
প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধান হতে পারবেন না- জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এতে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হবে। মঙ্গলবার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের ১৭তম দিনের সংলাপ শেষে এ কথা বলেন তিনি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা আগেই বলেছি—৭০ অনুচ্ছেদে যেমন ভিন্নমত (ডিসেন্টিং ভয়েস) রাখার সুযোগ রেখেছি, এটিও সেভাবে রাখা যেতে পারে। আমাদের অবস্থান হলো, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না—এমন বিধান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ কোথাও নেই। এটা তার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। পার্লামেন্টারিয়ানরা যাকে চাইবেন, তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী। দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হবেনই এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, আবার তাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে বাদ দেওয়ারও কোনো যৌক্তিকতা নেই।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা এবং দলীয় প্রধান—একই ব্যক্তি হবেন কিনা এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা হতে পারেন, তবে দলীয় প্রধান হওয়া নিয়ে কিছু দলের দ্বিমত রয়েছে।
বৈঠকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নিয়ে বিএনপির দেওয়া সংশোধিত প্রস্তাবের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনপ্রণালী নিয়ে আমরা দলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করে গতরাতে কমিশনের কাছে আমাদের পরিমার্জিত মতামত জমা দিয়েছি। কমিশনের পক্ষে প্রস্তাবিত ৫৮ অনুচ্ছেদের সংশোধন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মোটামুটি ঐকমত্য রয়েছে—সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৫ দিন পূর্বে বা মেয়াদপূর্তির বাইরে ভেঙে গেলে তার ১৫ দিনের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। এখানে কোনো ভিন্নমত নেই।
বিএনপি বাছাই কমিটিতে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল) রাখার কথা কথা বলেছে। তবে সংসদের তৃতীয় বৃহত্তম দল থেকে একজন প্রতিনিধি রেখে পাঁচ সদস্যের কমিটি করার প্রস্তাব করেছে অনেক দল। এ কমিটি দলগুলোর প্রস্তাব করা নামগুলো যাচাই করে একজন প্রধান উপদেষ্টার নাম নির্ধারণ করবে। সর্বসম্মতি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো না যায়, তাহলে বিরোধী দল থেকে পাঁচজন, সরকারি দল থেকে পাঁচজন এবং তৃতীয় বৃহত্তম দল থেকে দুইজন করে মোট ১২ জনের তালিকা তৈরি হবে—যার মধ্য থেকে কমিটি একজনকে নির্বাচিত করার চেষ্টা করবে।
তবে যদি এখানেও একমত হওয়া না যায়, তখন কমিশনের একটি প্রস্তাব ছিল ‘র্যাংক চয়েস ভোটিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার। এ বিষয়ে বিএনপি একমত নয়। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চাই, বাছাই কমিটি যদি সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাহলে ভালো। না হলে আমাদের প্রস্তাব, সর্বশেষ বিকল্প হিসেবে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর (১৩তম) পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে।’ তবে বিএনপি তাতে রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে।
বিএনপি আরও বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকর হলে সংবিধানের ১২৩(৩) ধারা ও ৭২(১) ধারা সংশোধনের প্রয়োজন হবে। প্রথমটি সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন হলে আগের সংসদের সদস্যদের বহাল থাকার বিতর্কিত বিধান সম্পর্কিত, আর দ্বিতীয়টি অধিবেশন আহ্বান নিয়ে ৬০ দিনের সময়সীমার সাথে সম্পর্কিত। বিএনপির মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কার্যকর হলে এসব অনুচ্ছেদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধনের প্রয়োজন হবে, এবং এতে কোনো রাজনৈতিক বিতর্ক নেই।
আলোচনার শেষদিকে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে এ আলোচনায় বিএনপি অংশ নেয়নি। সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে আজ কিছু বলছি না। আগামীকালের আলোচনায় অংশ নিয়ে আমরা তখন আমাদের মতামত দেব।’
সর্বসম্মতির প্রশ্নে উদ্বেগ
সংলাপে সর্বসম্মতির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বসম্মতি সবসময় সহজ হয় না। তবে ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের সময় যেভাবে তিনদলীয় ঐকমত্য হয়েছিল, তা সফল হয়েছিল। সুতরাং আলোচনা ও রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে আমরা আবারো একমত হতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘বিভক্তি নয়, আমরা চাই ঐকমত্য। বিভক্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত হলে ভবিষ্যতে প্রশ্ন থেকেই যাবে।’