Image description
পুলিশের নতুন তালিকায় কিশোর গ্যাংয়ের কয়েক হাজার সদস্য কিশোর গ্যাং মোহাম্মদপুর আদাবরে এক ঘণ্টায় দুই খুনে জড়িত

রাজধানীতে কিশোর গ্যাং সদস্যরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ গত বুধবার এক ঘণ্টার ব্যবধানে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকায় দুজনকে হত্যার ঘটনায় এই গ্রুপের সদস্যদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

পুলিশের ভাষ্য, রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের পৃথক গ্রুপ রয়েছে। এগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বেরিয়ে নতুন রূপে অপরাধে জড়াচ্ছে।

গত বুধবার সংঘটিত দুই খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান কালের কণ্ঠকে বলেন, দুটি হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের এর মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বেশির ভাগ কিশোর গ্যাং সদস্য। তাদের গ্রেপ্তার ও নিয়ন্ত্রণে অভিযান চলছে। এর মধ্যে অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তেজগাঁও এলাকায় নতুন করে গ্যাংয়ের উৎপাত ও অপরাধ বাড়ছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, একাধিক নতুন কিশোর গ্যাং সদস্যের নাম পেয়েছেন তাঁরা। তবে প্রতিনিয়ত নানাভাবে কিশোর গ্যাং গ্রুপ পাড়া ও মহল্লায় গজিয়ে উঠছে। তাদের নিয়ন্ত্রণে তাঁরা কাজ করছেন। এরই মধ্যে অনেক গ্রুপের সদস্যদের নাম-পরিচয় পেয়েছেন তাঁরা।

আদাবরে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসি এস এম জাকারিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আদাবর এলাকায় নবোদয় হাউজিংয়ে ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত চলছে।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলছে, এ ঘটনায় রুবেল ও সজিব নামের দুজনকে ধরে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয় স্থানীয়রা। এ সময় তাদের কাছ থেকে পিস্তল ও গুলি উদ্ধার হয়।

মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ জানায়, পূর্বশত্রুতার জেরে বুধবার রাতে চাঁদ উদ্যানের ৬ নম্বর রোডে আল আমিন নামের একজনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় কিশোর অপরাধীসহ আরো যারা জড়িত, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

নিহত আল আমিনের বাবা মো. রিপন বলেন, ‘বুধবার মাগরিবের পর একজনের ফোন পেয়ে ছেলে আল আমিন বাসা থেকে বের হয়। পরে খবর পাই, মোশারফরা আমার ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আমি ছেলে হত্যার বিচার চাই।’ তিনি বলেন, ‘পরিবার নিয়ে বর্তমানে মোহাম্মদপুর চাঁদ উদ্যানের ৫ নম্বর রোডে থাকি। আমাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর জেলার হাঁটুলিয়া বাগানবাড়ি এলাকায়। আল আমিন পাঁচ বছরের একটি ছেলেসন্তানের জনক। এখন তার সন্তান এতিম হইয়া গেল।’

বিগত সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সদস্যসংখ্যা দুই হাজারের বেশি। প্রতিটি থানায় তাদের তালিকা ছিল।

তবে গোয়েন্দা পুলিশ বলছে, তারা নতুন করে কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের তালিকা করছে। নতুন তালিকা অনুযায়ী, রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলা ও থানা এলাকা, এমনকি গ্রামেও এখন কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা রয়েছে। বর্তমানে সামাজিক অপরাধের মূলেও তারা। দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন বড় চ্যালেঞ্জ কিশোর গ্যাং।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজে অপরাধ বাড়ছে। এর মূলে কিশোর-তরুণ গ্যাং সদস্যদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমাজে খুনাখুনি আরো বাড়বে।

ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র বলছে, রাজধানীর প্রতিটি এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের ৪০ শতাংশ করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। বর্তমানে প্রতিটি এলাকায় পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। সব মিলে অন্তত ২০ হাজার কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে চাপাতি, বেকি, বার্মিজ চাকু ও কিরিচ রয়েছে।

পুলিশ বলছে, রাজধানীর আটটি ক্রাইম জোনের মধ্যে মোহাম্মদপুর, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, মগবাজার, মিরপুর ও উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের প্রকাশ্য দৌরাত্ম্য রয়েছে। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা মো. মুক্তার হোসেন বলেন, এই এলাকায় এখনো প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে কিশোর গ্যাং সদস্যরা মহড়া দেয়।

পুলিশের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর ও আদাবরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এই এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের এক হাজারের বেশি সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকায় আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা জড়িত রয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর ৫০ থানা এলাকায় কিশোর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেড়েছে।

ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কিশোর গ্যাংসহ সব ধরনের অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। নিয়মিত টহল জোরদার, অপরাধপ্রবণ এলাকায় নজরদারি বাড়ানো, চেকপোস্ট পরিচালনা, মামলা তদন্তে অগ্রগতির পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে।

সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা : কয়েক মাস আগে বিকেলে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধসংলগ্ন টিনশেড বাড়ির ওপর এক কিশোরকে অন্তত সাতজনের কিশোর গ্যাং গ্রুপ চাপাতি দিয়ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করে। সে সময় মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউয়ে ফুটপাতে গভীর রাতে পথচারীদের কাছ থেকে ছিনতাইয়ের সময় চাপাতির ভয় দেখায় কিশোর গ্যাং সদস্যরা।

যাত্রাবাড়ীতে রিকশায় এক দম্পতির কাছ থেকে কিশোর গ্যাং সদস্যরা চাপাতির ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নেয়। এ ছাড়া চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টার মধ্যে আদাবর মেহেদীবাগ ও আদাবর বাজার এলাকায় দেশি অস্ত্রশস্ত্রে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এ ঘটনায় এলাকার অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হয়। এরপর গত ৫ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে হামলার শিকার হয় পুলিশ। কিশোর গ্যাং সদস্যরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চার পুলিশ সদস্যকে জখম করে। পুলিশ বলছে, হামলার ঘটনায় রায়েরবাজার বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত ছিল। এই গ্রুপে অন্তত ৪০ জন সদস্য রয়েছে।

সূত্র মতে, কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শুরু হওয়ার প্রথম দিকে ২০১৫ সালের ২৭ মে উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জেরে অনিক নামের এক কিশোরকে কিশোর গ্যাং সদস্যরা নির্মমভাবে হত্যা করে। এরপর ২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি সেই উত্তরা এলাকায়ই ডিসকো বয়েজ ও নাইন স্টার গ্রুপের দ্বন্দ্বে খুন হয় নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান কবির।