Image description

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের ওপর নগরবাসী ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে শপথ পাঠ করানোর দাবিতে রাস্তা দখল ও নগর ভবন তালাবদ্ধ করে টানা আন্দোলন করছেন ইশরাক ও তার অনুসারীরা।

ফলে মানুষ প্রতিদিন যেমন যানজটে অতিষ্ঠ, তেমনি নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত। ইশরাকের আন্দোলন লন্ডনে অনুষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যকার ঐতিহাসিক বৈঠকের সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে বলে একবাক্যে বলছেন সবাই। তারা মনে করেন, বিএনপির উচিত ইশরাককে এখনই থামানো। নইলে এই অযৌক্তিক আন্দোলন বিএনপিকে বিতর্কে ফেলবে।

ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পেতে গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনে তালা দিয়ে ইশরাক হোসেনের কর্মী-সমর্থকরা আন্দোলন শুরু করেন। নগর ভবনের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন কক্ষ ও ফটকে অন্তত ৭০টি তালা ঝুলিয়ে লাগাতার আন্দোলন চালানো হচ্ছে। এ আন্দোলনের সঙ্গে ডিএসসিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি অংশকে জড়ানো হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঈদের আগে ইশরাক হোসেন ১৮ দিন কর্মসূচি পালন করেন। এ সময় তারা প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ঘেরাও করেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাভুক্ত (কেপিআই) প্রতিষ্ঠান সচিবালয়ও একদিন ঘেরাও করেন।

ঈদুল আজহার ছুটিতে কয়েক দিন বিরতি দিয়ে সরকারি অফিস খোলার দিন (১৫ জুন) থেকেই আবার শুরু করেন আন্দোলন। গতকালও নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে কর্মসূচি পালন করেন। ইশরাক হোসেন সমাবেশে ঘোষণা করেন, মেয়র পদে বসানোর বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে তিনি কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন।

ইশরাকের এই আন্দোলনের ফলে সব ধরনের নাগরিক সেবা বন্ধ রয়েছে। এতে করে নাগরিক দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে সমাবেশে ইশরাক হোসেন বলেন, প্রধান ফটকের তালা খোলা হবে না। এটা আন্দোলনের একটা প্রতীক। জনগণের দৈনন্দিন সেবা আমাদের তত্ত্বাবধানে চালু থাকবে। তিনি এ কথাও বলেন, তাকে শপথ না পড়ানো হলে নিজে শপথ নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। আন্দোলনের ব্যাপারে গতকাল প্রতিক্রিয়া জানার জন্য ইশরাক হোসেনকে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘বিজি আছি, পরে।’

ইশরাক গতকাল সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের নিয়ে নগর ভবনের কনফারেন্স রুমে সভা করেন। ওই সভার ব্যানারে তার নামের আগে ‘মাননীয় মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন’ লেখা ছিল।

ইশরাকের মামলার রায়, শপথ ও তার আন্দোলন নিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে সরকার, নির্বাচন কমিশন, বিএনপিসহ সব মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।

ইশরাকের আন্দোলনের ব্যাপারে সরকারের সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ না থাকায়ও মানুষ সমালোচনা করেছেন। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ায় শপথ দেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই। ইশরাকের আন্দোলনকে সরকারের তরফ থেকে দায়িত্বহীনতা এবং আইনের শাসনের প্রতি অবমাননাকর বলে দাবি করা হয়। ইশরাকের আন্দোলনের বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলা হয়, এই আন্দোলনের সঙ্গে দল সম্পৃক্ত নয়। একান্তই তার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ইশরাককে এই মুহূর্তে আন্দোলন বন্ধ করা উচিত। কারণ তাকে বুঝতে হবে তিনি একটি বড় দলের নেতা এবং তার বাবা ঢাকার সাবেক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা, যিনি নাগরিকদের বিড়ম্বনায় না ফেলে সেবা করে গেছেন। তা ছাড়া লন্ডনে তার দলের সঙ্গে সরকারের নির্বাচনসহ সার্বিক বিষয়ে একটি সফল বৈঠক হয়েছে। আর বিএনপিই একসময় সিটি করপোরেশনের ওই নির্বাচনকে অবৈধ বলে দাবি করেছে। আদালত ওই নির্বাচনকে অবৈধ বলেছে। অবৈধ নির্বাচনের বৈধ মেয়র হওয়ার বিষয়টির সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িত রয়েছে।

যা বললেন খন্দকার মোশাররফ

আমার দেশ-এর প্রশ্নের জবাবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ইশরাকের আন্দোলনের সঙ্গে দল সম্পৃক্ত নয়। এই আন্দোলন একান্তই তার নিজস্ব ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে হচ্ছে। বিষয়টি শিগগির দলীয় ফোরামে উপস্থাপন করা হবে এবং আলোচনা হবে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে অনুষ্ঠিত সফল বৈঠকের পর যে আশা ও স্বস্তি বিরাজ করছে সেটাকে আমাদের অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।

বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল মনে করেন আইন অনুযায়ী, গেজেট প্রকাশের পর তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। সরকার এ দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। চলমান আন্দোলন প্রশ্নে বিএনপির এই নেতা বলেন, একজন রাজনীতিকের দায়িত্ব হচ্ছে বিচক্ষণতার সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বুঝে দায়িত্ব পালন করা। জনমতের বিরুদ্ধে যায় এমন কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক থাকা দরকার।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার বক্তব্য

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, ডিএসসিসির মেয়র ইস্যুতে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ ও পরে সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের শপথ দেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই। তবে এভাবে ক্ষমতা দেখিয়ে নগর ভবন দখল, দক্ষিণ ঢাকার দৈনন্দিন নাগরিক সেবায় বিঘ্ন ঘটানো দায়িত্বহীনতা এবং আইনের শাসনের প্রতি অবমাননা। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের একজন নেতার কাছ থেকে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ প্রত্যাশা করিনি।

স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা বলেন, অবরোধের কারণে বিগত মাসে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ নাগরিক সেবা হ্রাস পেয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা ওয়াসা অফিসে বসে সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে নাগরিক সেবা বাধাগ্রস্ত না হয়। ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশীজনদের থেকে আমরা আরো দায়িত্বশীল এবং পরিপক্ব আচরণ প্রত্যাশা করি।

এ নিয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক শাহজাহান মিয়া বলেন, বিষয়টি আইনি ও রাজনৈতিক। তবে এতে নাগরিক সেবা ব্যাহত হচ্ছে। একজন কর্মচারী হিসেবে এর বেশি কিছু বলতে পারি না।

নির্বাচন কমিশন সচিবের বক্তব্য

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা মতামতের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা লিখিত কিংবা মৌখিক কিছুই জানায়নি; যার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হিসেবে গেজেট জারি করা হয়। কারণ আদালতের নির্দেশনার আলোকে ১০ দিনের মধ্যে গেজেট জারির জন্য নির্ধারিত ছিল। কমিশনের সম্মতির আলোকে এটা করা হয়।

নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে কোনো মামলা হলে সেখান থেকে যে আদেশ আসবে তা প্রতিপালন করা ইসির কর্তব্য উল্লেখ করে কমিশনের মুখপাত্র আখতার আহমেদ বলেন, মামলায় ইসির পক্ষ হওয়ার আইনি বিধান নেই। কারণ নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে ইসির কর্মপরিধি হচ্ছে তফসিল ঘোষণা থেকে গেজেট জারি করা পর্যন্ত।

নাগরিক সমাজ ও বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, ইশরাকের এ আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে শুরু থেকেই প্রশ্ন ছিল। নগরবাসীর সেবার পথ রুদ্ধ করে এ আন্দোলনের ফলে মানুষ খুব বিরক্ত। ইশরাকও তার আন্দোলন ও দাবির পক্ষে কোনো যুক্তি পেশ করতে পারেননি। উপরন্তু তিনি শেখ হাসিনার প্রহসন ও প্রতারণামূলক নির্বাচনের বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ আরো বলেন, ‘আমরা সবাই বলে আসছি, শেখ হাসিনার আমলে দেশে আদৌ নির্বাচন হয়নি। আমাদের সেই বক্তব্যকে ইশরাক প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। বিএনপি কেন তাকে আন্দোলন প্রত্যাহারের নির্দেশ দিচ্ছে না, সেটা নিয়েও জনগণের মনে প্রশ্ন রয়েছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঘটনা মানুষকে চরমভাবে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এ ঘটনার অবসান হওয়া দরকার। সরকারকে দ্রুত করণীয় নির্ধারণ করে এর সমাপ্তি টানতে হবে। না হলে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ইতোমধ্যে তৈরি হয়েছে তার আরো বিস্তার ঘটবে। বদিউল আলম মজুমদার বলেন, প্রয়োজন দুই পক্ষের আইনজীবীকে নিয়ে বিষয়টির সুরাহা করা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সভাপতি ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, মানুষকে সেবাবঞ্চিত করে যে আন্দোলন করছেন, এ জন্য তার উচিত জনগণের কাছে জবাবদিহি করা। যে আন্দোলন হচ্ছে তা থামানোর কোনো মানুষ দেখছি না। তার দলের কাউকেও উদ্যোগ নিতে দেখছি না। তিনি বলেন, “আমরা দেখলাম, ‘তিনি নিজে সেবা দেবেন’, আইনত কি তিনি কোনো সেবা দিতে পারেন? করপোরেশনের মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কি শপথ নেওয়ার কোনো সুযোগ আছে? তার উচিত শপথের আন্দোলন না করে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করা।”

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, ‘লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যকার বৈঠকের পর দেশের মানুষের মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন, সংস্কার ও ফ্যাসিবাদের বিচারের বিষয়ে একটি জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় ইশরাকের আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে জনগণের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হওয়াটা বেশ স্বাভাবিক। কারণ, বিএনপি যেখানে ক্ষমতায় আসছে, সেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ একটি মেয়র পদের জন্য এমন আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।’

নগর ভবনে ইশরাকের আন্দোলন নিয়ে কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছেন অনেকে। সিনিয়র সাংবাদিক মুজতবা খন্দকার লিখেছেন, ‘ইশরাক কিন্তু ঢাকা দক্ষিণে বাবার মতো জনপ্রিয় ছিলেন। ভোট হলেই তিনি মেয়র হতেন অনায়াসে। কিন্তু তার একের পর এক হাস্যকর কার্যক্রম জনগণকে তার প্রতি বিষিয়ে তুলছে।’

রায় নিয়ে মেয়র হওয়ার ঘটনার সূত্রপাত চট্টগ্রামে

ফ্যাসিবাদ আমলের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণার সূত্রপাত হয় ৫ আগস্ট গণবিস্ফোরণে শেখ হাসিনার পলায়নের পর। অভ্যুত্থানের এক মাস ২৫ দিনের মাথায় গত বছর ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের নির্বাচনি ট্রাইব্যুনাল ডা. শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র পদে বিজয়ী ঘোষণা করেন। শেখ হাসিনার পতনের পরপরই ট্রাইব্যুনালে একতরফা শুনানি হয়। সেই শুনানি শেষে রায়ে ডা. শাহাদাত হোসেন মেয়র নির্বাচিত হন।

২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মেয়র নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে রেজাউল করিম চৌধুরীর পাওয়া ভোট তিন লাখ ৬৯ হাজার দেখিয়ে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। ডা. শাহাদাত হোসেনকে ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পেয়ে পরাজিত দেখানো হয় তখন। ফলাফল ঘোষণার পর নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ডা. শাহাদাত হোসেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী আমলে এই মামলা শুনানি করে আর নিষ্পত্তি হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পরই ডা. শাহাদাতের পক্ষ থেকে মামলাটি সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মামলায় একতরফা শুনানির পর রায় হয়। আগের ফলাফল বাতিল করে রায় দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক। একই সঙ্গে পরাজিত প্রার্থী ডা. শাহাদাতকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা থেকেও বিরত থাকে নির্বাচন কমিশন।

কমিশন গঠিত হওয়ার ১৩ দিন পরেই গেজেট প্রকাশ

সাবেক সচিব এএমএম নাসির উদ্দিনকে প্রধান করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের সমন্বয়ে গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার ঠিক এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর কাজী হাবিবুল আওয়াল কমিশন পদত্যাগ করেন। তাদের পদত্যাগের পর কমিশন শূন্য থাকে তিন মাসের বেশি। নতুন কমিশন গঠন করা হয় গত বছরের ২২ অক্টোবর। কমিশন গঠিত হওয়ার ১৩ দিন আগে ৯ অক্টোবর ডা. শাহাদাতকে বিজয়ী ঘোষণা করে গেজেট হয়।

আগেই উল্লেখ করেছি চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করে যখন গেজেট জারি হয়, তখন দেশে কোনো নির্বাচন কমিশনই ছিল না। অথচ গেজেট জারি করার কথা কমিশনের। খোদ কমিশনই যখন ছিল না তখন প্রতিষ্ঠানটির সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম নিজ দায়িত্বে শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেন। গেজেট প্রকাশের আগে আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামতও নেওয়া হয়েছে।

আইন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানায়, আইন মন্ত্রণালয় ইতিবাচক মতামত দিয়েছিল। তবে তখন মাত্র নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল। মন্ত্রণালয় তখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় শাহাদাতের বিষয়টি এসেছিল আইন মন্ত্রণালয়ে। অনেক কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয় নিষ্পত্তি করে বলে দাবি সূত্রের।

সাবেক ইসি সচিব শফিউল আজিমের বক্তব্য

বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাতকে চসিক মেয়র হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গত বছর ৮ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসি। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় কমিশনের সচিব ছিলেন শফিউল আজিম। বর্তমানে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি হিসেবে ন্যস্ত আছেন। নির্বাচন কমিশন না থাকার পরও কেন তিনি গেজেট জারি করেন জানতে চাইলে শফিউল আজিম বলেন, ‘আদালতের রায়ের পর আমরা আইনি দিকগুলো যথাযথভাবে যাচাই করেছি। তারই পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র পদের সংশোধন বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে।’

ইশরাকের শপথ নিয়ে জটিলতা যেখানে

ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রামের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই ইশরাকের করা মামলাটি নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। শাহাদাত হোসেনের মতোই ইশরাক নির্বাচনের ফলাফল বাতিলের দাবিতে মামলা করেন। তাদের দুজনেরই মামলার মূল আর্জি ছিল, নির্বাচনে অনিয়ম হয়েছে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি। ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন তৎকালীন সরকারদলীয় প্রার্থী। তাই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করাই ছিল মামলার মূল দাবি।

ইশরাক মামলাটি শুনানির জন্য সচল করার আবেদন জানানোর সময় মূল আর্জি সংশোধন করেন। যদিও আইনের ভাষা, নিয়ম ও রেওয়াজ অনুযায়ী মামলার এক মাস পর আর আর্জি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। কিন্তু ইশরাক হোসেন মামলার চার বছর পর আর্জিতে পরিবর্তন এনে আগের ঘোষিত ফলাফল বাতিল করে তাকে বিজয়ী ঘোষণার নিবেদন করেন। মূল আর্জিতে তাকে বিজয়ী ঘোষণার নিবেদন ছিল না। আর্জিতে এই সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ডা. শাহাদাতের মতোই চলতি বছরের ২৭ মার্চ ঢাকা জেলা জজ আদালতের নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের বিচারক ফজলে নূর তাপসের ফলাফল বাতিল করেন। একই সঙ্গে ভোট-পরবর্তী ফলাফলে পরাজিত ইশরাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। মামলার রায়ের পর ইশরাক হোসেনের আইনজীবীকে মিডিয়ায় বলতে শোনা যায়, এই নির্বাচন ছিল অবৈধ। বিচারক নির্বাচনটিকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন এবং ইশরাক হোসেনকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে।

এই মামলাটিও একতরফা শুনানি হয়। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না। রায়ের পর নির্বাচন কমিশন আপিলও করেনি। যে কারণে জনস্বার্থে করা আপিল বিভাগের আবেদনটি অবজারভেশন দিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়।

আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের আগেই গেজেট প্রকাশ

ডা. শাহাদাত হোসেনের গেজেট প্রকাশের সময় নির্বাচন কমিশন ছিল না। নতুন কমিশন গঠনের পর ইশরাকের রায় ঘোষণা করা হয়। শাহাদাত হোসেনের মতোই কমিশন ইশরাকের বেলায়ও আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায় মতামতের জন্য। কিন্তু আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত দেওয়ার আগেই ২৭ এপ্রিল গেজেট জারি করে কমিশন। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে চিঠি দিলেও সেটার অপেক্ষা না করেই গেজেট জারি করা হয় কমিশনের পক্ষ থেকে।

এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিলে আমার দেশকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২২ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন থেকে মতামত চেয়ে ফাইল আসে। আইন মন্ত্রণালয় মতামত তৈরি করছিল। মতামত চূড়ান্ত করে ফাইল ফেরত দেওয়ার আগেই কমিশন নিজ দায়িত্বে ২৭ এপ্রিল রাত ১০টায় গেজেট জারি করে। এতে আইন মন্ত্রণালয়ের মতামতের প্রসঙ্গটি কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, ইশরাক হোসেন নিজেও তদবির করেছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ে। তাকে জানানো হয়েছিল এ বিষয়ে মতামত প্রস্তুত করা হচ্ছে। শিগগির ফাইল মতামতসহ ফেরত যাবে।

ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে আগে কী বলেছিল বিএনপি

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারির ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি ছিল চরমভাবে বিতর্কিত। ভোটের পরপরই বিএনপি তখন দাবি করেছিল ওই নির্বাচনে ৫ শতাংশেরও কম ভোট কাস্ট হয়েছে। নির্বাচনের পর রাত ৮টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংবাদ সম্মেলন করে ভোটের ফল প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ওই সংবাদ সম্মেলনে স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে দাবি করেন ৫ শতাংশ ভোটারও ভোট দিতে কেন্দ্রে যায়নি। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এই ভোটের ফল বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবি জানান। শুধু তা-ই নয়, ফল প্রত্যাখ্যান করে সেটা বাতিলের দাবিতে একদিনের হরতালও পালন করেছিল বিএনপি। তখন ফল প্রত্যাখ্যান করে নতুন নির্বাচন দাবি জানালেও এখন আদালতের দোহাই দিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে কেন বসতে মরিয়া ইশরাক হোসেন এ প্রশ্ন নগরবাসীর। আদালতের বরাত দিয়ে দলটির সিনিয়র নেতারাও অনেক বক্তব্য দেন। অনেকের মতে, সরকারকে চাপে রাখতে এটা বিএনপির একটি কৌশল ছিল। কিন্তু ১৩ জুন লন্ডনে ঐতিহাসিক বৈঠকের পর সরকারকে চাপে রাখার কি আর কোনো কারণ আছে? নাগরিকদের স্বার্থের কথা ভেবে বিএনপির উচিত এ অবস্থার উত্তরণ ঘটানো। ইশরাককে বলা যে, এবার থামো।

দলীয় তোষামোদি ভালো নয়, আদালতের রায়কে কেন্দ্র করেই শেখ হাসিনার পতন ঘটে

দলীয় তোষামোদির আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে অনেক বিষয় পার পাওয়া যায়। আবার আদালতের তোষামোদির ঘাড়ে বন্দুক রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনায় বুমেরাংও হয়। এর বড় নজির হচ্ছে শেখ হাসিনার পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া।

ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তার মনের ইচ্ছা ছিল চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বহাল রাখতে হবে। তাই একটি অনুগত তোষামোদির আদালতে মামলা দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ফল খুব ভালো হয়নি। কোটা পদ্ধতি সংস্কার নিয়ে দলীয় ও ফ্যাসিবাদ তোষামোদির আদালতের রায়ের পরপরই ফুঁসে উঠেছিল ছাত্র-জনতা। রায় বুমেরাং হয়ে শেখ হাসিনার পতনই শুধু নয়, ৮০০ বছরের বেশি সময়ের ইতিহাসের পর সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া নতুন নজির তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। আদালতের মাধ্যমে সংস্কার করা কোটা পদ্ধতি আবার ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্রের ফলেই শেখ হাসিনার পতন ঘটেছে।

একই পদ্ধতিতে জেলা জজ পদমর্যাদার বিচারকের নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ও দলীয় চিন্তার তোষামোদির রায়ও বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রত্যাখ্যান করা ফলাফলকে আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার ঘটনা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

ফজলে নূর তাপস ২০২০ সালের ১৬ মে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দুই সপ্তাহ পর ২ জুন ডিএসসিসির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসাবে গত ১ জুন ঢাকা সিটি করপোশনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে।