
প্রমত্তা পদ্মা, মধুমতি, আড়িয়াল খাঁ নদী বেষ্টিত ফরিদপুরের রাজনীতিও প্রবাহমান। দেশের অন্যতম এই প্রাচীন জেলায় আওয়ামী ধারাই বইছে কয়েক দশক ধরে। দু-একটি এলাকায় জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিদের আধিক্য থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকে ফরিদপুর আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবেই পরিচিত। জুলাই বিপ্লবে হাজারো প্রাণের বিনিময়ে মুছে গেছে সেই কালিমা। দলটির সব প্রভাবশালী নেতা পলাতক, কর্মীরাও অভিভাবকশূন্য হয়ে হতাশার সাগরে ডুবে গেছে। এই মাঠে এখন শুধু জাতীয়তাবাদী ও ইসলামপন্থিদের সরব উপস্থিতি। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটযুদ্ধও হবে এই দুই আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে।
ফরিদপুরের ৯ উপজেলা নিয়ে চারটি আসন গঠিত। এবার নির্বাচনের আমেজ তৈরি হওয়ায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতারা। এছাড়া খেলাফত মজলিস ও ইসলামী আন্দোলনের কয়েকজন নেতাও প্রচার চালাচ্ছেন। তবে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণঅধিকার পরিষদ ও আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) প্রার্থী নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। তৎপরতা দেখা যায় না দলগুলোর কর্মীদেরও।
ফরিদপুর-১ (মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারী)
এ আসনে লড়াই হতে পারে বিএনপি, জামায়াত ও খেলাফতÑত্রিমুখী। আগে দুবার বিএনপি প্রার্থী এখানে জয় পেলেও রাজত্ব করেছে মূলত ফ্যাসিবাদীরা। এবার ভোটের পরিবেশ ফিরলেও জাতীয়তাবাদী তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাথার ব্যথা হয়ে দেখে দিয়েছে নেতাদের অন্তর্কোন্দল। যা নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এবার বিএনপির টিকিট চাইছেন কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম, বোয়ালমারী উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শামসুদ্দীন মিয়া ঝুনু। তাদের নেতৃত্বে এখানে দুটি বলয় প্রতিষ্ঠিত। নির্বাচন যত কাছে আসছে তাদের বিরোধ ততটাই প্রকট হচ্ছে। তাদের মধ্যে একাধিকবার হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এতে দিকভ্রান্ত তৃণমূল নেতাকর্মীরা। এ আসনে আরো দুজন বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন। তারা হলেনÑ কেন্দ্রীয় যুবদলের সাবেক সহ-সভাপতি ও বিগত কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী মনিরুজ্জামান মনির এবং অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বিএনপি নেতা শাহাবুদ্দিন আহমেদ। এছাড়া বার বার নির্বাচিত বর্ষীয়ান নেতা শাহ মো. আবু জাফরও ধানের শীষ পাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন।
জামায়াত প্রার্থী ড. ইলিয়াস মোল্লাকে আগেই মনোনয়ন দেওয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন প্রচারে। বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে ইতোমধ্যে মাঠে শক্ত অবস্থানও তৈরি করতে পেরেছেন জামায়াতের ঢাকা জেলা শাখার এই কর্ম পরিষদ ও শুরা সদস্য।
তিনি বলেন, সংসদীয় আসনের সর্বস্তরের জনগণকে এ কথা বুঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে আল্লাহর সৃষ্ট মহাবিশ্বে তার বিধান কার্যকর থাকায় কোথাও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় না। এই বিধান মানুষের উপর কার্যকর করলে মানবজাতির মধ্যে যে অশান্তি, অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সহজে দূরীভূত হতে পারে। এতে ভোটারদেরও বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জনগণ তাকেই নির্বাচিত করবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস।
এছাড়া খেলাফত মজলিস থেকে মুফতি শরাফাত হোসাইন ইতোমধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রচার শুরু করেছেন। তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ, ওলামা সম্মেলন, ধর্মীয় আলোচনা সভা, দুস্থদের মাঝে সহায়তা বিতরণসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
ফরিদপুর-২ (নগরকান্দা ও সালথা)
ফ্যাসিবাদী আমল অবসানের পর আসনটি থেকে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল ও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (ফরিদপুর বিভাগ) শামা ওবায়েদ নির্বাচনি প্রচার শুরু করেন। পরে মত পরিবর্তন করে কৃষকদল নেতা শহিদুল ফরিদপুর-৪ আসনে প্রচার শুরু করেন। এখন পর্যন্ত আর কাউকে শামা ওবায়েদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সরব হতে দেখা যায়নি।
শামা ওবায়েদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমার বাবার স্মৃতি বিজড়িত এ আসনে আওয়ামী আমলে কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমি নির্বাচিত হয়ে দলীয় নির্দেশিত ৩১ দফা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকব। একই সঙ্গে আমি নারীদের জন্য কাজ করতে চাই। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ পদক্ষেপ থাকবে।’
জামায়াত এখানে মাওলানা সোহরাব হোসেনকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন থেকে প্রচার চালাচ্ছেন মাওলানা শাহ মো. জামাল হোসেন, খেলাফত মজলিস থেকে আল্লামা শাহ আকরাম আলী, খেলাফত আন্দোলন থেকে অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বকুল এবং গণঅধিকার পরিষদ থেকে ফারুক ফকির।
ফরিদপুর-৩ (সদর)
