
পতিত সরকারের আনুকূল্য প্রাপ্ত অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের অর্থপাচার ও অন্যান্য মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত বিষয় তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের গঠিত ১১টি টাস্কফোর্সের মধ্যে ৯টিই আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের সদস্য অথবা সুবিধাভোগীর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আবার যাদের মানিলন্ডারিং তদন্তের জন্য টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে সে প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠজনরাও টাস্কফোর্সে স্থান পেয়েছে। সরকারের একটি শীর্ষ গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
বসুন্ধরা গ্রুপ ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তদন্তের জন্য মানিলন্ডারিং শাখার উপপরিচালক শেখ গোলাম মাওলার নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুসারে, এই টাস্ক ফোর্সের টিম লিডারের বিরুদ্ধে ঘুষ নেয়ার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে অনুসন্ধান চলছে। ২০১৪ সালের ব্যাচের এই কর্মকর্তার বাড়ি ময়মনসিংহে। তিনি বঙ্গবন্ধু ও হাসিনা পরিবারের প্রতি বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল ও আস্থাবান। তার সাথে ২০২২ সালের আওয়ামী লীগের বাছাই করা দলবাজ কর্মকর্তা মো: সাজিদ-উর-রোমান ও মো: মাহমুদুল হাসান ভূইয়াকে সদস্য হিসেবে দেয়া হয়েছে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারবর্গ আর তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে বিশেষ তদন্ত-২ শাখার উপপরিচালক মো: সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। টাস্কফোর্সের এই টিমের দলনেতা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ আমলে কমিশনের চাকরিতে এসেছেন। চাকরিতে যোগদানকালে তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগপন্থী হিসেবে জাহির করতেন। বর্তমানে তিনি বিএনপিপন্থী হয়ে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে একজন অসৎ মানুষ এবং একাধিক বিয়ে করার কারণে তিনি নারী নির্যাতন ও যৌতুক মামলার আসামি। তিনি দুদকের ঘুষের টাকায় এই মামলা মোকদ্দমা নিষ্পত্তি করেছেন বলে জানা যায়। বিএনপিপন্থী অফিসার গোলাম ফারুকের অতি আস্থাভাজন হিসেবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে নিজেকে প্রকাশ ও প্রচার করতে পেরেছেন। তার দলের সদস্য আফনান জান্নাত কেয়া। তিনি একমাত্র নারী সদস্য এই টাস্কফোর্সে স্থান পেয়েছেন। ৩৪ জন অফিসারের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠিত হলেও তিনিই একমাত্র নারী অফিসার। আফনান জান্নাত কেয়ার স্বামী একজন ব্যবসায়ী। তার মাধ্যমে দুদক কর্মকর্তারা মানিলন্ডারিং করেছেন। তিনি হলেন অঘটন ঘটনপটিয়সী। টিমের অন্য দু’জন সদস্য ২০২২ সালে যোগদান করেছেন। তাদের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বেক্সিমকো গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তদন্তের জন্য মানিলন্ডারিং শাখার বিশেষ তদন্ত-১ শাখার উপপরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। টিম লিডার মো: জয়নাল আবেদীন ২০১১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হিসেবে বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে চাকরিতে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্যের কারণে তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ২য় শ্রেণীর পদ হতে প্রথম শ্রেণীর পদে পদোন্নতি পান। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি উপপরিচালক পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগের স্বার্থের বাইরে কিছুই বুঝে না। তিনি বর্তমানে আওয়ামী লীগের বি টিম হিসেবে পরিচিত সাদপন্থী তাবলিগে যোগদান করেছেন। তার সাথে দু’জন সদস্যের একজন সাজ্জাদ হোসেন এনএসআইয়ের সহকারী পরিচালক পদ ছেড়ে দিয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক পদে এসেছেন। আওয়ামী লীগ তাদের মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে বিভিন্ন সংস্থা থেকে বাছাই করা দলীয় কর্মীদেরকে ২০২২ সালে দুদকের প্রথম শ্রেণীর পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি নিজের বিয়ে উপলক্ষে এক কোটি টাকার বাজেটের অনুষ্ঠান করছিলেন বলে জানা যায়। এ টিমে আরো আছেন মিনহাজ বিন ইসলাম। তিনিও ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে দুদকের চাকরিতে যোগদান করেছেন।
জেমকন গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অর্থপাচার তদন্তের জন্য বিশেষ তদন্ত-৩ শাখার উপপরিচালক রেজাউল করিমের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়েছে। টিম লিডার রেজাউল করিম সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, তার গ্রামের বাড়ি জামালপুর জেলায়। তিনি ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে ২০১৪ সালে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন এবং আওয়ামী লীগের সময় পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। তিনি গত ১০ বছরে চোখে পড়ার মতো সহায় সম্পত্তি করে ফেলেছেন। তিনি আর্থিকভাবে চরম দুর্নীতিগ্রস্ত একজন কর্মকর্তা। তার সাথে সদস্য হিসেবে সহকারী পরিচালক এ কে এম মর্তুজা আলী সাগরকে দেয়া হয়েছে। ছাত্রলীগের এই কর্মী কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা বাহারের হাত ধরে চাকরিতে এসেছেন। তিনি নারী, মদ, টাকা, পয়সা সব কিছুতেই পারদর্শী বলে প্রচার রয়েছে। তবে অপর সদস্য আলামিন ২০২২ সালে সহকারী পরিচালক পদে এলেও তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কিছু শোনা যায়নি।
