
পুলিশের রাজনৈতিক ভূমিকা ও ব্যাপক দমন-পীড়নের কারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে’ রূপ নিয়েছিল। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগে আওয়ামী লীগের স্বৈরাচারী শাসকের পতন ঘটে। দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ৫ আগস্টের পর দেশের সার্বিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের প্রশ্নে বারবার আলোচনায় উঠে এসেছে পুলিশের একাংশের বিতর্কিত ভূমিকা।
শুধু মাঠপর্যায়ে নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম জড়িয়েছে গুম, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন; সর্বোপরি অবৈধ সম্পদ অর্জনের মতো গুরুতর অভিযোগে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দলীয় লেজুড়বৃত্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে যেমন বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে, আবার অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে করা হয়েছে গ্রেপ্তার।
তবে, অধিকাংশ ‘বিতর্কিত ও অপরাধী’ পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন পলাতক অবস্থায়। সময়মতো তাদের গ্রেপ্তার বা অবস্থান শনাক্ত করতে না পারায় প্রশ্ন উঠছে— আইন কি শুধুই দুর্বলদের জন্য, নাকি প্রভাবশালী পলাতক কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে রয়েছে সংশ্লিষ্টদের সদিচ্ছার অভাব!
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের আল্টিমেটাম সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক প্রভাবশালী কর্মকর্তা আর কাজে যোগ দেননি। এমন পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা কর্মকর্তাদের ‘অপরাধী’ হিসেবে সন্ধান করেও খুঁজে পাচ্ছে না বাহিনী-সংশ্লিষ্টরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ ৮ জুলাই দেওয়া তথ্যমতে, নানা অভিযোগে কর্মকর্তাসহ ৫১ জন পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হয়েছে ৮২ জন সদস্যকে। তদন্তকারী সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে দেশে ফিরিয়ে দিতে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে এনসিবি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়ন, হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬১ জন। গ্রেপ্তার-পরবর্তী তাদের প্রত্যেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
কর্মস্থলে অনুপস্থিতি ও বরখাস্ত কর্মকর্তারা
পুলিশের কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে গত ১১ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, পুলিশের যেসব সদস্য কাজে যোগ দেননি, তাদের জন্য শেষ সময় হচ্ছে ১৪ আগস্ট। ওই দিনের মধ্যে যদি কেউ যোগ না দেন, তাহলে ধরে নেওয়া হবে তারা চাকরি করতে ইচ্ছুক নন। এর আগে ৮ আগস্টের মধ্যে কর্মকর্তাসহ অনুপস্থিত সদস্যদের নিজ নিজ ইউনিটে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০২৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর (অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ৪০ দিন পর্যন্ত) কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পুলিশের ১৮৭ জন সদস্য। তাদের মধ্যে রয়েছেন ডিআইজি (উপ-মহাপরিদর্শক) পদমর্যাদার একজন, অতিরিক্ত ডিআইজি সাতজন, পুলিশ সুপার দুজন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার একজন, সহকারী পুলিশ সুপার পাঁচজন, পুলিশ পরিদর্শক পাঁচজন, এসআই ও সার্জেন্ট ১৪ জন, এএসআই নয়জন, নায়েক সাতজন ও কনস্টেবল ১৩৬ জন।
এর মধ্যে কর্মস্থলে গরহাজির ৪৯ জন, স্বেচ্ছায় চাকরি থেকে ইস্তফা দেন তিনজন, ছুটি শেষ হয়ে গেলেও কাজে ফেরেননি ৯৬ জন। এছাড়া, অন্যান্য কারণে পুলিশের ৩৯ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ-ই আর কর্মস্থলে যোগ দেননি।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা পুলিশের চার কর্মকর্তাকে সর্বশেষ গত ১৪ জুলাই সাময়িক বরখাস্ত করে সরকার। এর মধ্যে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর ভাই ও ডিএমপির সহকারী কমিশনার (এসি) গোলাম রুহানীও রয়েছেন। রুহানী গত বছরের ১১ আগস্ট থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত। বরখাস্ত হওয়া বাকি তিন কর্মকর্তা হলেন- ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মো. রওশানুল হক সৈকত, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল ইসলাম এবং ডিএমপির (ট্রাফিক মিরপুর জোন) সহকারী পুলিশ কমিশনার মফিজুর রহমান পলাশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের সর্বশেষ ৮ জুলাই দেওয়া তথ্যমতে, নানা অভিযোগে কর্মকর্তাসহ ৫১ জন পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে ওএসডি (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) করা হয়েছে ৮২ জন সদস্যকে। তদন্তকারী সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদকে দেশে ফিরিয়ে দিতে ইন্টারপোলকে চিঠি দিয়েছে এনসিবি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমন-পীড়ন, হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও মানবতাবিরোধী অপরাধসহ নানা অভিযোগে দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬১ জন। গ্রেপ্তার-পরবর্তী তাদের প্রত্যেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে
