Image description
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশে হামলা

জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির শীর্ষ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যেই গোপালগঞ্জে তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই প্রস্তুতি নেয়া হয় আগে থেকেই। সে অনুযায়ী বুধবার সকাল থেকেই গোপালগঞ্জের বিভিন্ন পয়েন্ট ও এনসিপির সমাবেশস্থলের আশপাশে অবস্থান নেয় হামলাকারীরা। এর আগের রাতে পুরো জেলার গ্রাম-গঞ্জ থেকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের গোপনে জড়ো করা হয় শহরে। ছোট ছোট গ্রুপে তারা শহরের অলিগলিতে অবস্থান নেয় বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। এছাড়া ঢাকার অনেক সন্ত্রাসীও ওই রাতে গোপালগঞ্জে যায় কিলিং মিশনে অংশ নেয়ার জন্য। তাদের ক্ষুদে বার্তায় তথ্য দেয়া হয়, এনসিপির নেতারা গোপালগঞ্জে ঢুকলে তারা যেন জীবন নিয়ে ফিরে যেতে না পারে। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে আগে থেকে জানলেও তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো স্থানীয় পুলিশের পক্ষ থেকে এনসিপিকে ‘সব ঠিক আছে’ বলে জানানো হয়েছিল, এমন অভিযোগ করেছেন দলটির নেতারা। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় পুলিশের কেউ কেউ এই হামলার সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকতে পারে।

সারা দেশে জুলাই পদযাত্রার অংশ হিসেবে গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশের কর্মসূচি ছিল। গোপালগঞ্জের পৌরপার্ক এলাকায় এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কিন্তু নেতারা সমাবেশস্থলে আসার আগেই হঠাৎ বেলা দেড়টার দিকে সেখানে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয় প্রথম দফায়। পরে বেলা ২টার দিকে নেতারা সমাবেশস্থলে যান এবং সমাবেশ শেষ করে মাদারীপুর যাওয়ার পথে গোপালগঞ্জ সরকারি কলেজের সামনে এনসিপি নেতাদের গাড়িবহরে হামলা চালানো হয়। হামলাকারীরা এ সময় আগ্নেয়াস্ত্র, বোমা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে। কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সকাল ৯টার পর থেকে বিকেল পর্যন্ত মোট চার দফায় হামলার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সকালে দুই দফায় পুলিশ ও ইউএনওর গাড়িতে হামলা চালায় নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হামলাকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়। এছাড়া ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন।

এনসিপির গাড়িবহরে থাকা এক নেতা আরিফুর রহমান তুহিন তার ফেসবুক পোস্টে এ বিষয়ে বলেছেন, ‘টার্গেট ছিল নাহিদ, হাসনাত ও সার্জিসের গাড়ি। সন্ত্রাসীরা জানতো না যে, আমি ওদেরকে জোর করে এপিসিতে তুলে দিয়েছি। তাই ওরা এই তিনটা গাড়িকে লক্ষ্য করেই গুলি ও বোমা ছুড়ে। রাস্তায় রাস্তায় গান পাউডার ও পেট্রোল ছড়ানো ছিল। সর্বত্র গাছ ফেলে রাখা হয়। আমি নিজেই নাহিদ ইসলামের গাড়িতে ছিলাম এবং বিকট শব্দে একেকটা বোমা পড়তেছিল।’

অপর এক স্টাটাসে তুহিন বলেন, ‘প্রত্যেকটি জীবনের মূল্য অসীম। এনসিপির পুরো নেতৃত্বকে শেষ করতে এসে ঝরে গেল তাজা চারটি প্রাণ। ওরা কি আর ফিরবে? যাদের কথায় আপনাদের জীবন গেল তারাতো পাশের দেশে আরামে জীবন পার করছে। তারা কেউ হয়তো এদেশে আর আসবেও না। তাহলে কেন এই ধ্বংসলীলায় মাতলেন আপনারা? আমাদের মেরে ফেলে কি লাভ আপনাদের? নিজেদের জীবনকে বাজি ধরছেন একটা ডাইনির জন্য?

