Image description

দখল , চাঁদাবাজি , সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডসহ সব ধরনের অপকর্মের বিরুদ্ধে ‘ জিরো টলারেন্স ' ঘোষণা , দ্রুত সাংগঠনিক ব্যবস্থা—কোনো কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না । বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি , সাংগঠনিক বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতা- কর্মীদের অপকর্ম অব্যাহত রয়েছে । এ নিয়ে দেশজুড়ে জনমনে ক্ষোভ ও হতাশার কারণে প্রচণ্ড চাপে পড়েছে বিএনপি । সর্বশেষ মিটফোর্ড এলাকায় বিএনপির সঙ্গে যুক্ত নেতা - কর্মীদের হাতে ভাঙারি ব্যবসায়ীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড সমালোচনার আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে । সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন পরিসরে এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে ।

অন্যদিকে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এসব ঘটনার মধ্যে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রেরও গন্ধ পাচ্ছেন । তাঁরা এসব ঘটনাকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার ‘ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ’ হিসেবে দেখছেন ।  সরকারের বিরুদ্ধে এসব অপরাধীকে দমনে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগও তুলেছেন কোনো কোনো নেতা । ব্যবসার ভাগ দিতে রাজি না হওয়ায় গত বুধবার রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনের সড়কে স্থানীয় ভাঙারি ব্যবসায়ী মো . সোহাগকে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । গত শুক্রবার এ ঘটনার ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ- মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে । নিহত সোহাগ যুবদলের কর্মী এবং হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরাও বিএনপির লোক বলে জানা গেছে । হত্যাকাণ্ডটির লোমহর্ষ ভিডিও ছড়ানোর পর থেকে নিন্দা - প্রতিবাদের ঝড়ে টালমাটাল বিএনপি । বিভিন্ন জায়গায় বিএনপি ও দলটির শীর্ষ নেতাদের নামেও বিষোদ্গার করে মিছিল হয়েছে ।  

বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হত্যার ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে । ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল শনিবার পর্যন্ত জাতীয়তাবাদী যুবদল , স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের পক্ষ থেকে পাঁচজনকে আজীবন বহিষ্কার করে বিএনপির ৩ সংগঠনের সংবাদ সম্মেলন বিশেষ গোষ্ঠী নির্বাচন বিলম্বে ষড়যন্ত্র করছে নিজস্ব প্রতিবেদক , ঢাকা 'বিশেষ গোষ্ঠী' নির্বাচন বিলম্বে ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছেন যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না ।  

তিনি বলেছেন , ‘প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিপর্যস্ত । কিন্তু একটি সুযোগসন্ধানী বিশেষ গোষ্ঠী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিলেক্টিভ প্রতিবাদ করে বিএনপি এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং তীব্র কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য - বিবৃতি দেওয়া শুরু করেছে । তাঁদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়েছে ।  সাড়ে ৪ হাজারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র - জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই দেশজুড়ে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতা - কর্মীদের বিরুদ্ধে দখল , চাঁদাবাজি , সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠতে থাকে । দলীয় সূত্র বলছে , শুরু থেকেই এসবের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে বিএনপি । সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপের জেরে কড়া সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয় , যা অব্যাহত রয়েছে ।  ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে সারা দেশে দল এবং এর অঙ্গসংগঠনের সাড়ে ৪ হাজারের মতো নেতা - কর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে । বিভিন্ন ঘটনায় ছাত্রদল এখন পর্যন্ত সারা দেশে ৩২৯ জনকে বহিষ্কার ও ৫৪১ নেতা - কর্মীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ।

স্বেচ্ছাসেবক দলের কমপক্ষে ১০০ জনকে বহিষ্কার , ১০০ জনের পদ স্থগিত এবং প্রায় ২০০ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে । এ ছাড়া যুবদলের ১৫০ নেতা- কর্মীকে বহিষ্কার , ৫৬ জনকে শোকজ এবং ৫ জনের পদ স্থগিত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে । তৃণমূল থেকে কেন্দ্রের নেতারাও এই শাস্তির আওতা থেকে রেহাই পাচ্ছেন না । কিন্তু এরপরও দলের নেতা - কর্মীদের অপকর্মের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না ।  

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতার সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা বলেন , দখল , টেন্ডার , চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মূলত নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন নেতা - কর্মীরা । এসব দ্বন্দ্ব রূপ নিচ্ছে সশস্ত্র সংঘাতে , ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা । স্থানীয় পর্যায়ে আধিপত্য , কমিটিতে পদ - পদবি পাওয়াকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হচ্ছে । বিএনপিতে অন্য দলের নেতা - কর্মীর অনুপ্রবেশ এবং দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় অনেক নেতা - কর্মী আবার সক্রিয় হওয়াও এসব দ্বন্দ্ব - সংঘাতের কারণ বলে মনে করছেন দলের অনেকে । মিটফোর্ডের ঘটনার রেশ না কাটতেই শুক্রবার রাতে দিনাজপুরের খানসামায় বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে । এতে আহত হয়েছেন ২৫ জন । এ সময় ৫০ টির বেশি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে ।  

