
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল শিল্পকারখানায় নতুন সংযোগ ও লোড বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়। শিল্প মালিক-ব্যবসায়ীদের আপত্তি সত্ত্বেও দাম বাড়ানোর পর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো হবে; কিন্তু তিন মাসের বেশি পেরিয়ে গেলেও তিতাসসহ ছয়টি বিতরণ কোম্পানি শিল্পকারখানায় একটিও নতুন সংযোগ দেয়নি। বরং দাম বাড়ানোর আগের আবেদনের বিপরীতে প্রতিশ্রুত গ্যাস সংযোগই দিতে পারেনি। বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। ফলে আগের প্রতিশ্রুত শিল্প সংযোগই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর নতুন সংযোগ দেওয়া তো পরের বিষয়।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাদের পাওয়া যায়নি। পরে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি মিটিংয়ে আছেন জানিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান কালবেলাকে বলেন, ‘সরকার যখনই গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, আমরা দাম দিয়েছি। সর্বশেষ যখন বাড়ানো হলো, আমাদের বলা হলো কোয়ালিটি গ্যাস দেওয়া হবে; কিন্তু কোয়ালিটি দূরে থাক, গ্যাসের সরবরাহই নেই। এই অবস্থায় গ্যাসের অভাবে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আর নতুন শিল্পের জন্য নতুন সংযোগ প্রয়োজন। এখনো নতুন কোনো বিনিয়োগ নেই। আমরাও এই সংকটের কারণে এখন কোনো বিনিয়োগ করব না।
ঢাকা ও আশপাশে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে আছে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিসন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন পিএলসি। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি দাম বাড়ানোর আগে প্রতিশ্রুত গ্যাস সংযোগগুলোই দিতে পারিনি। নতুন সংযোগ পরের কথা। আজ পর্যন্ত একটিও নতুন সংযোগ দিইনি। আমার চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের সরবরাহ কম। এখন আগের প্রতিশ্রুত গ্যাস সংযোগগুলো ধাপে ধাপে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
চট্টগ্রামের গ্যাস বিতরণের দায়িত্বে থাকা কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. সালাহউদ্দিন কালবেলাকে বলেন, চট্টগ্রামে নতুন শিল্প তেমন একটা হচ্ছে না। ফলে নতুন শিল্পে সংযোগ নেই বললেই চলে। এ সময় তিনি কোম্পানির বিপণন বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে কোম্পানিটির বিপণন বিভাগে যোগাযোগ করলেও কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। তবে কোম্পানিটির মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী মো. আমিনুর রহমান বলেন, ‘এখন আমাদের চাহিদা ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা পুরোটাই এখন পাওয়া যাচ্ছে। তবে নতুন কোনো লোড বাড়ানো হচ্ছে না।’
কুমিল্লা ও এর আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. ফজলে আলম জানালেন তার বিতরণ এলাকার মধ্যে শিল্প কারখানা তেমন একটা নেই। এই এলাকায় কোনো ইপিজেড নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে ২৬টি আবেদন আছে। এই সংযোগগুলো দিতে পারছি না, কারণ সরবরাহ বাড়ানো হচ্ছে না। তবে এখন গ্যাসের কোনো সংকট নেই। আমার এখনকার চাহিদা অনুযায়ী বর্তমানে ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার পুরোটা সরবরাহ পাচ্ছি। এর মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রে, বাকিটা শিল্প কারখানা ও বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে।’
পেট্রোবাংলা ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তিতাসসহ ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির কাছে শিল্প সংযোগের হাজারের বেশি আবেদন জমা আছে। এর মধ্যে ৪ শতাধিক গ্রাহক সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংযোগের (প্রতিশ্রুত সংযোগ) অপেক্ষায় আছেন। অর্থাৎ তারা গ্যাস সংযোগের জন্য টাকাও জমা দিয়েছে। বাকি ৬০০ কারখানা আবেদন করেছে, তবে প্রতিশ্রুতি পায়নি। যে ৪ শতাধিক গ্রাহক সব প্রক্রিয়া শেষ করে সংযোগের (প্রতিশ্রুত সংযোগ) অপেক্ষায় আছে, তাদের কেউ নতুন কারখানা, কেউ সম্প্রসারিত কারখানা, কেউ লোড বৃদ্ধির (সরবরাহের পরিমাণ) আবেদনকারী। তিতাস সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে তিতাসের নতুন-পুরোনো মিলে গ্যাস সংযোগ এবং লোডবৃদ্ধির আবেদন রয়েছে প্রায় ১১০০। এর মধ্যে নতুন আবেদন ৪০০, লোডবৃদ্ধি ৩০০ এবং প্রতিশ্রুত ৪০০। দেশের বিতরণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক তিতাসেরই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে গ্যাস সংকটের পেছনে রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গড়ে ওঠা আমদানি নির্ভরতা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে নজর না দিয়ে আমদানির পথে হেঁটেছে। ২০২২ সালের দিকে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমতে থাকায় গ্যাস আমদানি কঠিন হয়ে পড়ে। বিশ্ববাজারে দামও ব্যাপক বেড়ে যায়। ফলে জ্বালানি খাতে আওয়ামী লীগ সরকার বিপুল দেনা তৈরি করে, যা পরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শোধ করছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে জোর দিলেও ফল পেতে আরও কয়েক বছর সময় প্রয়োজন হবে।
এদিকে, গত ১৬ এপ্রিল জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ নির্দেশনা দেয়, গ্যাস সংযোগের আবেদনগুলো তিন ভাগে ভাগ করতে—নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি ও প্রতিশ্রুত সংযোগ। ১৮ জুন পাঁচ সদস্যের একটি যাচাই কমিটি গঠিত হয় অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে। কমিটির কাজ আবেদন যাচাই করে অগ্রাধিকার তালিকা তৈরি করা; শিল্প স্থাপনের প্রস্তুতি পর্যালোচনা এবং মাঠপর্যায়ে পরিদর্শন।
পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী, গতকাল দেশে ২ হাজার ৮৪৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসের পরিমাণ ১ হাজার ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট। আর আমদানি করা গ্যাসের পরিমাণ ১ হাজার ২০ মিলিয়ন ঘনফুট।