বাধ্যতামূলক অবসরে ৫১ কর্মকর্তা
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, নানা অভিযোগে কর্মকর্তাসহ ৫১ পুলিশ সদস্যকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন- পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, সিআইডির সাবেক প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাহবুবুর রহমান, মো. আতিকুল ইসলাম, র্যাবের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা অতিরিক্ত আইজিপি ব্যারিস্টার হারুন-অর রশিদ, হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি শাহাবুদ্দিন খান, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার (অতিরিক্ত আইজিপি সুপারনিউমারারি) পরবর্তীতে ট্যুরিস্ট পুলিশে কর্মরত ড. খ. মহিদ উদ্দিন, অতিরিক্ত আইজিপি কৃষ্ণ পদ রায়, খন্দকার লুৎফুল কবির, মীর রেজাউল আলম, রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেবদাস ভট্টাচার্য্য, শিল্পাঞ্চল পুলিশের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) এ কে এম হাফিজ আক্তার, ঢাকা পুলিশ টেলিকমের উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক (সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) বশির আহম্মদ, ডিআইজি আব্দুল বাতেন, ডিআইজি জয়দেব কুমার ভদ্র, ডিআইজি আতিকুল ইসলাম, ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিআইজি-সিটিটিসি প্রধান) মো. আসাদুজ্জামান, মো. মনিরুজ্জামান, মো. মোজাম্মেল হক, সরদার রকিবুল ইসলাম, মো. ইমাম হোসেন, অ্যাডিশনাল ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির, আরআরএফ পুলিশ সুপার (পুলিশ সদর দপ্তরে সংযুক্তির আদেশপ্রাপ্ত) মো. মীজানুর রহমান, এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম, ডিএমপির সহকারী পুলিশ সুপার মো. দাদন ফকির, এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভূঁইয়া মাহবুব হাসান, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান ঝন্টু, সিআইডির (এপিবিএনে বদলির আদেশপ্রাপ্ত) মো. জিয়াউর রহমান, এসবির সহকারী পুলিশ সুপার আবু মো. ফজলুল করিম, শিল্পাঞ্চল পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার রনজিত কুমার বড়ুয়া, বেতবুনিয়া পিএসটিএসের সহকারী পুলিশ সুপার অপ্পেলা রাজু নাহা, সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মো. আক্তারুজ্জামান, সিলেট এসএমপির সহকারী পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, মাধবপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. আজিজুর রহমান সরকার।
ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলা ও গ্রেপ্তার
জুলাই-আগস্টে গণহত্যার ঘটনায় দায়ের করা ২২টি মামলায় মোট ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছেন। পলাতক রয়েছেন ৮৭ জন আসামি।
গত ১০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এ তথ্য জানান। ট্রাইব্যুনালে মামলার পরিসংখ্যান নিয়ে বলা হয়, মোট ৩৩৯টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২২টি মিস কেইসে ১৪১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। মোট ৩৯টি মামলার তদন্ত চলছে। এর মধ্যে সাবেক পুলিশ প্রধান ও এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালকসহ অন্তত সোয়া তিন ডজন পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তারা প্রত্যেকে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন।
ওই কর্মকর্তারা হলেন- সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর বিভাগের সাবেক উপ-কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন মোল্লা, রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির পুলিশ সুপার তানভীর সালেহীন ইমন, র্যাবের দুই সাবেক কর্মকর্তা এসপি মহিউদ্দিন ফারুকী, বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন, আশুলিয়ায় ছয় লাশ পোড়ানোর ঘটনায় বরখাস্ত ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, দারুস সালাম জোনের সাবেক এডিসি এম এম মইনুল ইসলাম, ডিএমপির বাড্ডা জোনের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার রাজন কুমার সাহা, ঢাকার ওয়ারী জোনের সাবেক এসি তানজিল আহমেদ, পুলিশের সাবেক এসি (ডিবি) জাবেদ ইকবাল, উত্তরা পূর্ব থানার সাবেক ওসি মো. মুজিবুর রহমান, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক, ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ, এসআই চঞ্চল চন্দ্র, সাবেক এসআই মো. আব্দুল মালেক, কনস্টেবল মুকুল হোসেন, শাহবাগ থানার ওসি অপারেশন মো. আরশেদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন, মো. নাসিরুল ইসলাম, সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সাহা, রবিউল আলম, গাজীপুরের কোনাবাড়ি থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিদর্শক কে এম আশরাফ উদ্দিন, গাজীপুরের সাবেক ডিবি সদস্য পরিদর্শক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম, কনস্টেবল ফাহিম হাসান, কনস্টেবল মাহমুদুল হাসান সজিব, মো. আকরাম হোসেন, উত্তরার কনস্টেবল হোসেন আলী ও সিলেট কোতোয়ালি মডেল থানার সাবেক ওসি মঈন উদ্দিন শিপন।
পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ
এদিকে, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ট্রাইব্যুনালে হাজির হতে বলা হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুলকে।
সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহার আটক
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় হওয়া একটি হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ইকবাল বাহারকে ২০ জুন রাতে রাজধানীর বেইলি রোড থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ইকবাল বাহার বেইলি রোডের একটি ক্লাবে জুয়া খেলছিলেন। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ডিএমপি জানায়, গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী, মিরপুর মডেল ও গুলশান থানায় পৃথক তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে। ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র ইকবাল বাহার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। ২০১৯ সালে সেখান থেকে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে স্বাভাবিক অবসরে যান।
ডিএমপির সাবেক কর্মকর্তা মশিউর ও জুয়েল বরখাস্তের পর গ্রেপ্তার
গত বছরের ২৪ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক উপ-কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান ও সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জুয়েল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তের আগেই ডিবির সাবেক ডিসি (সুপারনিউমারারি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) ও পুলিশ সুপার হিসেবে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত মশিউর রহমানকে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করে ২০ সেপ্টেম্বর আদালতে পাঠানো হয়। অন্যদিকে, ডিএমপির ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি বিভাগের এডিসি (সুপারনিউমারারি পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) জুয়েল রানাকে নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার করে ১৮ অক্টোবর আদালতে পাঠানো হয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য কয়েক ধাপে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। তাদের মধ্যে আর্থিক অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল
বরখাস্ত-অবসরে পাঠানো অধিকাংশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে-পলাতক
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের পলাতক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ কানাডা, কেউ ভারতে, আবার কেউ দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নাম পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের মনিরুল ইসলাম ও ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার।
হাবিবুর রহমানের অবস্থান জানে না পুলিশ
৫ আগস্টের পরেও অনেকটা সরবে থাকা হাবিবুর রহমান এখন কোথায়, তা নিশ্চিত নয় পুলিশ। ২০০১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীতে দীর্ঘ ও আলোচিত কর্মজীবন সম্পন্ন করেন হাবিবুর রহমান। ৫ আগস্টও ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি সক্রিয় ছিলেন। ৫ আগস্ট থেকে কর্মস্থলে আর উপস্থিত হননি। তিনি দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
গত ২৫ মে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ চানখাঁরপুল হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাবিবুরসহ চারজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। চানখাঁরপুলে আন্দোলন দমনের সময় ছয়জন নিহতের ঘটনায় হাবিবুরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, হাবিবুর নিজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তার অধীনস্থরা গুলি চালায়। ২০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে চানখাঁরপুলে পুলিশের ভূমিকা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত হয়। ২৫ মে অভিযোগপত্র গ্রহণ করা হয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে বিচারাধীন মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তার, তার স্ত্রী ও সন্তানদের ব্যাংক লেনদেন স্থগিত করা হয়। পরিবার ও ব্যক্তিগত কোম্পানির সব লেনদেন এবং ব্যাংক লকার ব্যবহারও সীমিত করা হয়।
তবে, হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ নেই। তার অবস্থানও স্পষ্ট নয়। তার গ্রেপ্তার হওয়াটাও প্রায় অনিশ্চিত।
ফেসবুকে সরব মনিরুল, ধরতে অনীহা পুলিশের
অন্যদিকে, পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ও বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, নাকি দেশেই আছেন— তা নিয়ে ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনের নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২৫ কোটি টাকা আনার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ফেসবুকে সরব থাকা মনিরুল ইসলামের অবস্থান শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তারে যেন অনীহা পুলিশের!
