Image description

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বেশির ভাগ সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ছেই। গত বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সব প্রস্তুতি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন তিনি। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

 

 

জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের পর তৃণমূলে সম্ভাব্য প্রার্থীদের উৎসাহ আরো বেড়েছে। কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সম্ভাব্য প্রার্থীরা গণসংযোগের সময় বাড়িয়েছেন, প্রচারে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। অন্যান্য দলে প্রার্থী ঘোষণা না হলেও মনোনয়ন পেতে হাইকমান্ডের দৃষ্টি কাড়তে তৎপর রয়েছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

 

 

চট্টগ্রামের ১৬ আসনে সরব মনোনয়নপ্রত্যাশীরা

চট্টগ্রাম থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নূপুর দেব জানান, জেলার ১৬ আসনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তৎপরতা বাড়িয়েছেন। ডিজিটাল ব্যানারসহ বিভিন্ন প্রচারপত্র সাঁটিয়েছেন তাঁরা, ভোটারদের কাছেও যাচ্ছেন। চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া (আংশিক) আসনে মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্যসচিব আবুল হাশেম বক্করকে প্রার্থী দেখতে চেয়ে নগরের আলমাস এলাকায় ব্যানার টানিয়েছেন কর্মী-সমর্থকরা। এ আসনে আবুল হাশেম বক্করের পাশাপাশি প্রার্থী হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য শামসুল আলম, মহানগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিমসহ আরো কয়েকজনের।

 
তাঁরা নগরে গণসংযোগের পাশাপাশি সামাজিকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। একই আসনে নগর জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. এ কে এম ফজলুল হককে তাঁর দল থেকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। গত ১৪ জুন ওই আসনে ডা. এ কে এম ফজলুল হকের সমর্থনে মতবিনিময়সভা হয়েছে। কয়েক দিন ধরে ব্যাপক গণসংযোগ ও কর্মী সমর্থকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন এই প্রার্থী। মহানগর বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক ইদ্রিস আলী বলেন, দল থেকে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি।
 
তবে নির্বাচনে প্রার্থী হতে প্রায় প্রতিটি আসনে গড়ে দু-তিনজন মনোনয়ন চাইতে পারেন।

 

রাজশাহীতে ছয় আসনেই অর্ধশতাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী : রাজশাহী থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম জানান, রাজশাহী বিভাগে ৩৯টি আসনেই প্রার্থী হতে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা অবিরাম তৎপরতা চালাচ্ছেন। এর মধ্যে রাজশাহী জেলার ছয়টি আসনেই তোড়জোড় বেড়েছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের। বিশেষ করে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীরা প্রকাশ্যেই মাঠে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বহু প্রার্থীর পক্ষে ব্যানার ও ফেস্টুনও টানানো হয়েছে। রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী সাবেক এমপি ও দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। একই আসনে মহানগর জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডাক্তার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম দলের প্রার্থী। গত বুধবার জামায়াতের পার্লামেন্টরি বোর্ড রাজশাহী সদর আসনে জাহাঙ্গীর আলমকে এখানে প্রার্থী হিসেবে নাম ঘোষণা করে। এর পর থেকে তিনিও প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন।

সম্ভাব্য প্রার্থী বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘আমি তো সেই ১৯৯১ সাল থেকেই রাজশাহীর মানুষের মাঝে মিশে আছি। এখনো সেটাই করছি। তবে নির্বাচন উপলক্ষে রাজশাহীতে আমাদের দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠে রয়েছেন। আমিও রয়েছি। জামায়াতের মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত আমরা দুই দিন আগে পেয়েছি। আগামী ১৯ জুলাইয়ের আগে রাজশাহীতে নির্বাচনী শোডাউন করব।’

রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে বিএনপি-জামায়াতের সম্ভাব্য প্রার্থী সাত জন, রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী  পাঁচজন, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে বিএনপি-জামায়াত ও জাতীয় পার্টির সম্ভাব্য প্রার্থী ১০ জন, রাজশাহী-৪ (বগামারা) আসনে বিএনপি-জামায়াতের ১৩ জন, রাজশাহীর-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে বিএনপি-জামায়াতের ১০ জন এবং রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে বিএনপি-জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের ৯ জন সম্ভাব্য প্রার্থী তৎপর।

খুলনা বিভাগে বহুমুখী তৎপরতা : খুলনা থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক কৌশিক দে জানান, খুলনা বিভাগের ১০ জেলার ৩৬টি সংসদীয় আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী বাড়ছে। তাঁরা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছেন, সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায় প্রতিযোগিতা করেই অংশ নিচ্ছেন। এসব কর্মসূচিতে এগিয়ে আছে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামী। পাশাপাশি তৎপর রয়েছে ইসলামী আন্দোলন, নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপি, জাতীয় পার্টি ও কয়েকটি বাম দল থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও তৎপর রয়েছে।

যশোর জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত না হওয়ায় দেখা দিয়েছে প্রার্থীজট। তবে এরই মধ্যে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু। এ ছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শরীফুজ্জামানের অনুসারীরাও প্রস্তুতি সেরেছেন। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ রাসেলকে। তিনি বেশ আগে থেকেই প্রতিটি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডভিত্তিক নির্বাচনী কার্যক্রম চালাচ্ছেন। ঝিনাইদহ জেলার চারটি আসনে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