নাবিল গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে মানিলন্ডারিং শাখার উপপরিচালক মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। মাসুদুর রহমান এনফোর্সমেন্টের উপপরিচালক পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকালে চাঁদাবাজি ছাড়া আর কিছুই করেননি বলে জানা যায়। ২০১১ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো অনুসন্ধান বা তদন্ত করেননি। আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তিনি প্রথমদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে বর্ণচোরা হয়ে যান। তিনি বর্তমানে পরিচালক পদে পদোন্নতির জন্য ব্যাপক দৌড়ঝাঁপ করছেন। আর্থিকভাবে তিনি ঘুষ, চাঁদাবাজির দ্বারা দুদকের একজন শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হয়ে গেছেন। এই কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সমিতির (ডুসা) সাবেক সহ-সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। তার দলের অন্য দুই সদস্যের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি ।
নাসা গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে ব্যাংক শাখা উপপরিচালক মো: রাউফুল ইসলামের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। মো: রাউফুল ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত এই টাস্কফোর্স কমিটিকে একটি ভালো টিম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ওরিয়ন গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে বিশেষ তদন্ত-৩ শাখা উপপরিচালক মো: রাশেদুল রহমানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। মো: রাশেদুল ২০১৪ সালে আওয়ামী কোটায় চাকরি পেলেও তিনি একজন চুপচাপ স্বভাবের অফিসার। তিনি আর্থিকভাবে সৎ নন। তার দলের সদস্য খোরশেদ আলম একজন ছাত্রলীগ ক্যাডার। তিনি পিরোজপুর জেলার দুর্বৃত্ত মহারাজ ও মিরাজ গংদের টাকার বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। তার দলের অপর সদস্য মেহেদী মুসা জেবিন একজন দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কিছু শোনা যায়নি। ২০২২ সালে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করলেও তার বিরুদ্ধে টাকা পয়সা নেয়ার অভিযোগ ওঠেনি।
এস. আলম গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে মানিলন্ডারিং শাখা উপপরিচালক তাহসিন মুনাবীল হকের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। তাহসিন হকের নেতৃত্বে গঠিত এই টিম একটি ভালো টিম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সিকদার গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে বিশেষ তদন্ত-২ শাখার পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। মঞ্জুর মোর্শেদ পরিচালক এমন একজন কর্মকর্তা যিনি ১১টি টাস্কফোর্স টিমের মধ্যে একমাত্র পরিচালক হিসেবে দলনেতা হয়েছেন। তার বাড়ি যশোর অঞ্চলে। তিনি যশোরের দুর্বৃত্ত আওয়ামী লীগ নেতা শাহিন চাকলাদারের অতীব নিকটজন। যার সাথে তিনি মালয়েশিয়াতে সেকেন্ড হোম করেছেন। তিনি বাকশালের ছাত্রসংগঠন জাতীয় ছাত্রলীগের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৯৮ সালেই সেন্টমার্টিনে জমি কিনে রিসোর্ট করেছেন। মোহাম্মদপুর এলাকায় তিনি একাধিক ফ্ল্যাট ক্রয় ও ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক। ৫ আগস্ট হাসিনার পদত্যাগের পর তিনি দুদকের চাকরি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু তার কিছু দুর্বৃত্ত বন্ধু শিবলী, নাসির, মোকাম্মেল, শাহরিয়ার ও জাহিদের পা ধরে এই টাস্কফোর্সে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার কমিটির আরেকজন সদস্য সহকারী পরিচালক মো: কামিয়াব আফতাবি-উন-নবী ২০১৭ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে আসেন। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কমিশনের সব অনুষ্ঠানে উপপরিচালক শারিকা ইসলামের সাথে যৌথভাবে উপস্থাপনা করেছেন। উপস্থাপনকালে তিনি শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার হয়েছেন। এ টিমে অন্য সদস্য ২০২২ সালে চাকরিতে এলেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি।
সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে মানিলন্ডারিং শাখার উপপরিচালক মো: গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। এই টাস্কফোর্সের দলনেতা গুলশান আনোয়ার প্রধান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রলীগের এই কর্মী ২০১১ সালে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও তিনি পিকে হালদার নথির ঠিকাদারী হিসেবে টাকা সংগ্রহ করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার এই টাকার ভাগ দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ পেয়েছেন। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা গেছে, তার ভাগের ৪২ কোটি টাকা দিয়ে কানাডাতে বাড়ি কিনেছেন। তার সাথে দুর্বৃত্ত হিসেবে কাজ করেছেন সাবেক মহাপরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন। মহাপরিচালক (অব:) সৈয়দ ইকবাল হোসেন এ টাকার ভাগের ৩২ কোটি টাকা পেয়েছেন। দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া তার ব্যবসায়ী স্বামীর মাধ্যমে এই টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। এই গুলশান আনোয়ার প্রধান একটি অনলাইন কোচিং একাডেমির মালিক। তিনি ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রযোজিত মামলার এজাহার দায়েরকারী, তদন্তকারী ও চার্জশিট দাখিলকারী ছিলেন। তিনি বিদেশ ছাড়া দেশে কোনো চিকিৎসাই নেন না। তিনি শেখ মুজিবকে জাতির পিতা মানেন এবং এ নিয়ে পত্রিকাতে উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। তার মতো ঠাণ্ডা মাথার দুর্বৃত্ত কমিশনে আর একটিও নাই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। তার দলের অন্য দু’জন সদস্য ২০২২ সালে যোগদান করেছেন। তাদের বিষয়ে আর্থিক কেলেঙ্কারি বা অন্য কিছুর তথ্য জানা যায়নি।
সামিট গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিষয় তদন্তে বিশেষ তদন্ত-১ শাখার উপপরিচালক আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। আলমগীর হোসেন, উপপরিচালকের নেতৃত্বে গঠিত এই টাস্কফোর্স টিমটি একটি নিরপেক্ষ টিম বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।