এ প্রসঙ্গে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর মনিরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগ করা হয়। ওই সময় তিনি বলেন, ‘আমি পালিয়ে যাইনি। পালাবও না। আমি দেশেই ছিলাম, দেশেই আছি। ভবিষ্যতে দেশেই থাকব।’ তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর অনেক সন্ত্রাসী, জঙ্গি জামিনে মুক্তি পেয়েছে; যাদের আমি নিজের হাতে গ্রেপ্তার করেছিলাম। তারা আমাকে এখন হুমকি দিচ্ছে। আমি তো এখন পুলিশের কেউ নই। আমাকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। আমি এখন স্বাধীন। তাই কোথায় আছি সেটা বলতে পারছি না। তবে, দেশেই আছি। নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারি বাসায় ফিরিনি।’
গত অক্টোবরে তিনি একটি টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পাসপোর্ট বাতিল হওয়ার কারণে দেশ ছাড়া সম্ভব হয়নি। দেশেই আছেন।’ তবে, মনিরুল ইসলামের দেশে থাকার এ দাবি মিথ্যা বলে উল্লেখ করেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী ও আল-জাজিরার সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের খান। ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে ওই অনুসন্ধানী সাংবাদিক লেখেন, “পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের বাংলাদেশে অবস্থানের দাবি মিথ্যা। অন্তত ৬ অক্টোবর (২০২৪ সাল) পর্যন্ত তিনি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ছিলেন। ৬ অক্টোবর স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে তোলা ছবির ফরেনসিক অ্যানালাইসিস করে ‘নয়াদিল্লিতে তিনি ছিলেন’ বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।”
কানাডা পালিয়েছেন ৩৮ মামলার আসামি ডিআইজি হারুন
ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-অর-রশীদ, যিনি ৫ আগস্টের আগে থেকেই নানা বিতর্কে সমালোচিত। ৫ আগস্টে বিতর্কিত ভূমিকা ও কর্মকাণ্ডের জন্য বহুল আলোচিত ও সমালোচিত এ পলাতক পুলিশ কর্মকর্তার নামে ৩৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। তিনি কানাডা পালিয়েছেন বলে জানা গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলি বর্ষণের নির্দেশদাতাদের অন্যতম হিসেবেও তার নাম এসেছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি পর্যায় থেকে এখনও তার বিষয়ে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়নি।
ভারত পালানো বিপ্লব-মেহেদীও সাময়িক বরখাস্ত
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিএমপি) পুলিশের সাবেক যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) বিপ্লব কুমার সরকার ও ডিএমপির ট্রাফিকের (দক্ষিণ) যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গণি স্বাক্ষরিত পৃথক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ জারি করা হয়।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গত বছরের ৬ আগস্ট থেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে মৌখিক বা লিখিতভাবে অবহিত না করে বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত বিপ্লব কুমার সরকার ও এস এম মেহেদী হাসানকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা- ২০১৮ এর ২ (চ) বিধি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে সরকারি চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সাময়িক বরখাস্তকালে বিপ্লব কুমার সরকার বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজির কার্যালয় এবং এস এম মেহেদী হাসান সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত ছিলেন।
অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার ভারতে
পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ার্দার একসময় যশোরের পুলিশ সুপার ছিলেন। ৫ আগস্টের পর হঠাৎ উধাও হয়ে যান তিনি। অধিকাংশ সূত্র তার বর্তমান অবস্থান ভারত বললেও পুলিশের কাছে সেটি অজানা। সূত্র বলছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে একাধিক জমি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আত্মীয়দের নামে প্রচুর জমি, বাড়ি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে, যেগুলোর উৎস অস্বচ্ছ। প্রলয় কুমার জোয়ারদারের চার দেশে ছয়টি বাড়ি থাকা নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকে দায়ের হওয়া অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, পুলিশের সাবেক অ্যাডিশনাল ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার নেত্রকোনার বারহাট্টা ঝিতন গ্রামের ধলাই নদী দখল করে মাছের খামার গড়েছেন। জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৪-৫শ জনকে বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দিয়ে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন। ঢাকার উত্তরায় সাততলা বাড়িসহ একাধিক ফ্ল্যাটও রয়েছে প্রলয় কুমার জোয়ারদারের। এছাড়া, বিভিন্ন দেশে বাড়ি ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। এর মধ্যে ভারতের কলকাতা, চেন্নাই ও দিল্লিতে বাড়ি আছে তার।
দিল্লিতে ডেভেলপার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তিনি। বাড়ি করেছেন সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহর ও আমেরিকায়। বিশেষ করে যেখানে স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছেন, সেখানেই তিনি বাড়ি করেছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র-জনতাকে দমনে অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন পুলিশের এই সাবেক কর্মকর্তা।
হত্যা মামলা থাকার পরও নিরাপদে দেশ ছাড়েন মীর রেজাউল
