
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে ৪০ দফায় তিনি ৭৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। তদবির বাণিজ্যে অংশ নিয়ে আনিসুল হক আত্মীয়দের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে মোটা অঙ্কের এ ঘুষ গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি আদালতে ফ্রিজ হওয়া তার ব্যাংক হিসাবের সন্ধান করতে গিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এ তথ্য।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আনিসুল হক সংশ্লিষ্ট ২৭টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার আদেশ দেন আদালত। তার মধ্যে আনিসুলের নামে রয়েছে ১৭টি হিসাব। এর বাইরে আনিসুল হকের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাতিজাসহ কয়েকজনের নামে আরো ১০টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে বলে জানা যায়।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আনিসুল হক ঘুষ বা অবৈধ আয় গ্রহণে তার ব্যবসায়িক বন্ধু, মা, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাগিনা ও কথিত বান্ধবী তৌফিকা করিমের ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করেছেন। আবার ওই ব্যাংক হিসাবগুলোর একমাত্র নমিনি ছিলেন তিনি। মায়ের ক্ষেত্রে নমিনি হওয়ার যৌক্তিক কারণ থাকলেও অন্যদের ব্যাংক হিসাবগুলোর নমিনিতে তার নাম থাকার বিষয়টি সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। ইতোমধ্যে ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক হিসাবগুলোর বিবরণী দুদকে জমা হয়েছে।
সূত্র জানায়, একমাত্র নমিনি হিসেবে আনিসুল হকের নাম থাকা ঘনিষ্ঠ পাঁচজনের অ্যাকাউন্টে ওই সময়ে ৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা নগদ বা ক্যাশ হিসাবে জমা হয়। এই বিপুল টাকা কোনো ব্যাংক হিসাব থেকে তাদের হিসাবে স্থানান্তর হয়নি। সরাসরি জমা হয়েছে, যা থেকে মূলত সন্দেহ তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অর্থের উৎস গোপন করতেই এমন কৌশল নেয়া হয়েছে।
ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে। ফ্রিজ করা হয়েছে ২৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ১৪০ কোটি ১৭ লাখ টাকা। মামলা হয়েছে তার কথিত বান্ধবী তৌফিকা আফতাব ওরফে তৌফিকা করিমের বিরুদ্ধেও। তার বিরুদ্ধে ৫৬ কোটি ৬১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হয়েছে।
সম্প্রতি দুদক মহাপরিচালক মো: আক্তার হোসেন আনিসুল হকের মামলার অগ্রগতির বিষয়ে বলেন, তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ ও সন্দেহভাজন লেনদেনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। মামলার পর তদন্ত কার্যক্রম চলমান। তদন্ত কর্মকর্তা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন। তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে কমিশন পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেবেন।
সূত্র জানায়, আনিসুল হক তার ঘনিষ্ঠ পাঁচ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে নগদ ৭৫ কোটি ২২ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, এমন আরো ব্যক্তি রয়েছেন যাদের মাধ্যমে ঘুষ নেয়া হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। সবগুলোর তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারলেও ঘনিষ্ঠ পাঁচজনের ব্যাংক হিসাবের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করে ঘুষের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে দুদক।
ওই পাঁচজনের মধ্যে রয়েছেন- আনিসুল হকের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ ইকবাল। যার ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে সাত দফায় নগদ ১২ কোটি ৪৭ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে এককালীন সর্বোচ্চ চার কোটি ৯৯ লাখ টাকা নগদ জমার তথ্য রয়েছে।
অন্য দিকে আনিসুল হক ঘুষ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে তার মায়ের ব্যাংক হিসাবও ব্যবহার করেছেন। ১২ দফায় একই ব্যাংকের হিসাবে ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ২৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা নগদ জমা হয়েছিল। যার মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাঁচ কোটি ৮৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
একইভাবে তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবে ২০১৯ সালে চার দফায় চার কোটি ৮৫ লাখ টাকা এবং তার ভাগিনা এস কে মো: ইফতেখারুল ইসলামের ব্যাংক হিসাবে ১১ দফায় ২৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা নগদ জমা হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এককালীন সর্বোচ্চ ১১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।
আনিসুল হকের কথিত বান্ধবী তৌফিকা করিমের ব্যাংক হিসাবেও ছয় দফায় চার কোটি ৭৫ লাখ টাকা নগদ জমা হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। তাদের সবার হিসাবের একমাত্র নমিনি হলেন আনিসুল হক।
গত ১ জানুয়ারি ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৪ সালে ১ ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে অনিসুল হক অসদাচরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসাধু উপায়ে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ ৭০ হাজার ৯৬ টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন। এ ছাড়া তার ২৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩৪৯ কোটি ১৫ লাখ ২১ হাজার ৫৮২ টাকা জমা এবং ৩১৬ কোটি ৪৮ লাখ ৮১ হাজার ৬০৮ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ মিলেছে।
বিগত তিন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে জয়ী হন আনিসুল হক। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে আত্মগোপনে যান তিনি। গত বছরের ১৩ আগস্ট ঢাকার সদরঘাট থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে। দুদকের মামলায় গত ২০ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।