Image description

আলী আহমদ মাবরুর

 

মাহেরিন আপা আমার মানারাতের সহপাঠী ছিলেন। আমরা একইসাথে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে মাস্টার্স করেছিলাম। বয়সে আমার একটু সিনিয়র হবেন। বনেদি ঘরের মানুষ, তবে একদম সাদামাটাভাবে চলাফেরা করতেন। আমাকে ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন।

তিনি উত্তরাতে থাকতেন, সে হিসেবে আমার প্রতিবেশীও তিনি। উত্তরায় যখন হাতে কয়েকজন মানুষ ছিল, বেশিরভাগ অংশই যখন জলাভূমি ও গাছ গাছালিতে পরিপূর্ণ, তখন থেকে এই এলাকায় তাদের বসতি।

গত কয়েক বছরে মাহেরিন আপা প্রথমে তার পিতা এবং এরপর মাকেও হারালেন। পরিবারের বড়ো সন্তান হিসেবে সকল ভাই বোন বরাবরই তাকে অভিভাবক হিসেবেই গন্য করতেন। তার ছেলে আছে দুটো, ওরাও বেশ বড়ো হয়ে গেছে।

মাহেরিন আপা অনেক বছর যাবৎ মাইলস্টোন প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত। তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাখায় তারা কাজে লাগিয়েছে। আপা এখন সিনিয়র টিচার। সেই হিসেবে বাড়তি কিছু দায়িত্বও ছিল তার দিয়া বাড়ি শাখায়।

গতকাল যখন স্কুলের ওপর বিমানটি আছড়ে পড়ে, তিনি তার স্বভাবসুলভ মায়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। নিশ্চিত আগুনে পুড়ে যাওয়া থেকে কমপক্ষে ২০জনের বেশি ছাত্র ছাত্রীকে তিনি সেইভ করেছেন। কিন্তু এই সাহসী ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কখন নিজের জীবনকেই বিপন্ন করে ফেলেছেন, তা হয়তো তিনি বুঝতেও পারেননি।

দুর্ঘটনার পরই তার সাথে পরিবারের সবার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মধ্যরাতে তার লাশ যখন বাসায় আনা হয়, আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ওনার স্বামী আমাকে দেখে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন, 'জানিস তোর আপা পরশু রাতেও তোর কথা বলেছিল।'

মাহেরিন আপার শরীরের প্রায় পুরোটাই পুড়ে গিয়েছিল। যতক্ষণ জীবিত ছিলেন, অসম্ভব কষ্ট ও যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। বারবার নাকি বলছিলেন, আমার বুক পেট সব জ্বলে যাচ্ছে, আমি হয়তো আর বাঁচবো না। তার লাশটা স্বাভাবিক দেহের মতো নেই। আগুনে পু্ড়ে অনেকটাই ভিন্ন রকম হয়ে গিয়েছিল। 

লাশবাহী গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে পুরনো অনেক স্মৃতিই মনে পড়ছিল। অত্যন্ত বেদনাদায়ক মৃত্যু। তার পরিবারের এটুকু সান্ত্বনা যে, তিনি তার জীবন দিয়ে অনেকগুলো বাচ্চার জীবন সেইভ করে গেলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ফরজ আমল, ইবাদত করতেন বলেই জানি। নিয়মিত কুরআন পড়তেন।

তার বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সাহেবের আপন চাচাতো ভাই এম আর চৌধুরী। যদিও এই পরিচয়টি তিনি দিতে চাইতেন না। পরিবার ছাড়া বাইরের খুব কম মানুষই তার এই পরিচয় জানতো। ফ্যাসিবাদী আমলে যখন কেউ বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান অফিসে কিংবা বাসায় বা হাসপাতালে যাওয়ার সাহস পেত না, মাহেরিন আপা তখন গোপনে বেশ রাত করে যেতেন, খাবার ও পথ্য নিয়ে যেতেন। তবে তিনি এগুলো গোপন রাখতেন। তার ও তার পরিবারের সদস্যরা বিএনপির সুদিনে কখনো সামনে যায়নি। সুবিধা নেয়ার মানসিকতা তার ভেতর আমি দেখিনি বরং স্কুল টিচার হিসেবেই তিনি জীবন কাটিয়ে দিলেন।

আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ যেন তার ওপর রহম করেন। তাকে জান্নাত নসীব করেন। আমিন। সালাতুল ফজরের পর তার নামাজে জানাজা শেষে তাকে নিয়ে পরিবার বাড়ির পথে রয়েছে। সেখানে বাবা-মায়ের পাশেই তাকে দাফন করা হবে ইনশাআল্লাহ।