
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীন ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপা নিয়ে শুরুতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। মুদ্রণ শিল্পের ছদ্মাবরণে এ ষড়যন্ত্রে জড়িত সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাইসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সক্রিয় নেতাকর্মীরা।
এর আগে গত বছর জুলাই বিপ্লবের পর ২০২৫ সালের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে মুদ্রণশিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি এবং যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা জহুরুল ইসলাম সরকারকে বিব্রত করতে প্রথম থেকেই ষড়যন্ত্রে সক্রিয় ছিলেন। ওই সময় তিনি বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠকও করেন। এরমধ্যে মালিবাগের সিআইডি অফিসে উল্টো দিকে স্কাই সিটি হোটেলের এক কক্ষে যুবলীগ নেতা জহুরুল ইসলামের ডাকা গোপন বৈঠকের খবর ফাঁস হলে গোয়েন্দা বিভাগ সক্রিয় হয়। এ নিয়ে ওই সময় বিভিন্ন দৈনিকের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, এবার পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের টেন্ডার নিয়ে ঢাকা ক্লাবে একটি গোপন বৈঠক হওয়ার কথা ছিল গত ২১ জুন। ওই বৈঠকে অংশ নিতে ১১৬ ছাপাখানার মালিককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জনতা প্রেসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম কাজল ও ডিজিটাল প্রেসের মালিক ওসমান গনি এ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনেকের মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে এই আমন্ত্রণ জানানো হলেও শেষ মুহূর্তে বৈঠকটি বানচাল হয়ে যায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সচিবালয় এবং এনসিটিবিতে কর্মরত একশ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে আগেভাগেই ফাঁস হয় পাঠ্যপুস্তকের টেন্ডারের প্রাক্কলিত দর। সেই দর জেনে কোন প্রেস কত বই ছাপার কাজ পাবে, কে কোন লটে কত দর দেবে, তা আগেই ভাগ-বাটোয়ারা করতে সম্প্রতি ঢাকা ক্লাবে ‘নেগোসিয়েশন বৈঠক’ ডাকা হয়েছিল।
সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ছোট ভাই আনন্দ প্রিন্টার্স লিমিটেডের মালিক এবং বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি রাব্বানী জব্বারের এই গোপন বৈঠকে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল। পাঠ্যবই ছাপা ঘিরে গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের ঢাকা ক্লাবে গোপন বৈঠকের চেষ্টার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থার নজরে আসার পর তা বানচাল হয়ে গেছে। পরে তারা রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ছোট ছোট একাধিক গোপন বৈঠক করে টেন্ডার ড্রপ করেন।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য প্রফেসর ড. রিয়াদ চৌধুরী বলেন, পাঠ্যপুস্তকের টেন্ডারের প্রাক্কলিত দর ফাঁস হওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। তবে যারা মুদ্রণ শিল্পের সাথে জড়িত এবং নিয়মিত কাজ করে আসছেন তারা এতোটাই এক্সপার্ট যে, এনসিটিবির টেন্ডারের শর্ত দেখে অনুমান কিংবা হিসাব-নিকাশ করে একটা কাছাকাছি দর বের করে নিতে পারে। ফলে এ জাতীয় সিন্ডিকেট করার উদ্দেশ্যে যদি কোনো গোপন বৈঠক হয়ে থাকে তা খুবই দুঃখজনক ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা উচিত।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর রবিউল কবীর চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, এনসিটিবির বাইরে যদি কেউ এ ধরনের কোনো মিটিং করে থাকেন সেটা তাদের নিজস্ব, আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে পাঠ্যপুস্তক ছাপাকে ঘিরে কোনো মহল যদি জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় সে ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এনসিটিবির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপানোর টেন্ডার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ২/৪টি ছাড়া প্রায় সব টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ। আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে এবার ৩০ কোটি বই ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।
এর আগে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটি বই ছাপানো হয়েছিল। এবার ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবই এক হওয়ায় ১০ম শ্রেণির জন্য গত বছরের ন্যায় ৫ কোটি ছাপানোর প্রয়োজন হবে না। এছাড়া এবার সারা দেশ থেকে চাহিদা কমেছে প্রায় সাড়ে ৪ কোটির বেশি।
এদিকে অভিযোগ উঠেছে, জুলাই বিপ্লবের পর বিভিন্ন সেক্টরে পরিবর্তন আসলেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ এখনো আওয়ামী আমলের সুবিধাভোগীদের দখলে। সিন্ডিকেট করে বই ছাপার কাজ এখনো নিজেদের কবজায় রেখেছেন তারা।
এর মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের ভাই রাব্বানী জব্বার ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে একাই ১ কোটি ৩৩ লাখের বেশি পাঠ্যবই ছাপার কাজ পান। জুলাই বিপ্লবের পর সাবেক মন্ত্রীর ভাইয়ের এত সংখ্যক বই ছাপার কাজ পাওয়া নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন সরকারি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। রাব্বানী জব্বারের এখানো বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি পদে থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সম্প্রতি মতিঝিল সিটি সেন্টারে নজরুল ইসলাম কাজলের অফিসে কয়েক দফা ছাপাখানা মালিকদের ছোট/খাট গোপন বৈঠক হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এদিকে বিগত সময়ে বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত বিএনপি-জামায়াতপন্থীদের প্রতিষ্ঠানকে আওয়ামী সিন্ডিকেট ষড়যন্ত্র করে রাজনৈতিক কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এখনো কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
এ প্রসঙ্গে মেসার্স পি এ প্রিন্টার্সের সত্বাধিকারী মাহমুদ হোসাইন সেলিম আমার দেশকে বলেন, দীর্ঘ সময় (১৯৯৪ -২০১৬) সুনামের সাতে কাজ করি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ২০১৭ সালে ২০১৮ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবইয়ের কাজ করার সময় আমার প্রতিষ্ঠানকে সিন্ডিকেট ষড়যন্ত্র করে রাজনৈতিক কারণে কালো তালিকাভুক্ত করে। এতে আমার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী সুনাম নষ্ট হয় এবং বিরাট অংকের আর্থিক ক্ষতি হয়। নিজের জীবন রক্ষা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কালো থাবা ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে এত বছর চুপচাপ ছিলাম। জুলাই বিপ্লবের পর এখন কালো তালিকাভুক্ত অবমুক্ত করে সংশ্লিষ্টরা এনসিটিবির কাজ করার সুযোগ করে দিবেন বলে প্রত্যাশা করি।
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে সোমবার বিকালে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি রাব্বানী জব্বার, জনতা প্রেসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম কাজল এবং ডিজিটাল প্রেসের মালিক ওসমান গনির সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।