বরিশালের ২১ আসনে পাল্টাতে পারে হিসাব : বরিশাল থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক রফিকুল ইসলাম জানান, বিভাগের ছয় জেলার ২১ আসনে সরব হয়ে উঠেছেন বিএনপি, ইসলামী আন্দোলনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা। জামায়াতে ইসলামী এখানে প্রার্থী ঠিক করে ফেলেছে। এনসিপি প্রার্থীরা মাঠে তৎপর থাকার চেষ্টা করছেন। সামাজিক, ধর্মীয় ও ক্রীড়ানুষ্ঠান, শুভেচ্ছাবিনিময় ছাড়াও গরিবদের সহায়তায় ভোটারদের মন জয় করতে সক্রিয় রয়েছেন মনোনয়ন পেতে ইচ্ছুকরা। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা হলে পাল্টে যেতে পারে নির্বাচনের মাঠের পরিস্থিতি। জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন সব প্রস্তুতি শেষ করছে। বিভাগের ২১টি আসনেই জামায়াতে ইসলামী তাদের একক প্রার্থী ঘোষণা করেছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও একাধিক প্রার্থী নিয়ে সমস্যায় নেই।

বিএনপির সম্ভাব্য অর্ধশতাধিক প্রার্থী নিজেদের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরে কয়েক মাস ধরে প্রচার চালাচ্ছেন। বরিশালের দু-একটি আসনে এবি পার্টির তৎপরতা দেখা গেছে। এখনো সব এলাকায় কমিটি দিতে পারেনি এনসিপি। বরিশাল-৫ (সদর-সিটি করপোরেশন) আসনে বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, দল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতাকে মনোনয়ন দেবে বলে আমি আশাবাদী। সব সময় জনসম্পৃক্ত থাকার চেষ্টা করি।

ময়মনসিংহের ১১ আসন সরব : ময়মনসিংহ থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়ামুল কবীর সজল জানান, ময়মনসিংহ বিভাগের ১১টি আসনেই সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের তৎপরতা বেড়েছে। তাঁরা মাঠে থাকছেন নানা কর্মসূচি নিয়ে। কেউ কেউ আছেন নিয়মিত জনসংযোগে। ময়মনসিংহ ১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনে কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা এমরান সালেহ প্রিন্সসহ বিএনপির একাধিক প্রার্থীর নাম আলোচনায় আছে। ময়মনসিংহ (দক্ষিণ) জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর মাহমুদ আলম বলেন, দলের অনেক নেতা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। জেলা জামায়াতের আমির আব্দুল করিম বলেন, দলীয় প্রার্থীরা মাঠে উৎসাহের সঙ্গে তৎপর আছেন।

সিলেটে প্রবাসীরাও তৎপর : সিলেট থেকে নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াহইয়া ফজল জানান, গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর থেকেই সিলেটের রাজনীতির মাঠে সম্ভাব্য প্রার্থীদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। সময় যত যাচ্ছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তৎপরতা ততই বাড়ছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী প্রার্থী সিলেট বিভাগের ১৯ আসনে বিভিন্ন দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। এ পর্যন্ত দেড় শতাধিক প্রার্থীকে তৎপরতা চালাতে দেখা গেছে।

বিভাগের চার জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫১ জন তৎপর সিলেট জেলার ছয় আসনে। এরপর প্রার্থী দৌড়ে এগিয়ে হবিগঞ্জ জেলা। জেলার চার আসনে তৎপরতা চালাচ্ছেন ২৮ জন। মৌলভীবাজারে ১৬ জনকে মাঠে দেখা গেছে। সুনামগঞ্জে এখানো সেভাবে প্রচারে না থাকলেও অন্তত ১২ জন মাঠে আছেন।

সিলেট জেলার ছয় আসনে শুধু বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ৩৪ জন। এ তালিকায় আছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের পাঁচ উপদেষ্টা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দুই উপদেষ্টা। আছেন বিপুলসংখ্যক প্রবাসী। সব মিলিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেতে প্রতিটি আসনে দলের মধ্যেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হবে প্রার্থীদের। নারী প্রার্থী আছেন ৯ জন।

সিলেট-৪ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ও মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবুল হক চৌধুরী (ভিপি মাহবুব) কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় ১৭ বছর পর একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা করছে দেশের জনগণ। আমরাও একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। দল মনোনয়ন দিলে জনগণের সেবা করতে চাই।’

সিলেট-১ আসনে জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রার্থী হতে পারেন দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক এহতেশামুল হক। তিনি বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্যই এত ত্যাগ এত জীবনবাজি রেখেছে এ দেশের মানুষ। আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই। সেই লক্ষ্যে আমাদের দল কাজ করছে। আশা করি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জনগণ তাদের মালিকানা ফিরে পাবে।’

মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনে ২০১৮ সালে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন খন্দকার আবদুল মুক্তাদির। এবার তিনিই সবচেয়ে জোরালো প্রার্থী। কিন্তু এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন চান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অধীর অপেক্ষায়। আমরাও মানুষের কাছে দলের বার্তা নিয়ে যাচ্ছি। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তিনি নির্বাচন করবেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণের মতো আমরাও অপেক্ষায়।’