আসনটি থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে প্রচার চালাচ্ছেন জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোশাররফ আলীর ছেলে, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলী ইছা, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ তনয়া, জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক চৌধুরী নায়াব ইউসুফ এবং জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ইছা।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা দিয়ে অ্যাডভোকেট ইছা বলেন, আশির দশকে জেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলাম। দীর্ঘ ৪৬ বছরে চারবার জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হই। এখনো জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। ১৯৯৬ সালের স্বৈরাচার হাসিনার আমলে রাজপথে গুলিবিদ্ধ হই। এরপর আওয়ামী শাসনের সময় বহুবার আহত ও কারা নির্যাতিত হই। আগে চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কখনো দলীয় মনোনয়ন চাইনি। বর্তমানে নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা আমাকেই যোগ্য মনে করছেন। আশা করি দলও আমার ওপর আস্থা রাখবে।
নায়াব ইউসুফ বলেন, ‘আমরা অসহায় মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের জন্য রাজনীতি করি। মানুষ প্রয়োজনে আমাকে পাশে পাবে। বিশেষ করে নারীদের জন্য আমার কাজ করার ইচ্ছা আছে। তাই আগামী নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ‘গ্রিন সিগনাল’ দিয়েছেন। আসনটি বিএনপিকে উপহার দিতে পারব বলে দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে।
এছাড়া কেন্দ্রীয় যুবদলের সহ-সভাপতি মাহাবুবুল হোসেন পিংকু বিএনপির টিকিট প্রত্যাশা করলেও নির্বাচনের মাঠে তার সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি।
জামায়াত থেকে নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন দলটির কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য ও জেলা জামায়াতের সাবেক আমির অধ্যাপক আবদুত তওয়াব। জেলা জামায়াতের সাবেক এ আমির এলাকায় ব্যাপকভাবে পরিচিত। তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিজয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী।
ফরিদপুর-৪ (সদরপুর, ভাঙ্গা ও চরভদ্রাসন)
আসনটিতে বিএনপির দীর্ঘদিনের নেতৃত্ব শূন্যতা, পুর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকা ও নেতৃত্বে দুর্বলতা থাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম খান বাবুল বিএনপির পক্ষে নির্বাচনি প্রচার শুরু করলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তিনি ভোটের মাঠ তৈরির পাশাপাশি ঝিমিয়ে পড়া বিএনপিকে চাঙ্গা করতে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছেন।
আসনটি থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী আছেন আরো একজন। তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা জহিরুল হক শাহজাদা মিয়া। ভোটারদের আস্থা বাড়াতে নিয়মিত সভা-সমাবেশ, গণসংযোগসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন বিএনপির এই কেন্দ্রীয় নেতা।
শাহজাদা মিয়া বলেন, শ্রদ্ধেয় কেএম ওবায়দুর রহমান ও চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের পর আমিই ফরিদপুরের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ বিএনপি নেতা। দীর্ঘ ২২ বছর জেলা বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। আমার স্ত্রী ইয়াসমীন আরা হক দুই বারের সংসদ সদস্য। এবার দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে শতভাগ আশাবাদী।
সদরপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কাজী বদরুজ্জামান বদু আমার দেশকে জানান, দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই তারা কাজ করবেন।
জামায়াত প্রার্থী সরোয়ার হোসেনের উল্লেখযোগ্য কোনো গণসংযোগ লক্ষ্য করা যায়নি। নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কে জানতে তার সঙ্গে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এখানে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা মিজানুর রহমান গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করলেও ভোটের হিসাবে পিছিয়ে আছেন বলে সাধারণ ভোটাররা মনে করছেন। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে স্থপতি মুজাহিদ বেগ পোস্টার সাঁটিয়ে এলাকায় জানান দিচ্ছেন।
ভোটার ফয়সাল সরদার বলেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচনে দুর্নীতিবাজ, দেশের সম্পদ বিদেশে পাচারকারী, চাঁদাবাজ ও স্বার্থান্বেষী কাউকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চাই না। আমরা একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা আশা করি। অন্যথায় জুলাই বিপ্লবের হাজারো প্রাণ বিসর্জনের কোনো মূল্য থাকবে না।
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) ফরিদপুর জেলা শাখার সাবেক সভাপতি ও ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক আলতাফ হোসেন বলেন, ১৯৭০ সাল থেকে নির্বাচনগুলো দেখছি। আগের নির্বাচন ছিল অত্যন্ত উৎসবমুখর। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচনে সে উৎসব হারিয়ে যায়। আগামীতে একটি উৎসবমুখর নির্বাচনের আশা করছি। মাঝে মাঝে ভয় হয় যে এই নির্বাচটিও কোনো বিশেষ দল ছিনিয়ে নেবে কিনা। কিন্তু তারপরও আমি আশাবাদী যে আগামীতে উৎসবমুখর পরিবেশে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।