আমাদের জ্বালিয়ে দিতে প্রায় ২০০ ফিটের মধ্যে চলে এসেছিল তারা। ধরেই নিয়েছিলাম এটাই শেষ দিন। পুরো এনসিপিসহ হয়তো পুড়ে ছারখার হয়ে যেতাম। আল্লাহর রহমতে জীবনটা ফিরে পেলাম সবাই। কিন্তু ঝরে গেল চারটি তাজা জীবন।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কিলিং অ্যাকশন বাস্তবায়ন করার প্রস্তুতি নেয়া হয় আগে থেকেই। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের জড়ো করা হয় গোপালগঞ্জে। ঢাকার অস্ত্রধারীকেও গোপালগঞ্জে দেখা গেছে ওইদিন। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকেও সন্ত্রাসীদের জড়ো করা হয়। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া গতকাল বলেছেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি সারা দেশ থেকে সন্ত্রাসীরা গোপালগঞ্জ গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তারাই হামলা করেছে।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপে খুদে বার্তা দেয়া হয় এনসিপি নেতারা গোপালগঞ্জে ঢুকলে প্রতিহত করার। এমনও বার্তা দেয়া হয়, যাতে এনসিপি নেতারা জীবন নিয়ে গোপালগঞ্জ থেকে বের হতে না পারে। এনসিপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলাকারীদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র এবং দেশীয় অস্ত্র দেখা যায়। তারা প্রকাশ্যেই গুলি চালায়। এনসিপি নেতাদের গাড়ি যাতে গোপালগঞ্জ থেকে বের হয়ে যেতে না পারে সে জন্য প্রধান প্রধান সড়কে গাছ ফেলে রাখা যায়। রাস্তার পাশের বড় বড় গাছগুলো কেটে তাৎক্ষণিক রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, যেভাবে সবকিছু করা হয়েছে, তাতে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় এই হামলা ছিলো নিখুঁত পরিকল্পিত। হামলাকারীরা রাস্তার আশপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে ছিল। এনসিপির গাড়িগুলো বের হওয়ার পথেই তারা গুলি চালায় ও বোমা নিক্ষেপ করে। এনসিপির অপর এক নেতা বলেছেন, বোমাগুলো নিখুঁতভাবে গাড়িবহরকে টার্গেট করে মারা হয়।

ঘটনার পর এনসিপির একাধিক নেতা বলেছেন, এই হামলার ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে। তারা হয়তো আগে থেকেই বিষয়টি জানত। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের সাথে যখনই যোগাযোগ করা হয়েছে তখনই বলা হয়েছে, ‘সব ঠিকঠাক আছে।’ কিন্তু এনসিপি নেতারা সভাস্থলে যাওয়ার পরই তারা বুঝতে পারেন আসলে কিছুই ঠিক নেই। তারা সমাবেশস্থলে যাওয়ার আগেও একবার হামলা হয়। সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করে গাড়িতে ওঠার পরই তাদের কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হামলার পর যখন তারা পাশের স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেন তখন শুনতে পারেন মাইকে ঘোষণা আসছে তাদেরকে হত্যার জন্য।

এ দিকে গোপালগঞ্জে এনসিপি নেতাদের ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের গাফলতি নিয়ে এরইমধ্যে তদন্ত শুরু হয়েছে। দলটির নেতারা বলেছেন, হামলার সময় পুলিশ তাদেরকে ফেলে রেখে নিজেরা নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের আচরণ মোটেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। সভা শুরু হওয়ার আগে কিছু সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে সভাস্থলে দেখা যায় চেয়ারে বসে থাকতে। তারা এনসিপির কোনো সদস্য নয়। স্থানীয় এনসিপির সদস্যরা বলেছেন, ওই লোকগুলো গোপালগঞ্জের হলে তারা তাদেরকে চিনতেন। তাদের চেহারাও ছিল একটু অন্য রকম। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে আনা হয়েছিলো। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ দিকে গোপালগঞ্জের ঘটনায় হামলাকারী কাউকে ছেড়ে দেয়া হবে না বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব:) জাহাঙ্গীর আলম।