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম। এর আগে ১৪ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সদস্য মো. আব্বাস আলী বাদী হয়ে পল্টন থানায় মীর রেজাউল আলমের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এরও আগে ১৪ আগস্ট তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দলটির তথ্য সংগ্রহবিষয়ক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দিন খান বাদী হয়ে মীর রেজাউলসহ ১৫ পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে পল্টন থানায় এজাহার দায়ের করেন।
সরকার পতনের পরদিন পালিয়ে যান আবদুল কাহার আকন্দ
বহুল আলোচিত সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি আব্দুল কাহার আকন্দ ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কাহার আকন্দ চাকরিচ্যুত হন। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত ইচ্ছায় দীর্ঘ সাত বছর পর ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি চাকরি ফিরে পান। তার একদিন পর অবসরে যান। পরে ওই বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি দুই বছরের চুক্তিতে নিয়োগ পান তিনি। এরপর চার দফায় চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই একমাত্র পুলিশ কর্মকর্তা, যিনি অবসরে যাওয়ার পরও ১০ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি চূড়ান্ত অবসরে যান। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেও হেরে যান স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরের দিন ৬ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বহুল আলোচিত এ পুলিশ কর্মকর্তা।
গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে ৩ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ
গত ২০ আগস্ট ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা হওয়ার জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যান ডিএমপির সাবেক কমিশনার গোলাম ফারুক। ডিবিকে তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি জানানো হলে তার দেশত্যাগের বিষয়ে আপত্তি জানানো হয়। পরে অবশ্য তিনি বিমানবন্দর থেকে বাসায় ফিরে আসেন।
খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে ডিএমপির কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। আবারও তিনি দেশত্যাগের চেষ্টা করেন। গত ২৬ অক্টোবর রাত আড়াইটায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে থাইল্যান্ড যাবার আগে তাকে আটকে দেওয়া হয়।
প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুদক। খন্দকার গোলাম ফারুকের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রকল্পে অনিয়ম করে অর্থ আত্মসাৎসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য আমলে নেওয়া হয়েছে বলেও জানা গেছে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, চাকরিরত অবস্থায় ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে সারা দেশ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন গোলাম ফারুক। তার দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। তিনি, তার স্ত্রী ও বোনেরা আমেরিকার নাগরিক। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ ও নগদ টাকা রয়েছে তার। কৌশলগত কারণে এই সম্পদ ও নগদ অর্থ নিকটাত্মীয়-স্বজনদের নামে এবং বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে রেখেছেন তিনি। বাড়িতে বাবার নামে তিনতলা বিশিষ্ট আধুনিক বাড়ি, মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, হায়দার আলী স্মৃতি কল্যাণ সংস্থা ও ঢাকার খিলক্ষেতে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার নামে।
এছাড়া, নিজ এলাকায় প্রায় তিন কোটি টাকার জমি ক্রয়সহ বাসাবাড়ি তৈরি করেছেন তিনি। টাঙ্গাইলের ঘাটান্দী মৌজায় তিনতলা বিশিষ্ট একটি আধুনিক বাড়ি, যার মূল্য কোটি টাকা; রয়েছে ২০ লাখ টাকা মূল্যের গাড়ি, চারটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার এবং ভূঞাপুরে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার জমি। চাকরির শেষ সময়ে ব্যাপক অবৈধ ক্ষমতা খাটিয়ে এক হাজার ৪৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। জানা যায়, তিন হাজার কোটি টাকার মধ্যে তিনি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আমেরিকায় পাচার করেছেন এবং বাকি ৫০০ কোটি টাকায় স্ত্রী শারমীন আক্তার খানের নামে জমি ও বাড়ি ক্রয় করেছেন। এর বাইরে তার একাধিক অ্যাকাউন্টে প্রচুর টাকা রয়েছে।
এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক ও তার স্ত্রী শারমীন আক্তার খানের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। গত ১ জানুয়ারি ঢাকার মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন এ নির্দেশ দেন। দুদকের বিশেষ পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন আদালত।
কর্মস্থলে অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করছে মন্ত্রণালয়
কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় সর্বশেষ গত ৩০ জুন পুলিশের ১৪ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-এর বিধি ৩ (গ) অনুসারে, পলায়নের অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ায় বিধি ১২ উপবিধি (১) অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত থাকার সময়ে তারা খোরপোশ ভাতা প্রাপ্য হবেন।
