
একজন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথা মনে পড়ে? জেল মেখে খাড়া করা চুল, চোখে চশমা। নিজ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর চেয়েও দাপটশালী ছিলেন। তার এক বিখ্যাত উক্তি, “উই আর লুকিং ফর শত্রুজ।” এবার নিশ্চয়ই মনে পড়েছে। বলছি লুৎফুজ্জামান বাবরের কথা। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি সরকারে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
২০০৭ সালের তত্বাবধায়ক সরকার ও পরে পুরো আওয়ামী লীগ আমল জুড়েই ছিলেন কারাগারে। দুর্নীতি, হত্যাসহ অনেকগুলো মামলার আসামি ছিলেন। এরমধ্যে দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা আর একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো আদালত। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সব মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন তিনি।
দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর পর গত ১৬ জানুয়ারি কারামুক্ত হয়েছেন লুৎফুজ্জামান বাবর। কারাগারের বাইরে তাকে বরণ করতে ছিলো অগনিত কর্মী-সমর্থকের ভিড়। তবে তারা সবাই ছিলেন নিজ এলাকা নেত্রকোণার মানুষ। এক সময়ের দাপটশালী এই প্রতিমন্ত্রীকে বরণ করতে যাননি উল্লেখ করার মত বিএনপির কোন নেতা। এরপর বিএনপির কেন্দ্রীয় কোন অনুষ্ঠানেও মঞ্চে ঠাঁই পাননি। লন্ডনে চিকিৎসা শেষে গত ৭ মে দেশে ফিরেন বিএনপির চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়া। সেদিন গুলশানে বেগম খালেদা জিয়ার বাসা ফিরোজার সামনে দুপুর থেকে দাঁড়িয়ে ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। কিন্তু বিএনপির কোন কেন্দ্রীয় নেতা তাকে বাসার ভেতরে যেতে ডাকেননি। বেগম খালেদা জিয়া বাসায় প্রবেশের বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবর সেই বাসায় প্রবেশের সুযোগ পান। তবে অনেক মানুষের ভিড়ে বেগম খালেদা জিয়াকে এক নজর দেখা আর সালাম দেয়া ছাড়া কথা বলার সুযোগ পাননি।
বিএনপি থেকে ১৯৯১, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আর ২০০১ সালে নেত্রকোণা-৪ আসনে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে রাজনৈতিক অঙ্গণে সবাই বাবরকে মনে করতেন তারেক রহমানের ডান হাত। সেই বাবরকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়নি বিএনপি। তবু জেলখানা থেকেই স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন তিনি। অবশ্য নেত্রকোণার স্থানীয় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা ছিলেন বাবরের পক্ষে। তাই আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসাবে নিজে প্রার্থী হতে পারেননি। তবে তার স্ত্রীকে বিএনপি মনোনয়ন দিয়েছিলো।
তখন পর্যন্ত বাবরের প্রতি বিএনপির এমন সহানুভুতি ছিলো। তাই গত জানুয়ারিতে কারামুক্তির পর সবাই ধরে নিয়েছিলো আবার রাজসিকভাবে দলে ফিরবেন বাবর। কিন্তু তা আর হয়নি। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বাবরের এখন কোন পদ নেই। এমনকি জেলা কমিটিতেও কোন পদ নেই, তিনি এখন শুধু বিএনপির প্রাথমিক সদস্য। একদা দাপটশালী বাবরের এখন কেন এমন অবস্থা? কেন বিএনপিতে এখন গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছেন? এর কারণ জানেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা, যা তাদের কাছ থেকে জানতে পেরেছে ঢাকা টাইমস।
২০০৭ সালে ক্ষমতা নিয়ে মাইনাস টু ফর্মুলা গ্রহণ করেছিলো সেনাসমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার। মাইনাস-টু মানে রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে বিদায় করে দেয়া। এজন্য বিএনপি ও আওয়ামী লীগে সৃষ্টি করা হয় সংস্কারপন্থী গ্রুপ। বিএনপিতে এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন দলের মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া। সেই গ্রুপে ছিলেন সাইফুর রহমানসহ আরো অনেকে। তবে তাদের বেশিরভাগই সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের চাপে সংস্কারপন্থী হতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রমদের মধ্যে ছিলেন লুৎফুজ্জামান বাবর। তিনি নিজের উৎসাহে সংস্কারপন্থী হয়েছিলেন। নিজের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বলতেন খালেদা জিয়াকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়না। নিজে গ্রেপ্তার হয়ে সেনাগোয়েন্দাদের কাছে করেন বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকারের আমলে লুৎফুজ্জামান বাবরের এই আচরণ ভুলতে পারেনি বিএনপির হাইকমান্ড। তাই ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তাকে মনোনয়ন দেয়নি। অবশ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও নেত্রকোণায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকরা বাবরের পক্ষে থাকায় তার প্রতি নমনীয় হয় বিএনপির হাইকমান্ড। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে জায়গা পাওয়ার মত গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেন লুৎফুজ্জামান বাবর।