Image description

খুলনায় যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহবুবুর রহমান হত্যায় জড়িতদের শনাক্তের দাবি করেছে পুলিশ। ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরা ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের দুদিনের মাথায় হত্যাকারীদের শনাক্তের তথ্য জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তারা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সজল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের আগে বাড়ির সামনের দোকানি সজল মোবাইল ফোনে দফায় দফায় মাহবুবের অবস্থান জানিয়েছেন খুনিদের। নতুন করে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টায় থাকা চরমপন্থি গ্রুপের হাতেই খুন হয়েছেন মাহবুব—এমন তথ্যই সামনে আসছে স্পষ্টভাবে। ঘটনার মূল কারণ ও হত্যাকারীরা অচিরেই গ্রেপ্তার হবে আশা পুলিশের।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার আবু রায়হান মুহাম্মদ সালেহ বলেন, ‘কিছু তথ্যপ্রমাণ আমরা প্রাথমিকভাবে পেয়েছি, তদন্তের স্বার্থে সবকিছু বলা যাচ্ছে না। তবে এ হত্যাকাণ্ডে একাধিক অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। তিনজন খুনি একটি মোটরসাইকেলে আসে। তাদের একজনের মাথায় হেলমেট ছিল। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে তেলিগাতি এলাকা হয়ে বেরিয়ে গেছে তারা। আশপাশের কয়েকটি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে।’

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক সূত্র জানায়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মাহবুব। খুলনা বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতা গ্রেপ্তার এড়াতে ৫ আগস্টের আগে মাহবুবের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এমন তথ্য পাওয়া যায় মাহবুবের বাড়িতে গিয়ে তার আত্মীয়দের কাছে। প্রভাবশালী ওই নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ায় স্থানীয় বিএনপি নেতাদের মানতেন না মাহবুব। এ ছাড়া জমি বিক্রির সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি উঠতি চরমপন্থি দলের নেতা আরমান খালাতো ভাই হওয়ায় আধিপত্য নিয়ে অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ চলছিল মাহবুবের। মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ও চাঁদাবাজির কারণেও একাধিক গ্রুপের টার্গেটে পরিণত হন তিনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারেন—এ আশঙ্কায় পুলিশের নজরদারির তালিকায়ও ছিলেন। মাহবুব সম্প্রতি যে গাড়ি ব্যবহার করছিলেন, সেটি কিছুদিন আগে স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাহিদের কাছ থেকে দখল করা বলে জনশ্রুতি রয়েছে। যদিও মাহবুবের চাচাতো ভাই যুবদল নেতা আশরাফুলের দাবি, যুবলীগ করলেও একই এলাকায় থাকার কারণে মাহবুবের কাছে গাড়িটি বন্ধক রেখেছিলেন জাহিদ।

নিহত মাহবুবুর রহমানের বাড়ি খুলনার দৌলতপুরের পশ্চিম মহেশ্বরপাশা এলাকায়। গত শুক্রবার দুপুরে বাসার সামনে নিজের ব্যবহৃত প্রাইভেট কার পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় একটি মোটরসাইকেলে তিন দুর্বৃত্ত এসে মাহবুবুরকে গুলি করে এবং দুই পায়ের রগ কেটে হত্যা করে। স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে নানা সন্দেহ, পুরোনো-নতুন দ্বন্দ্ব ও আধিপত্যের সংঘাতের বিষয়গুলো আলোচনায় আসছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের সময় রামদা হাতে মহড়ার বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত চলছে।

মাহবুবের স্ত্রী এরিন সুলতানা বলেন, ‘কুয়েটের ঘটনায় সে (মাহবুব) দলের নির্দেশে গিয়েছিল, নিজের স্বার্থে নয়। মানিকতলায় যুবদলের সুধী সমাবেশের ঘটনায় ওর বন্ধু জাকির মামলা করার পর মাহবুবুরের কাছে নিয়মিত হুমকি আসত; কিন্তু কারা দিচ্ছে, তা বলত না। এখন আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

মহানগর শ্রমিক দলের সাবেক প্রচার সম্পাদক ও মাহবুবের শ্বশুর আজাদ বেগ বাবু বলেন, ‘কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘাতে যুবদলের নেতা হিসেবে মাহবুব পাশে দাঁড়িয়েছিল। এ ঘটনাও একটি কারণ হতে পারে। ৫ আগস্টের পর দলীয় অফিস ভাঙচুরের ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে মামলা করে মাহবুব। এ ছাড়া মানিকতলায় যুবদলের সুধী সমাবেশে মারামারির ঘটনায় তার বন্ধু জাকির মামলা করলে আসামিরা মাহবুবের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। নিয়মিত তাকে হুমকি দেওয়া হতো।’

আজাদ বেগ আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা আওয়ামী লীগের নেতাদের আত্মীয়স্বজন। তারা কুয়েট এলাকায় আরিফকে হত্যা করেছে, চাঁদাবাজিও করছে। কিছুদিন আগে দিলীপ মাস্টারকে গুলি করেছে। খানাবাড়ি এলাকায় হাউস বিল্ডিংয়ের একটি বাড়ির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা তৈরি হওয়ায় মাহবুবকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়েছিল।’

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পর দৌলতপুরের দেয়ানা, মহেশ্বরপাশা ও তেলিগাতি এলাকার আত্মগোপনে থাকা চরমপন্থি নেতারা এলাকায় ফিরতে শুরু করেন। ওই এলাকার কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু হত্যার পর গত ১৫ মার্চ আরেক চরমপন্থি নেতা শেখ শাহীনুল হককে (বড় শাহীন) গুলি করে হত্যা করা হয়। বড় শাহীনের অনুসারী উঠতি চরমপন্থি নেতারা দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যায় পারস্পরিক আস্থা আর বিশ্বাসের সংকটে। এর মধ্যে এক গ্রুপে মহেশ্বরপাশার হুমায়ুন কবির (হুমা), ক্রসরোডের কাজী রায়হান, ঘোষপাড়ার আসিফ মোল্লা ও বুচিতলার ইমন হাওলাদার এবং অন্য গ্রুপের নেতৃত্ব দেন হোসেন ঢালী ও মাহাবুবের খালাতো ভাই আরমান।

সম্প্রতি বাগেরহাটে একটি কিলিং মিশনে অংশ নিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় হুমায়ুন (হুমা), রায়হান, আসিফ ও ইমন। রায়হান ও ইমন জামিনে মুক্ত হলেও অন্য দুজন কারাগারে আছে। অন্য একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে হোসেন ঢালী ও আরমানও কারাগারে রয়েছে।

মাহবুবের স্ত্রী এরিনা সুলতানা, শ্বশুর আজাদ বেগ এবং চাচাতো ভাই ও মাহবুবের ঘনিষ্ঠ সহযোগী আশরাফুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হুমায়ুন কবীর (হুমা) গ্রুপকে বাগেরহাটে ‘গ্রেপ্তার করিয়ে দেওয়া’ এবং জেল থেকে অন্য গ্রুপ নেতা আরমানকে জামিনে বের হতে আইনি সহযোগিতার অভিযোগে হুমা গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ চলছিল মাহবুবের। তার স্ত্রী এরিনা সুলতানা বলেন, ‘ওরা আমার স্বামীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছে। ওরা বলেছে মাহবুব ওদের নামে মামলা দিয়েছে, ওদের গ্রেপ্তার করিয়েছে। কিন্তু মাহবুব এসবের কিছুই জানে না, মাহবুব আমাকে নিজের মুখে বলেছে ওদের গ্রেপ্তারের পেছনে ওর কোনো হাত নেই। তারপরও ওরা শুনল না।’

নিহত মাহবুবের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মী তাঁতী দলের থানা পর্যায়ের এক নেতা কালবেলাকে বলেন, ‘আমি মামলার বাদী হওয়ায় আমাকেই প্রথম টার্গেট করা হয়েছিল। আমাকেও বাড়িতে এসে অস্ত্র ঠেকিয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমি এখন এদের ভয়ে এলাকার বাইরে যাই না। হুমা গ্রুপ মনে করত, মাহবুব তাদের ধরিয়ে দিয়েছে। মাহবুব বারবার বুঝিয়েছিল, এটা ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু তারপরও কারাগার থেকেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, হত্যার নেপথ্যের কারণগুলো সামনে রেখে তদন্ত চলছে। আমরা সজল নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছি। মাহবুবের অবস্থানের বিষয়ে তিনি হত্যাকারীদের তথ্য দিয়েছিলেন। কোন গ্রুপ এটা করেছে, তা আমরা মোটামুটি শনাক্ত করতে পেরেছি। শিগগির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব বলে আশা করছি।