সরকারের ভূমিকায় প্রশ্ন বিএনপির মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারসহ দায়িত্বশীলদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি । দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গতকাল রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন , ' আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি , যাকে আমরা স্ক্রিনে দেখেছি , যে হত্যা করছে , তাকে কেন সরকার এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেনি ? আমরা কি তবে ধরে নেব , যারা বিভিন্নভাবে মব সৃষ্টি করে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে , সেখানে সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে ? প্রশাসনের কোনো প্রশ্রয় আছে ? ' তারেক রহমান আরও বলেন , ‘ ষড়যন্ত্র কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি । আমি ৮-৯ মাস আগেই বলেছি , অদৃশ্য শত্রু আছে । ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে সেই অদৃশ্য শত্রু । ষড়যন্ত্র আরও জোরেশোরে শুরু হচ্ছে । '  সোহাগ হত্যাসহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন , “ একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই , যে ঘটনাগুলো ঘটছে , সরকারকে আহ্বান জানাব , দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত যারা অপরাধী তাদেরকে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করুন । অন্যথায় জাতি আপনাদের ক্ষমা করবে না , জাতি আপনাদের দায়ী করবে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় এসব সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য ।  সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে গতকাল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে যুবদল , স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদল । সোহাগ হত্যা মামলার মূল আসামিদের গ্রেপ্তার না করা ও মামলার এজাহার থেকে মূল তিন আসামিকে বাদ দেওয়ার ঘটনাকে ‘ রহস্যজনক ' বলে আখ্যা দেন সংগঠন তিনটির নেতারা ।

সংবাদ সম্মেলনে ‘ বিশেষ গোষ্ঠী নির্বাচন বিলম্বে যড়যন্ত্র করছে ' এমন অভিযোগ করে যুবদলের সভাপতি মোনায়েম মুন্না বলেন , ‘ বিএনপি ইতিমধ্যে দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে সরকার ও প্ৰশাসনকে অসংখ্যবার অনুরোধ করেছে । কিন্তু সরকার ও প্রশাসন এ ক্ষেত্রে মারাত্মকভাবে ব্যর্থ হচ্ছে । আমরা মনে করি , সরকার পরিকল্পনামাফিক প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে , যাতে দেশে অরাজক পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে এবং এই অজুহাতে জাতির দীর্ঘ প্রত্যাশিত  জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করা যায় । ' বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন , বিএনপি একটি বৃহৎ পরিবার । কোন ছিদ্রপথ দিয়ে দু - একজন দুষ্কৃতকারী ঢুকে পড়ে , সব সময় সে খোঁজ রাখা যায় না । কিন্তু দুষ্কৃতকারীদের কোনোভাবে যদি চিহ্নিত করা যায় , তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কার্পণ্য করেন না দল বা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ।  

বিশ্লেষকেরা যা বলছেন বিরাজমান পরিস্থিতিতে বিএনপির কাছে আরও ‘ দায়িত্বশীল ভূমিকা ’ প্রত্যাশা করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা । বিএনপির নেতা - কর্মীদের নানা অপকর্ম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দলটির নেতৃত্বের দুর্বলতার কথাও তুলেছেন তাঁদের কেউ কেউ । একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন , ‘ বিএনপিকে আরও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে । আমার মনে হয় , অনেক সময় গেছে , বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের এখন দেশে আসা উচিত । দেশে এসে তাঁর শক্তভাবে দলের হাল ধরা উচিত । '

একই সঙ্গে সরকারের সমালোচনা করে অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান আরও বলেন, “ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা , অপরাধীর বিচার ও শাস্তির দায়িত্ব সরকারের , কোনো দলের নয় । বিএনপি দল হিসেবে নেতা - কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে , বহিষ্কার করছে এবং তাঁদের বিচারের জন্য সরকারকে বলছে । তারা যদি ব্যবস্থা না নিত , তাহলে বলা যেত , বিএনপি ব্যবস্থা নিচ্ছে না । কিন্তু সরকার নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারছে না । এ বিষয়ে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ । তাদের যোগ্যতা , দক্ষতা ও দায়বদ্ধতা নেই । ’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী এ বিষয়ে বলেন , ‘ বিএনপির লোকজন অপকর্ম করছে না , তা নয় । তবে সে জন্য দল থেকে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে । কিন্তু সরকারের তো দায়িত্ব আছে । তাদের তো নড়াচড়া দেখি না । সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার আছে ; তাদেরও কোনো ভূমিকা নেই । এ থেকে মনে হচ্ছে , কোথাও কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে । '