
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে লন্ডন বৈঠকে সম্ভাব্য বিরোধী দল নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তারেক রহমান বলেছেন, যেকোনো মূল্যে হোক সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল রাখা দরকার। কিন্তু তার এই বক্তব্যের পর দেশের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে শক্তিশালী বিরোধী দল কীভাবে হবে? কারণ আওয়ামী লীগের নির্বাচনে আসা এখনো অনিশ্চিত। ইতোমধ্যে দলটির কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধসহ নিবন্ধন স্থগিত করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করতে পারবে কি না, সেই বিষয়ে কেউই নিশ্চিত নয়। অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপির তরফ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না।
তবে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগকে সাময়িক নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’
এমন পরিস্থিতিতে সংসদে বিরোধী দল কে হবে? নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে সম্ভাব্য বিরোধী দল নিয়ে আলোচনা তত জোরালো হচ্ছে। এই বিষয়ে সুধী সমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা ধরনের বক্তব্য দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) সবাই মিলে জোট করে বিরোধী দল গঠন করতে পারে। আওয়ামী লীগকেই বিরোধী দল হতে হবে এমন কোনো কথা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের বাইরে যেতে পারেনি জাতীয় পার্টি। তবে আগামী দিনে এমনটা হবে না। বিএনপিকে ছাড় দিয়ে জামায়াতে ইসলামী কোনো কথা বলবে না, এনসিপিও বিএনপিকে ছাড় দেবে না। ছোট ছোট ইসলামী দল ও বাম দলগুলো দুই-চারটি করে কিছু কিছু আসন পাবে। সবাই মিলে একটা বিরোধী দল হয়ে যাবে। আর বিএনপি যদি দেশ চালাতে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়, তাহলে বিরোধী দল আরও বড় হবে। নাগরিক সমাজেও বিরোধী মত সৃষ্টি হতে পারে। তারপর মিডিয়া যদি নিরপেক্ষ থাকে, তারাও একটা রোল প্লে করতে পারে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই হয় না, এটা ঠিক কথা। সংসদে শক্তিশালী একটা বিরোধী দল লাগে। আমার মনে হয়, রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে একটা সমীকরণ হবে। ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টিসহ অন্য দলগুলো মিলে একটা মোর্চার মতো করতে পারে। তবে এই মোর্চার সঙ্গে জামায়াত থাকবে কি না, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘এই মোর্চা যদি ৫০ থেকে ৬০টি আসন পায়, তাহলে তারা একটা বড় বিরোধী শক্তি হিসেবে পার্লামেন্টে থাকবে। তারা পার্লামেন্টে অনেক ভূমিকা রাখতে পারবে। হয়তো আইন পাসের ব্যাপারে রাখতে পারবে না। কিন্তু সংবিধান সংস্কার হলে সংসদের কমিটিগুলোতে বিরোধী দলের এমপিরা স্থান পাবেন। কাজেই তারা ওখান থেকেও ভূমিকা রাখতে পারবেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা পরীক্ষা। যদি আমরা এভাবে যেতে পারি, তাহলে হয়তো বিএনপির সঙ্গে ভালোভাবে কন্টেস্ট করতে পারবেন বিরোধীরা। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, সেই সমীকরণের দিকে যাচ্ছে। তাহলেই ক্ষমতার মধ্যে একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স আসবে।’
দিলারা চৌধুরী বলেন, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র সেভাবে ফাংশন করতে পারে না। বিরোধী দলকে ফাংশন করতে দিতে ক্ষমতাসীন দলকে রোল প্লে করতে হবে। যেমন স্বাধীনতার পর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যখন ক্ষমতায় আসেন তখন কিন্তু বিরোধী দল বলতে তেমন কিছু ছিল না। খুব সামান্য কয়েকজন ছিলেন। কিন্তু নেহরু পার্লামেন্টের প্রসিডিউরে বিরোধী দলকে কথা বলার সুযোগ বেশি দিয়েছিলেন। তাদের একটা রোল প্লে করার সুযোগ দিয়েছিলেন।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল খুবই দরকার। আশা করি, নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দল ঠিক হবে। সময়ই বলে দেবে কারা সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসবেন।’
এদিকে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিএনপি আগের কালচার (সংস্কৃতি) থেকে বের হয়ে আসবে। আগে আওয়ামী লীগ যেটা করেছে বিএনপি তা করবে না। সংসদে ওটা (বিরোধী দল) নিয়ে ছিল খারাপ সংস্কৃতি। তখন নানা অভিযোগ ছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিরোধী দল ঠিক করার কে? কারা ক্ষমতায় যাবে, কারা বিরোধী দল হবে- এটা জনগণ ভোট দিয়ে নির্ধারণ করবে। ভোট মানুষের মনের বিষয়। আগাম অনুমান করা কঠিন। নির্বাচনের ফলাফলের ওপর সবকিছু নির্ভর করবে।’
উল্লেখ্য, বিগত তিনটি সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় দেশের গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়েছিল বলে আলোচনা আছে। বিশেষ করে পরপর তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সংসদে ওই অর্থে কার্যকর কোনো বিরোধী দল ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ৯টি আসন পেলেও তাদের ভূমিকা ছিল সীমিত। সংসদে বিরোধী দল ছিল জাতীয় পার্টি। কিন্তু জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের ‘নিয়ন্ত্রিত’ বিরোধী দল হিসেবে জনগণ মনে করত। এই কারণেই ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টিও বিপদে পড়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল অবিচ্ছেদ্য অংশ। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সরকারের জবাবদিহি থাকে না এবং ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়া যায় না। দেশের রাজনীতিতে আলোচনা রয়েছে, বিগত তিন সংসদে সরকারের বিপক্ষে বা ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার কোনো দল ছিল না। ফলে সরকার বুঝতে পারেনি, তাদের কোনটা ভুল ছিল, কোনটা সঠিক। যে কারণেই লন্ডনে ড. ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
সূত্রমতে, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি আলাদাভাবে অংশ নেবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীও বিএনপির মতো এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন সামনে রেখে ধর্মভিত্তিক দলগুলো একটা প্ল্যাটফর্ম গঠন করার চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে কওমিভিত্তিক পাঁচটি দল রাজনৈতিক সমঝোতায় এসেছে। আজ শনিবার ঢাকার মহাসমাবেশ থেকে তাদের ঘোষণা আসতে পারে। আর সংস্কার আলোচনায় বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া দলগুলো নিয়ে পৃথক মোর্চা গঠনের চেষ্টায় এনসিপি। তবে এই তিন শক্তি আনুষ্ঠানিক কোনো জোট গঠন করবে না। কিন্তু তারা নির্বাচনে একে অন্যকে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসনভিত্তিক ছাড় দেবে। এদের নিয়ে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল গঠনের মেরূকরণ চলছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রকৃত বিরোধী দল হলো যারা সরকারের আদর্শ ও নীতির বিরোধী। আগামীতে সরকারে কে থাকবে, তার ওপর নির্ভর করবে বিরোধী দল। যদি জনগণ আবার ভোট দিয়ে জাতীয় পার্টির মতো নিয়ন্ত্রিত বিরোধী দল তৈরি করে, তাহলে পাওয়ার পলিটিক্স করার সুযোগ থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রকৃত বিরোধী দল নয়। একটা আরেকটার প্রতিদ্বন্দ্বী। একটা চলে গেলে আরেকটা আসে। তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও ট্র্যাডিশন একই। সেই অর্থে স্বাধীনতার পর বামপন্থিরা প্রকৃতপক্ষে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। বামদের ভুল-ত্রুটি ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর দেশকে যখন আওয়ামী লীগ ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছিল তখন সঠিক পথে নিয়ে আসতে ভূমিকা রাখে বামপন্থিরাই।’
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সংসদে ভাইব্রেন্ট, সাহসী, ইনোভেটিভ একটা বিরোধী দল চাই। কারণ শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে সংসদ কার্যকর হয় না, সরকার চাপেও থাকে না, ফলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ মানেই সরকার ও বিরোধী দল। বিরোধী দল না থাকলে সরকারের জবাবদিহি থাকে না। আমরা মনে করি, সংসদে শক্তিশালী ও কার্যকর বিরোধী দল থাকা উচিত।’
আমরা বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘সামনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, তাদের দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক পরিবেশ, রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত ছাত্র-জনতার পুনর্বাসন, ফ্যাসিবাদীদের বিচারসহ নানা ইস্যুতে ব্যাপক চাপের সম্মুখীন হতে হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জাতীয় সংসদ হচ্ছে রাজনীতির মূল কেন্দ্র। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ সময়েই সংসদ ছিল একতরফা ও অকার্যকর। ফলে সংসদের প্রতি মানুষের তেমন আকর্ষণ ছিল না। রাজপথই ছিল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মূল জায়গা। সামনের সংসদে যদি শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকে, তাহলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাবে দেশ।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের আচরণের ওপর নির্ভর করবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পোলারাইজেশন। আমার ধারণা, সংসদে যদি বিরোধী দল দুর্বল হয় তাহলে রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে শক্তিশালী গণ-আন্দোলন দানা বাঁধবে। সরকার যদি দুর্নীতিরোধ ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারে, সুশাসন, জননিরাপত্তা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে বড় স্থিতিশীলতার গ্যারান্টি।’