩টি ইউনিটের ৯টিতে আংশিক কমিটি এবং দুটিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হয়েছে। তিনি ফেসবুকে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দিয়ে পোস্ট করেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ রাজশাহী বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির ৬ বছর পূর্ণ হলো!’
আহ্বায়ক কমিটির আরেক সদস্য তাজমুলতান টুটুল কমেন্টে বলেন, এই কমিটি না থাকলে ছয় বছর ধরে সদস্য পরিচয় দিতে পারতাম না। আজীবনের জন্য এই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হোক।
বিএনপির সাবেক নেতা ও সিনিয়র আইনজীবী এনামুল হক বলেন, লজ্জার কথা! জেলার প্রতিটি থানায় ও পৌরসভা এলাকায় বিএনপির শত শত নেতাকর্মী থাকা সত্ত্বেও গঠনতান্ত্রিক বিধান অনুযায়ী যথাসময়ে কাউন্সিল না হওয়া দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রমাণ।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সচিব বিশ্বনাথ সরকার বলেন, ২০১৯ সালে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকে দেশে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চললেও গ্রেপ্তার বা হয়রানির কারণে পুরোদমে চালানো সম্ভব হয়নি।
তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে ইউনিটগুলোর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার চেষ্টা করা হলেও আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রত্যাশিত প্রার্থীদের বাধার সম্মুখীন হচ্ছি। তারা সবাই নিজেদের মতো কমিটি চাচ্ছে। এরপর শিগগিরই বাকি ইউনিটগুলোর সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে জানান তিনি।