জনস্বার্থে জারি করা প্রজ্ঞাপনে আরও উল্লেখ করা হয়, বরখাস্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনজন পুলিশ সুপার, আটজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও দুজন সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা হলেন- বরিশালে র্যাব-৮–এর সিপিএসসির ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদুর রহমান মনির, ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার এস এম শামীম, সুনামগঞ্জের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুবাইয়াত জামান, উখিয়ায় ৮ এপিবিএনের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইমরুল, রাঙামাটির ডিআইজি এপিবিএনের (পার্বত্য জেলাসমূহ) কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান মোল্লা, নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, রংপুর জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. শাহজাহান, রাজারবাগের পুলিশ টেলিকম সংস্থার টেলিকম অফিসার (এএসপি) মাহমুদুল হাসান, কক্সবাজার ১৬ এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখারুল ইসলাম, ঢাকার সাবেক পুলিশ সুপার এ টি ইউ মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন, সিলেটের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আখতারুল ইসলাম, টাঙ্গাইল নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এস এম জাহাঙ্গীর হাছান, জামালপুরের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিশু বিশ্বাস ও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার আল ইমরান হোসেন।
অন্যদিকে, গত ১ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-১ শাখা থেকে পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনে ছুটি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা তিন পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা হলেন- গত ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) ও বর্তমানে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমিতে কর্মরত নূরে আলম মিনা, ১৮ অক্টোবর থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত ডিএমপির মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক উপ-পুলিশ কমিশনার ও বর্তমানে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত মানস কুমার পোদ্দার এবং ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অনুপস্থিত গাজীপুরের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ-২ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রহমত উল্লাহ চৌধুরী।
এছাড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার সাবেক পুলিশ সুপার এবং পরে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যালয়ে সংযুক্ত মো. আরিফুর রহমান মন্ডল বিনা অনুমতিতে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকায় তাকে বরখাস্ত করা হয়। এর আগে খন্দকার নুরুন্নবী, সঞ্জিত কুমার রায় ও সুদীপ কুমার চক্রবর্তী; যাদের বিরুদ্ধে ৫ আগস্টের পর একাধিক মামলা হয়েছে তাদেরও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত হওয়া অধিকাংশ কর্মকর্তাই গ্রেপ্তার এড়াতে পলাতক আছেন।
সাবেক আইজিপি বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য কয়েক ধাপে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। তাদের মধ্যে আর্থিক অপকর্ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।
বেনজীরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা। এসব সম্পদের মধ্যে ঢাকায় জমি, রিসোর্ট, মাছের খামার, ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে। অন্যদিকে, পরিস্থিতি বুঝে পালিয়েছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকারও।
‘অপরাধী-পলাতক’ পুলিশ কর্মকর্তাদের কাউকে দেশে ফেরানো যায়নি
প্রশ্ন উঠেছে, ৫ আগস্টের পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও অপরাধী ও পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা বিদেশ থেকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি পুলিশ। তাদের অনেকের অবস্থানও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আবার অনেকে মামলা দায়ের ও বরখাস্তের পরও অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকতায় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকারের সদিচ্ছার অভাব। পাশাপাশি রাজনৈতিক বিবেচনা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা না থাকার বিষয়টিও এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে।
এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যদি আন্তরিকতা থাকে তাহলে ইন্টারপোল রেড নোটিশ, মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাগ্রিমেন্ট (MLAA)-এর মাধ্যমে যেকোনো দেশ থেকে পলাতক আসামিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এসবই যেন থেমে আছে রাজনৈতিক সংকেতের অপেক্ষায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যার ঘটনার মামলাগুলো পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করছে। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্তদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সচেষ্ট ছিল এবং রয়েছে। মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।’
অনুপস্থিত-পলাতকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা, পর্যায়ক্রমে শাস্তি
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ৫ আগস্টের পর কাজে যোগ দেওয়া থেকে বিরত থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে পর্যায়ক্রমে বেতন বন্ধসহ বিভাগীয় মামলা দায়ের এবং তাদের শাস্তির আওতায় আনা শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। ইতোমধ্যে নানা অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে আলাদা টিমও গঠন করা হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা যাতে বিদেশে পালাতে না পারেন, সেজন্য বাতিল করা হচ্ছে তাদের অফিসিয়াল পাসপোর্ট।